ক্রীড়া ডেস্ক :: দল গঠন আর ঘোষণার সাথে ‘বিতর্ক’ ও ‘সমালোচনা’ শব্দ দুটি প্রায় অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। শুধু বাংলাদেশ নয়, দল গঠন আর ঘোষণা মানেই কোনো না কোনো ইস্যুতে বিতর্ক কিংবা সমালোচনার ঝড়।
বাংলাদেশেও বিভিন্ন সময় দল গঠন নিয়ে অনেক বড় বড় বিতর্কর সৃষ্টি হয়েছে। অনেক উত্তাপ ছড়িয়েছে। তবে এবার বিশ্বকাপে বাংলাদেশ স্কোয়াড গঠন এবং ঘোষণা নিয়ে সে অর্থে তেমন সমালোচনা হয়নি। অল্প সংখ্যক ভক্ত-সমর্থক ছাড়া সচেতন ক্রিকেট অনুরাগী ও স্থানীয় বিশেষজ্ঞরা মেনেই নিয়েছেন, এটাই সময়ের সম্ভাব্য সেরা দল।
তবে ফাস্টবোলার তাসকিন আহমেদের জায়গা না পাওয়া, নিজেকে হারিয়ে খোঁজা সৌম্য সরকারের অন্তর্ভুক্তি, পাশাপাশি গত দুটি বিশ্বকাপ খেলা ইমরুল কায়েস বিবেচনায় না আসা- এ ইস্যুগুলো নিয়ে কিছু কথাবার্তা হচ্ছে। তবে এর মধ্যে তাসকিন ইস্যুতেই যা কথা চালাচালি হচ্ছে।
বিশ্বকাপ দলে জায়গা না পেয়ে তাসকিনের কান্না কারো কারো মনে নাড়া দিয়ে গেছে। সহানুভূতি জন্মেছে। কিন্তু কঠিন সত্য হলো, দুর্ভাগ্যজনক ইনজুরির পর তার ম্যাচ ফিটনেস ফিরে পেতে এবং স্বাভাবিক ছন্দ পেতে আরও সময় দরকার। বর্তমান সময়ে সে ফিটনেস ও ছন্দে নেই এ দ্রুতগতির বোলার। এ কারণেই তাকে নিয়েও প্রিমিয়ার লিগে নিয়মিত খেলাচ্ছে না লিজেন্ডস অফ রূপগঞ্জ।
এদিকে একটা উল্লেখযোগ্য সংখ্যক অনুরাগীর চোখ তাসকিনের দিকে থাকলেও এর বাইরে আরও একজন ক্রিকেটার কিন্তু আছেন, যিনি অনেক বেশি ফিট। বল ও ব্যাট হাতে দুর্দান্ত ফর্মে আছেন। পারফরমও করছেন নিয়মিত। কিন্তু তাকে নিয়ে সে অর্থে কোনো কথা নেই।
তার নাম প্রায় ঢাকা পড়ে গেছে। তিনি থেকে গেছেন পর্দার আড়ালে। অথচ সবার অলক্ষ্যে তিনিও তিলে তিলে নিজেকে বিশ্বকাপ খেলার জন্য প্রস্তুত করেছেন।
অনেকেই মানছেন তিনি বিশ্বকাপ দলে থাকার দাবিদার। কিন্তু ১৫ জনের দলে তার জায়গা হয়নি। বিবেচনায়ও আসেননি। তিনি আর কেউ নন, ফরহাদ রেজা। ব্যাট ও বলে ফর্মের চূড়ায় থাকা রাজশাহীর এ পরিশ্রমী ৩২ বছর বয়সী অলরাউন্ডার জায়গা পাননি বিশ্বকাপ দলে। এমনকি আয়াল্যান্ডে তিন জাতি আসরে যে বাড়তি দুজন ক্রিকেটারকে নেয়া হয়েছে, সেখানেও নেই ফরহাদ রেজার নাম।
অথচ পরিসংখ্যান, ফিটনেস আর মাঠের পারফরমেন্স ধরলে এ মুহূর্তে বাংলাদেশে যে কজন হাতে গোনা ইনফর্ম পারফরমার আছেন, ফরহাদ রেজা তাদের অন্যতমর অন্যতম। আসুন গত ছয় মাসের ও কম সময়ে দেশের ক্রিকেটে ফরহাদ কি করেছেন, তা এক পলকে দেখে নেই।
রংপুর রাইডার্সের হয়ে এবারের বিপিএলে ১৪ ম্যাচে পেয়েছেন ১৭ উইকেট। ৪ উইকেটের পতন ঘটিয়েছেন ১ বার। স্ট্রাইকরেট ১৩.৭, বোলিং গড় ১৯.১।
