আকস্মিক দুর্ঘটনা মোকাবিলায় পূর্বনির্ধারিত পরিকল্পনা জরুরি


হআমাদের দেশে বহুতল ভবনে আগুন লাগলে তা নিয়ন্ত্রণ করার মতো প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি এবং সক্ষমতা নেই বললেই চলে। যদিও আগের তুলনায় কিছুটা আধুনিকায়ন করার প্রক্রিয়া চলছে; তবে তা বাস্তব প্রেক্ষাপটে খুবই অপ্রতুল। যানজটের রাজধানীতে কোনো জায়গায় আগুন লাগলে সেখানে পৌঁছতে পৌঁছতেও অনেক সময় লেগে যায়। ততক্ষণে জানমালেরও অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যায়

আমাদের দেশের গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় আগুন লাগার ঘটনা অনেকটাই নিয়মিত হয়ে উঠছে। এক্ষেত্রে অসচেতনতা এবং অনিয়মই মূল কারণ হিসেবে বারবার উঠে আসছে। যখন এ ধরনের ভয়াবহ আগুনের ঘটনা ঘটে, তখনই এসব অনিয়মের বিষয় নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষও তদন্তের কথা বলে এবং দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে। কিছুদিন চলার পর তা বন্ধ হয়ে যায়। কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। যেন আরেকটি ঘটনা ঘটার জন্য অপেক্ষায় থাকে। রাজধানীর পুরান ঢাকা থেকে শুরু করে অভিজাত এলাকার বিভিন্ন ভবনে অগ্নিনির্বাপণের যথাযথ ব্যবস্থা আছে কি না, তা উপেক্ষিত থেকে যায়। ঘটনা ঘটার পর বের হয়ে আসে নানা অনিয়মের কথা। ২২ তালা এফ আর ভবনটিতে যে অনিয়ম ছিল, তা এখন প্রকাশিত হচ্ছে। কামাল আতাতুর্ক এভিনিউয়ে অবস্থিত ভবনটির রাজউকের অনুমোদন ছিল ১৮ তালা পর্যন্ত। ভবন কর্তৃপক্ষ তা না মেনে আরও কয়েক তলা বাড়ায়। এমনকি বহুতল ভবনের চারপাশে জায়গা ছাড়ার যে বিধান রয়েছে, তা-ও ভবন কর্তৃপক্ষ মানেনি। ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, ভবনটিতে অগ্নিনির্বাপণের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। এর আগে চকবাজারের চুড়িহাট্টার যে ভবনটিতে আগুন লাগে, সেটির কোনো অনুমোদনই ছিল না। দেখা যাবে, যথাযথভাবে তদারকি করলে রাজধানীর অনেক ভবনেই এ ধরনের অনিয়ম ধরা পড়বে। এ পর্যন্ত যে কয়টি ভয়াবহ অগ্নিকা- ঘটেছে, সেগুলোর ব্যাপারে তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও, তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়নি। দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, এমন খবর পাওয়া যায়নি।
দুঃখজনক হলেও সত্য, একের পর এক ট্র্যাজেডির ঘটনা ঘটলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তো বটেই; ভবন মালিকদের মধ্যে কোনো সচেতনতা বাড়েনি। এমন উদাসীনতা বিশ্বের আর কোনো দেশে আছে কি না, তা আমাদের জানা নেই। বিশেষজ্ঞরা অনেক আগে থেকেই বলে আসছেন, যেভাবে অপরিকল্পিতভাবে রাজধানী গড়ে উঠছে, তাতে আগুন লাগলে অসংখ্য প্রাণহানি ঘটবে। হচ্ছেও তাই। তবে এ কথা অনস্বীকার্য, রাজধানীসহ বিভিন্ন শহরে বহুতল ভবন গড়ে ওঠা স্বাভাবিক। তার অর্থ এই নয়, এগুলো যথাযথ নিয়ম মেনে করা হবে না। এক