আগুনে সব পুড়েছে, এক মাসের সন্তান নিয়ে রাস্তায় কবির-সালমা দম্পতি


রাত ৩টা ২০ মিনিটের দিকে আগুন টের পাই। পাশের ঘরেই তখন জ্বলছিল আগুন। কোনো রকম সবাই বেরিয়ে যাই। টিঅ্যান্ডটি মাঠে বউ-বাচ্চাকে রেখে বস্তিতে ঢুকতে গিয়ে দেখি চারদিকে আগুন আর আগুন। সব পুড়ছে। ফায়ার সার্ভিসের আগুন নেভানোর পর নিজের ঘরের কাছে যাই। ততক্ষণে অবশিষ্ট বলে কিছু নেই। সব পুড়ে ছাই।

শুক্রবার দিবাগত রাত ৩টার দিকে বনানীর টিঅ্যান্ডটি মাঠসংলগ্ন বেদেরঘাট বস্তিতে লাগা আগুনে সব হারিয়ে হতবিহ্বল প্রাইভেটকারচালক কবির হোসেন কথাগুলো বলছিলেন। সাত বছর ধরে স্ত্রী ও নবজাতক ছেলেসহ দুই সন্তানকে নিয়ে বেদেরঘাট বস্তিতে থাকেন তিনি। কবিরের বাড়ি কুমিল্লায়।

জাগো নিউজকে তিনি বলেন, আগুনে বাসার সব পুড়ে গেছে। টিভি-ফ্রিজ, খাট-আসবাবপত্র ছাই হয়ে মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। আমার পাসপোর্ট, ড্রাইভিং লাইসেন্স সব খোয়া গেল।

কবিরের স্ত্রী সালমা জাগো নিউজকে বলেন, মাথা গোঁজার ঠাঁই ছিল এটাই। পেটের দায়ে এই বস্তিতে থাকা। এই বস্তিতেই আমার এক মাসের সন্তান হোসেন মাহবুবের জন্ম। আগুনে সব হারালাম, এখন কী খাব, কই যাব কোনো কুলকিনারা পাচ্ছি না।

ফায়ার সার্ভিস সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীর বনানীর টিঅ্যান্ডটি কলোনি বস্তিতে শুক্রবার দিবাগত রাত সাড়ে ৩টায় আগুনের সূত্রপাত। ২২টি ইউনিট প্রায় দুই ঘণ্টার চেষ্টায় ভোর ৫টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। আগুন পুরোপুরি নির্বাপণ হলেও অগ্নিকাণ্ডে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এখন পর্যন্ত জানাতে পারেনি ফায়ার সার্ভিস।

শনিবার দুপুরে সরেজমিনে দেখা যায়, বস্তিতে ঠায় দাঁড়িয়ে কয়েকটি গাছ। কিন্তু গাছের ডালপালা-পাতাও পুড়ে গেছে। পুড়ে যাওয়া ঘর খুঁজে অবশিষ্ট বলতে যা কিছু জোটে সেই সন্ধানে নেমেছেন বস্তির ক্ষতিগ্রস্ত বাসিন্দারা।

বস্তিবাসীর অভিযোগ, আগুন লেগেছিল মূলত পাশের গোডাউন বস্তি থেকে। সেখান থেকে বাতাসের কারণে দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়ে পাশের বেদেরঘাট বস্তিতে। আগুনে দুই বস্তি মিলে পাঁচ শতাধিক ঘর পুড়ে গেছে। আগুনে গৃহহারা বস্তির মানুষগুলো আশ্রয় নিয়েছেন টিঅ্যান্ডটি কলোনির মাঠে খোলা আকাশের নিচে।

পুড়ে যাওয়া বেদেরঘাট বস্তিতে কথা হয় মো. সুজন নামে এক ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির সঙ্গে। ফুটপাতে ভ্যানে ফেরি করে জুস-পানি বিক্রি করেন সুজন। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, আমার বেঁচে থাকা আয়-রোজকারের অবলম্বন ছিল একটি ভ্যান। সারাদিন জুস-পানি বিক্রি করে বস্তির ঘরে ভ্যান নিয়ে ফিরতাম। গতকাল রাতে সব তো পুড়েছে, সাথে পুড়েছে আয়ের অবলম্বন ভ্যানটাও। কিছুদিন আগে বিয়ে করেছি। ঘরে থাকার মতো বেশকিছু আসবাবপত্রও কিনেছিলাম। কিন্তু আগুনে রাতারাতি আমি সবহারা।

মো. জুল হক (৪২) নামে আরেকজন ফায়ার সার্ভিসের ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ উল্লেখ করে বলেন, আগুন লাগার পরপরই দমকল বাহিনী গাড়ি নিয়ে আসে। কিন্তু সবকিছু সেট করতে করতে সব পুড়ে শেষ হয়ে যায়। অথচ সামনে ও পেছনে ছিল খাল। পানি সরবরাহের অভাব ছিল না।

তাসলিমা নামে এক ভুক্তভোগী বলেন, আগে কড়াইল বস্তিতে থাকতাম। সেখানে বারবার আগুন লাগায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। তাই গত বছর ওই বস্তি ছেড়ে এই বস্তিতে আসি। কিন্তু এখানেও শনির দশা। আগুনে জ্বলি-পুড়ি, সব হারাই, ফের গোছাই আবার রাতের আগুনে সব হারাই।

মহাখালী ২০ নম্বর ওয়ার্ডের পুনর্নির্বাচিত কাউন্সিলর মো. নাছির জাগো নিউজকে বলেন, এখানে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করা হচ্ছে। আপাতত তাদের খাওয়ার জন্য খিচুরি-শুকনো খাবার সরবরাহ করা হচ্ছে। থাকার জন্য স্থানীয় স্কুল ও কলোনির মাঠে ব্যবস্থা করা হয়েছে। দ্রুতই তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে। সে জন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, ঢাকা জেলা প্রশাসন, উত্তর সিটি করপোরেশন ও এনজিও দাতা সংস্থাগুলোর সাথে সমন্বয় করা হচ্ছে।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র জামাল মোস্তফা বলেন, আমি নিজে ক্ষতিগ্রস্ত বস্তি পরিদর্শন করব। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর থাকা-খাওয়ার যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। ক্ষতিপূরণের পাশাপাশি পুনর্বাসনের ব্যবস্থাও করা হবে।