তারপর প্রিমিয়ার টি-টোয়েন্টিতে ব্যাট ও বল হাতে নজর কাড়া পারফরমেন্সে হয়েছেন আসর সেরা পারফরমার। ৪ ম্যাচে ১১ উইকেট, ৫ উইকেট ১ বার, ৩ উইকেটে ১ বার। আর সেরা বোলিং ৩২ রানে ৫ উইকেট। পাশাপাশি ব্যাট হাতে করেছেন ১০৭ রান।
তারপর ৫০ ওভারের প্রিমিয়ার লিগেও ফরহাদ রেজা বল হাতে দুরন্ত-দুর্বার। এখন পর্যন্ত লিগে সবচেয়ে সফল বোলার। ১৩ ম্যাচে ৩৩ শিকারে সর্বাধিক উইকেটশিকারি। বুধবারও শেরে বাংলায় প্রাইম ব্যাংকের বিপক্ষে প্রাইম দোলেশ্বরের জয়ের নায়ক ফরহাদ রেজা।
তার বিধ্বংসী বোলিংয়ে (৪/২২) ১৬৯ রানের মামুলি সংগ্রহে গুঁড়িয়ে যায় প্রাইম ব্যাংকের ইনিংস। কিন্তু এই সামান্য কটা রান করতেই প্রায় নাভিশ্বাস উঠে গিয়েছিল। চরম সংকটে ২৪ বলে ৪১ রানের ঝড়ো ইনিংস খেলে দলকে ৩৮ বল আগেই জয়ের বন্দরে পৌঁছে দেন ফরহাদ রেজা।
এ ম্যাচে ম্যাচ জেতানো বোলিং স্পেলসহ এবারের লিগে ফরহাদ রেজা ৫ উইকেট পেয়েছেন ১ বার। ৪ উইকেটের পতন ঘটিয়েছেন ৩ বার। আর ম্যাচসেরা বোলিং ৪০ রানে ৫ উইকেট।
শুধু বল হাতে নয়। অলরাউন্ডার ফরহাদ রেজার ব্যাটিং সামর্থ্যও প্রমাণিত। সাত আট নম্বরে এখনো বাংলাদেশের সবচেয়ে কার্যকর লেট অর্ডারের অন্যতম সেরা, দক্ষ ও সফল উইলোবাজ রাজশাহীর এ নিবেদিতপ্রাণ ক্রিকেটার।
বাংলাদেশ দলে আছেন পাঁচজন মিডিয়াম পেসার। এর মধ্যে মোহাম্মদ সাইফউদ্দীন আর অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা ছাড়া মোস্তাফিজু রহমান, রুবেল হোসেন আর আবু জায়েদ রাহীর ব্যাটিং সামর্থ্য খুবই কম। শেষের তিনজনের তুলনায় তো বটেই, সাইফউদ্দীন আর মাশরাফির চেয়ে ফরহাদ রেজার ব্যাট সচল।
ইংলিশ কন্ডিশনে খুব দ্রুত গতির বোলারের পাশাপাশি জেন্টল মিডিয়াম পেস, সঠিক ও মাপা লাইন-লেন্থের পেসারদের মধ্যে যাদের সুইং আছে, তাদের সফল হবার নজির ভুরি ভুরি।
ফরহাদ রেজা ঠিক ওই ক্যাটাগরির বোলার। তার বলে গতির প্রচণ্ডতা নেই একটুও। মাঝারি গতি। লাইন ও লেন্থ ভালো। সামর্থ্যের বাইরে গিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার প্রবণতা কম। যে কারণে আলগা ডেলিভারির সংখ্যাও কম।
গড়পড়তা ১২০ থেকে ১২৫ কিলোমিটার গতিতে বল করেন। যা ইংল্যান্ডে কার্যকর হবার যথেষ্ট সম্ভাবনা ছিল। বিশ্বকাপের খেলা হবে মে‘র শেষ (৩০ মে থেকে, তবে বাংলাদেশের প্রথম ম্যাচ ২ জুন, শেষ ম্যাচ ৫ জুলাই) জুন-জুলাইতে। ইংল্যান্ডে তখন ‘আর্লি সামার।’ ওই সময়ে মাঝে মধ্যে বৃষ্টি হয়। হয়তো হবেও। সেই বৃষ্টি ভেজা আবহাওয়া, কনকনে ঠান্ডা বাতাস মানেই আদর্শ সিমিং কন্ডিশন।