ট্র্যাজেডির ক্ষত না শুকাতেই রাজধানীতে আবারও ভয়াবহ অগ্নিকা-ের ঘটনা নগরবাসীর উদ্বেগ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। রাজধানীর অভিজাত এলাকা বলে পরিচিত বনানীতে অবস্থিত ২২ তলা এফ আর টাওয়ারে ঘটে মর্মান্তিক এ অগ্নিকা-। ডিএমপির তথ্য অনুযায়ী, এ ঘটনায় শ্রীলংকার এক নাগরিকসহ ২৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন ৭৩ জন। তবে নিহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। এফ আর টাওয়ারের আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে ফায়ার সার্ভিসের ২০টি ইউনিটের সঙ্গে যোগ দেন সেনা, বিমান ও নৌবাহিনীর সদস্যরা। এলাকার সাধারণ মানুষও উদ্ধার কাজে অংশ নেন। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ৬ ঘণ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। বলা বাহুল্য, উদ্ধার অভিযানে এ সম্মিলিত অংশগ্রহণ না থাকলে ক্ষয়ক্ষতি ও হতাহতের সংখ্যা আরও বাড়ত। আমরা মনে করি, এফ আর টাওয়ারের অগ্নিকা-ের সঠিক কারণ এবং যথাযথ বিল্ডিং কোড মেনে ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছিল কি না, তা উদ্ঘাটন করা জরুরি।
এছাড়া সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে তা বেরিয়ে আসবে বলে আশা করি। দেশে অগ্নিকা-জনিত দুর্ঘটনা বেড়েই চলেছে। এতে আর্থিক ক্ষয়ক্ষতিসহ ব্যাপক প্রাণহানিও ঘটছে। তারপরও এ ধরনের ঘটনা রোধ করা যাচ্ছে না কেন, তা খতিয়ে দেখা উচিত। অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে, কোনো দুর্ঘটনার পর কর্তৃপক্ষ সাধারণত দায়ীদের বিরুদ্ধে মামলা, তদন্ত কমিটি ইত্যাদির আয়োজন করে কিছুদিন বেশ সরব ভূমিকা পালন করে। পরে বিষয়টি বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যায়। এ প্রসঙ্গে পুরান ঢাকার নিমতলীতে সংঘটিত ভয়াবহ অগ্নিকা-ের ঘটনা স্মরণ করা যেতে পারে। নিমতলীর হৃদয়বিদারক সেই ঘটনায় অনেক মানুষ জীবন্ত দগ্ধ হয়েছিল। দুর্ঘটনার পর দাবি উঠেছিল, শুধু পুরান ঢাকা নয়, রাজধানীর কোনো আবাসিক এলাকায় যেন বিপজ্জনক কোনো রাসায়নিকের মজুত না থাকে। জনদাবির প্রেক্ষাপটে সরকার এ বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের আশ্বাস প্রদান করেছিল। কিন্তু চকবাজারের চুড়িহাট্টায় সংঘটিত অগ্নিকা- আমাদের কথা ও কাজের ফারাক স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, অগ্নিকা- একই সঙ্গে জীবন ও সম্পদবিনাশী। দেশে প্রায়ই অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটলেও এ ব্যাপারে করণীয় নির্ধারণ, উদ্ধার প্রক্রিয়া ও জনসচেতনতা যতটুকু থাকা দরকার, তা নেই বললেই চলে। এ অবস্থায় অগ্নিকা-সহ অন্যান্য দুর্যোগের সম্ভাব্য বিপদ ও ক্ষতি ন্যূনতম পর্যায়ে রাখতে হলে আমাদের দীর্ঘমেয়াদি প্রস্তুতি নিয়ে অগ্রসর হওয়া উচিত। সরকার প্রণীত বিল্ডিং কোড মেনে ভবন নির্মাণ, রাজউকের অনুমোদিত নকশা বাস্তবায়নে কড়াকড়ি, নির্মিত ভবনের ঝুঁকি নিরূপণ করে প্রয়োজন অনুযায়ী ভবনের রেট্রোফিটিং ও একটি কনটিনজেন্সি প্ল্যান তৈরি করতে হবে।