ফরহাদ রেজা এমনিতেই খুব টাইট বোলিং করেন। নিজের খারাপ দিন ছাড়া বেশির ভাগ সময় তার বলে নিয়ন্ত্রণ বেশ। সুনিয়ন্ত্রিত বোলিং, চমৎকার লাইন-লেন্থ আর ছোট্ট ছোট্ট সুইংই তার বড় অস্ত্র। যা ইংলিশ কন্ডিশনে যথেষ্ট কার্যকর হবার সম্ভাবনা। এছাড়া ডেথ ওভারে তার বুদ্ধিদীপ্ত বোলিংটাও প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানের উত্তাল উইলোবাজি থামাতে বড় প্রতিষেধক। আর শেষ দিকে হাত খুলে মারার সামর্থ্যও বেশ। অথচ এমন এক ক্রিকেটার বিবেচনায় আসেননি।
জাতীয় দলের হয়ে তার শেষটা ভালো না মোটেই। সমালোচকদের দাবি, শেষ যখন জাতীয় দলে এসেছিলেন তখন নিজেকে মেলে ধরতে পারেনি ফরহাদ রেজা। ২০১১ সালের ৬ ডিসেম্বর শেষ ওয়ানডে পাকিস্তানের সাথে। আর লাল সবুজ জার্সি গায়ে শেষ মাঠে নামা ২০১৪ সালের ২০ মার্চ বিশ্ব টি-টোয়েন্টি আসরে বাছাইপর্বে হংকংয়ের বিপক্ষে।
২ উইকেটের লজ্জাজনক পরাজয়ের ওই ম্যাচে ফরহাদ রেজা ছিলেন চরম ব্যর্থ। ব্যাট হাতে ০ রানে আউট, আর ভাইটাল মুহূর্তে বোলিংয়ে এসে ২ ওভারে ২৩ রান দিয়ে প্রকারন্তরে দলের পরাজয় ত্বরান্বিত করেই আসলে ভিলেন বনে গিয়েছিলেন। তারপর আর পাঁচ বছরে বিবেচনায় আসেননি। তবে তখনকার চেয়ে এখনকার ৩১ বছরের ফরহাদ রেজা আরও পরিণত। এবং চৌকষ ও কার্যকর।
তবে অনেকেরই মত এবার বিশ্বকাপে সময়ের সম্ভাব্য সেরা পারফরমারে সাজানো হয়েছে বাংলাদেশ দল। তবে খেলা যেহেতু ইংল্যান্ডে , ইংলিশ কন্ডিশন আর ফরহাদ রেজার দুর্দান্ত ফর্ম বিবেচনায় তার মত মিডিয়াম পেসার আর কার্যকর লেট অর্ডার দলে থাকতে পারতেন।
জাতীয় দলের ম্যানেজার এবং আবাহনীর কোচ খালেদ মাহমুদ সুজন মনে করেন, ফরহাদ রেজা তার ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা সময় কাটাচ্ছেন এখন। জাগো নিউজকে সুজন বলেন, ‘হয়তো টিম কম্বিনেশন এবং সাইফউদ্দীনের মত আরেকজন প্রমাণিত মিডিয়াম পেসার কাম দক্ষ লেট অর্ডার দলে আছে বলে জায়গা পায়নি। তবে আমার মনে হয় ফরহাদ রেজা এবার বিশ্বকাপ স্কোয়াডে থাকার জোর দাবিদার ছিল। আমার দেখা তার সেরা ফর্ম এখন।’
এমন ফর্মের চূড়ায় থাকা পারফরমারই তো বিশ্বকাপের বড় মঞ্চে খেলবেন! তবে কি পাঁচ বছর আগে বিশ্ব টি-টোয়েন্টির বাছাই পর্বে হংকংয়ের বিপক্ষে লজ্জা জনক হারের ম্যাচে বেশি খারাপ করাটাই তার কাল হয়েছে? তা হবে কেন? একদিন খারাপ যেতেই পারে। অনেক লদ্ধ প্রতিষ্ঠিত ক্রিকেটারের বাজে দিন যায়। তার ভুল ও ব্যর্থতায় দল হেরে বসে। তাই বলে কি তার আবার দলে ফেরার পথ রুদ্ধ হয়ে যায়? ফরহাদ রেজার ক্ষেত্রে কি তাই হয়েছে?
তার বর্তমান ফর্মকে বিবেচনায় এনে অন্ততপক্ষে আয়ারল্যান্ডে পাঠানো যেতো। সেখানে ত্রিদেশীয় সিরিজে ৪টিসহ ফাইনালে খেললে ৫টি ম্যাচ পাবে বাংলাদেশ। সেখানে যদি ২-৩টি ম্যাচও তিনি খেলতে পারতেন, তবে আন্তর্জাতিক ম্যাচে এই অলরাউন্ডারের কার্যকারিতাটা যাচাই করা যেত। সেই সুযোগটাও না পাওয়া ফরহাদ রেজার বড় দুর্ভাগ্যই বলতে হবে!