বিশ্বের অনেক দেশে অগ্নিকা-সহ অন্যান্য প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে উন্নত প্রযুক্তির সহায়তায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করার প্রযুক্তির ব্যবহার চালু হয়েছে। বাংলাদেশেও এ পদ্ধতি অনুসরণ করা উচিত। এছাড়া বিপদ মোকাবিলায় সাধারণ মানুষকে মানসিকভাবে প্রস্তুত রাখা এবং নিয়মিত মহড়া ও স্বেচ্ছাসেবক তৈরির ওপরও গুরুত্ব দিতে হবে। এফ আর টাওয়ার অগ্নিকা-ে সর্বশেষ মৃত্যু সংখ্যা ২৬ এবং আহত সংখ্যা ৭৩, যা আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। প্রশ্ন হলো, নগর দুর্যোগ মোকাবিলায় সমন্বিত ব্যবস্থাপনায় আমরা কতটা প্রস্তুত? ২০১০ সালে পরিচালিত এক জরিপের রিপোর্ট মূল্যায়ন করে দেখা যায়, শুধু ঢাকা শহরের ৯০ শতাংশের বেশি বহুতল ভবনে অগ্নিব্যবস্থাপনা ও জরুরি নির্গমনের কোনো প্রস্তুতি নেই। আরও সুনির্দিষ্টভাবে যদি জরিপের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করা হয়, সে ক্ষেত্রে দেখা যায়, মাত্র ৫ শতাংশ বহুতল ভবন জরুরি নির্গমন গাইডলাইন অনুসরণ করে। মাত্র ৩ শতাংশ ভবনে ফায়ারলিফট আছে, ৬০ শতাংশ ভবনে কোনো জরুরি অগ্নিনির্গমন ব্যবস্থা নেই, ৬৪ শতাংশ ভবনে কোনো ফায়ার অ্যালার্ম নেই এবং মাত্র ৩১ শতাংশ ভবনে পানির জলাধার বা রিজার্ভার আছে। এছাড়া বেশিরভাগ ভবনে নেই কোনো প্রশিক্ষিত অগ্নিব্যবস্থাপক। যদিও ৮০ শতাংশ ভবনে অগ্নিনির্বাপক ইকুইপমেন্ট আছে; কিন্তু সেগুলো ব্যবহার উপযোগী কি না, সে বিষয়ে নিয়মিত মনিটর এবং ইন্সপেকশন হয় কি না, জানা নেই। এই হলো সার্বিক অগ্নিব্যবস্থাপনার হালচাল। এছাড়া সবচেয়ে বড় যে চ্যালেঞ্জ, সেটি হচ্ছে বহুতল ভবনে স্থাপিত অফিস-আদালত অথবা আবাসিক এলাকায় অবস্থানকারী জনগোষ্ঠীকে অগ্নিদুর্ঘটনা ও করণীয় সম্পর্কে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সচেতন করা।
সাধারণত বহুতল ভবনে যে বিষয়গুলো করা জরুরি ও বাধ্যবাধকতার মধ্যে পড়ে, সেগুলো হলোÑ ভূমিকম্প ও আগুন ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে ভবনের সবাইকে মকড্রিল, সিমুলেশন এবং নির্গমন ব্যবস্থার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যোগাযোগ স্থাপনা করা, যাতে যে কোনো মুহূর্তে, যে কোনো জরুরি দুর্যোগ মোকাবিলা করার ব্যবস্থাগুলোর সঙ্গে বসবাসকারীরা সম্পৃক্ত হতে পারেন এবং মানসিকভাবে আগে থেকেই প্রস্তুত থাকতে পারেন। বাংলাদেশের নগরগুলোয় বহুতল ভবনের ব্যবস্থাপনায় আরও গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়গুলো এড়িয়ে যাওয়া হয়, সেগুলো হলোÑ স্মোক সেনসেটিভ ডিটেক্টর, ফায়ার অ্যালার্ম সিস্টেম, স্মোক ফ্রি বা সেনসেটিভ ডোর, ভেন্টিলেশন, অটোফায়ার এক্সটিংগুইশার, ফায়ার ফাইটিং অ্যাপারেটাস, জরুরি হেল্প লাইন, ফায়ার সেফটি ক্লিয়ারেন্স ফায়ার ইন্সপেকশন, ফায়ার সিস্টেম মেইনটেন্যান্স, সেফটি ফায়ার ভলান্টিয়ার, ফায়ার প্রুফ স্টেয়ারস, ইমার্জেন্সি এলিভেটর, ফায়ার ইনসিডেন্ট রিমোটিং, ফায়ার স্ট্যান্ডার্ড রুল এবং জলাধার। বেশিরভাগ বহুতল ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে রাজউক প্রণীত গাইডলাইন অনুসরণ করা হয় না। এফ আর টাওয়ারের কথাই ধরা যাক। এ ভবনটির অনুমোদন ছিল ১৮ তলা পর্যন্ত। কিন্তু সরকার প্রণীত বিল্ডিং কোড এবং রাজউক অনুমোদিত নকশার বাইরে কীভাবে এ ভবনটি ২২ তলা পর্যন্ত নির্মাণ করা হলো এবং কোন অদৃশ্য শক্তি সেটিকে মেনে নিল, সে বিষয়ে সূক্ষ্ম তদন্ত হওয়া দরকার। জানা যায়, ভবনে রয়েছে মাত্র তিনটি লিফট ও একটি বা দুটি সিঁড়ি। অথচ বিল্ডিং কোড অনুযায়ী ৫০০ জনের বেশি বসবাসরত ভবনে ফায়ার প্রটেক্টেড ডোর, কমপক্ষে দুটি সুপরিসর সিঁড়ি থাকা বাধ্যতামূলক। কিন্তু এসবের খবর কে রাখে।
আমাদের দেশে বহুতল ভবনে আগুন লাগলে তা নিয়ন্ত্রণ করার মতো প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি এবং সক্ষমতা নেই বললেই চলে। যদিও আগের তুলনায় কিছুটা আধুনিকায়ন করার প্রক্রিয়া চলছে; তবে তা বাস্তব প্রেক্ষাপটে খুবই অপ্রতুল। যানজটের রাজধানীতে কোনো জায়গায় আগুন লাগলে সেখানে পৌঁছতে পৌঁছতেও অনেক সময় লেগে যায়। ততক্ষণে জানমালেরও অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যায়। এসব দিক বিবেচনা করলে রাজধানী অগ্নিকা-ের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। বেশিরভাগ অগ্নিকা-ই অসচেতনতা এবং উদাসীনতার কারণে ঘটে থাকে। বহুতল ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে অগ্নিকা-ের বিষয়টি খুব একটা আমলে নেওয়া হয় না। কোনো কোনো গুরুত্বপূর্ণ ও বাণিজ্যিক ভবনে লোকদেখানো অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা রাখা হয়। তারা ভাবেন না, ভবনে আগুন লাগতে পারে এবং এজন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা থাকা দরকার। ভবনগুলোতে জরুরি এক্সিট ব্যবস্থাও যথাযথভাবে থাকে না। থাকলেও তা দায়সারা গোছের। আমরা মনে করি, রাজধানীতে যেসব হাইরাইজ বিল্ডিং রয়েছে, সেগুলো যথাযথ নিয়ম মেনে করা হয়েছে কি না, তা রাজউকসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের খতিয়ে দেখা উচিত। যেসব ভবন নিয়ম মানেনি, সেগুলোর মালিকের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। অন্যদিকে যেসব নতুন ভবন হচ্ছে, সেগুলোও আগে থেকে তদারকি করতে হবে। আগুন লাগলে তা দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য ফায়ার সার্ভিসকে আধুনিক ও স্বয়ংসম্পূর্ণ করে গড়ে তোলা অপরিহার্য, যাতে ঘিঞ্জি এলাকা থেকে শুরু করে অভিজাত এলাকার আগুন দ্রুত নিয়ন্ত্রণে প্রতিষ্ঠানটি সক্ষম হয়। এক্ষেত্রে উন্নত বিশ্বের অগ্নিব্যবস্থাপনা অনুসরণ করা প্রয়োজন। হ

রায়হান আহমেদ তপাদার
লেখক ও কলামিস্ট
raihan567@yahoo.com


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *