আগে যা পারেননি এ বছর তা করবেন অর্থমন্ত্রী


অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জানিয়েছেন, আগে যা করতে পারিনি, নতুন বছর তা অবশ্যই করতে পারব। আমার দায়িত্ব হচ্ছে করে যাওয়া, ইনশাআল্লাহ করে যাব।

বুধবার (১ জানুয়ারি) সচিবালয়ে সরকারি ক্রয় ও অর্থনৈতিক বিষয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক শেষে তিনি এসব কথা বলেন।

সদ্য সমাপ্ত ২০১৯ সালে দেশের অর্থনৈতিক মূল্যায়ন বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মূল্যায়ন তো আপনারা করবেন, সবাই মিলে মূল্যায়ন করবেন। কতগুলো কাজ যেগুলো স্ট্রেইট ওয়ে, নাম্বার দিয়ে মেলাতে পারবেন না। যে কাজগুলো আজকে করলাম সেগুলোর কোনোটার সফলতা আসবে একদিন পরে, কোনোটার আসবে এক বছর পরে আবার কোনোটার এক ঘণ্টার মধ্যেই সফলতা আসবে।’

মন্ত্রী বলেন, ‘সেগুলো দেখেই মূল্যায়ন করতে হবে। আমি এটুকু বলতে পারি, আগামী ৫ জানুয়ারি চলুন বসি, সেখানে বসে দেখেন যে, আমরা ট্র্যাকে আছি কি না। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে ট্র্যাকে থাকা। সারাবিশ্বে কী হচ্ছে? সেগুলো নিয়ে আমরা এখানে কীভাবে আছি, আমাদের কোথায় আরও সফলতার জায়গাটি ব্যবহার করতে পারিনি। সেগুলো আমাদের আপনারাই বলবেন।’

বিগত বছর আপনি যা করতে পারেননি এ বছর তা করতে পারবেন কি না? জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রী জানান, অবশ্যই পারব। আমি করে যাব, আমার দায়িত্ব হচ্ছে করে যাওয়া… ইনশাআল্লাহ করে যাব। যে কাজগুলো করতে পারব না, এমন কোনো কাজ আমাকে দেয়া হয়নি। আমাকে তো বলা হয়নি যে, হাডুডু করে জয়লাভ কর। আমাকে এখানে অর্থনীতির ওপর খেলতে বলা হয়েছে।

তিনি বলেন, ‘অর্থনীতিতে আমাদের যে সক্ষমতা রয়েছে, আমি বলব না আমাদের অর্থনীতিতে এখন ৪০ শতাংশ গ্রোথ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আমার সামনে যে পরিমাণ সম্ভাবনা রয়েছে, এটা আমি নিজে বুঝি। এটাকে যদি এক্সপ্লয়েট (কাজে লাগানো) করতে পার, হয়তো আজ না হয় কাল, সময় এদিকে ওদিক হতে পারে, বাট যেটা বলব সেটাই হবে।’

২০১৯ সালে প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির বিষয়ে অর্থমন্ত্রী কিছু না বললেও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স ছাড়া বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রায় সব সূচকই নিম্নমুখী হয়ে পড়েছে। সরকারের বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদনেই এসব তথ্য উঠে এসেছে।

এদিকে ২০০৯ সালের পর বিশ্ব অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সবচেয়ে কম হবে চলতি অর্থবছর। এ সময় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হবে মাত্র ২ দশমিক ৯ শতাংশ। আবার গত ছয় মাসে বিশ্ব বাণিজ্য ও বিনিয়োগ গত দুই বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন অবস্থানে রয়েছে। দ্য অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশনের (ওইসিডি) এক প্রতিবেদনে বিশ্ব অর্থনীতির এমন দুরবস্থার কথা তুলে ধরা হয়েছে। বিশ্ব অর্থনৈতিক এই মন্দার প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে।

প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স ছাড়া বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রায় সব সূচকই নিম্নমুখী হয়ে পড়েছে। বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আমদানি ও রফতানি বাণিজ্য। দীর্ঘদিন ধরেই দেশে বাণিজ্য ঘাটতি থাকলেও সাম্প্রতিক সময়ে তা আরও বেড়ে যাচ্ছে। এতদিন আমদানি বাড়ার প্রবণতা ছিল।

চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসের হিসাবে দেখা গেছে, আমদানি আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৩ দশমিক ১৭ শতাংশ কমে গেছে। সার্বিক আমদানির পাশাপাশি শিল্প খাতে বিকাশের প্রধান উপকরণ মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানিও অনেক কমে গেছে।

এদিকে রফতানি বাণিজ্যেও চলছে মন্দা। চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ১৮ শতাংশ কম রফতানি হয়েছে। জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে ১ হাজার ৮০৫ কোটি ডলার লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে রফতানি হয়েছে ১ হাজার ৫৭৮ কোটি ডলারের পণ্য। গত অর্থবছরের একই সময়ে রফতানি হয়েছিল ১ হাজার ৭০৭ কোটি ডলারের পণ্য।

রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যমতে, দেশের রফতানি বাণিজ্যে গার্মেন্ট খাত এককভাবে ৮৪ শতাংশ অবদান রাখে। চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে গার্মেন্ট পণ্যের রফতানি কমেছে পৌনে ৮ শতাংশ। সার্বিক রফতানি আয়ে এর প্রভাব পড়েছে। এ সময়ে সার্বিকভাবে রফতানি আয় কমেছে ৭ দশমিক ৫৯ শতাংশ। এদিকে ভিয়েতনাম ও ইথিওপিয়া গার্মেন্ট পণ্যে ভালো করছে। এজন্য বাংলাদেশের তুলনায় প্রতিযোগিতায় এগিয়ে যাচ্ছে তারা।

রফতানি আয় ও আমদানি কমে যাওয়ায় বাড়ছে বাণিজ্য ঘাটতি। গত জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত দেশের বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৫৬২ কোটি ডলার।

এদিকে ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকট, আমদানি ও রফতানির ঋণাত্মক অবস্থার কারণে অর্জিত হচ্ছে না শুল্ক আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্যমতে, গত জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত রাজস্ব আহরণ হয়েছে ৬৫ হাজার ৯৬ কোটি টাকা, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২০ হাজার কোটি টাকা কম। তবে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় সাড়ে ৪ শতাংশ বেশি।

রাজস্ব খাত থেকে কাঙ্ক্ষিত পরিমাণে আয় না হওয়া এবং বিদেশ থেকে প্রয়োজনীয় ঋণ না পাওয়ায় ব্যাংক খাত থেকে সরকারকে ঋণ নিতে হচ্ছে। ঋণের টাকায় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনও দিতে হচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, অর্থবছরের প্রথম ছয় মাস শেষ হওয়ার আগেই পুরো অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি ঋণ নিয়ে ফেলেছে সরকার। এতে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমে যাচ্ছে। গত অক্টোবর মাসে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি গত এক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন অবস্থানে চলে গেছে।

এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অর্থনীতিতে একটা বড় ধাক্কা লাগতে যাচ্ছে। ব্যাংকের টাকা উত্পাদনশীল খাতের চেয়ে অনুত্পাদনশীল খাতে চলে যাচ্ছে বলেও মনে করছেন তারা।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে দেশের উত্পাদনশীল খাত বা শিল্প খাতের উত্পাদন প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২ দশমিক ২ শতাংশ। গত বছরের একই সময়ে প্রবৃদ্ধি ছিল ১৪ দশমিক ৬ শতাংশ।

একটি দেশ অর্থনৈতিকভাবে কতটা শক্তিশালী, তার পরিমাপ করা হয় সে দেশের মোট দেশজ উত্পাদন বা জিডিপি প্রবৃদ্ধির হিসাবে। সেই বিচারে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে উচ্চ প্রবৃদ্ধির অর্থনীতি এখন বাংলাদেশ। চলতি অর্থবছরেও ৮ ভাগের বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জনের আশা করছে সরকার। তবে যেসব সূচকের ওপর ভর করে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে, তাদের বেশিরভাগই নিম্নমুখী।

এছাড়া প্রধানমন্ত্রীকে সুদহার কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ব্যাংকের চেয়ারম্যান পরিচালকরা। নানা সুযোগ-সুবিধাও নিয়েছে। নানা টালবাহানায় দেড় বছরেও তা বাস্তবায়ন করেননি। সর্বশেষ ব্যাংক মালিকদের সঙ্গে বৈঠক করে শিল্প ঋণে সুদহার ৯ শতাংশ বুধবার (১ জানুয়ারি) থেকে কার্যকর করার ঘোষণা দিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী। কিন্তু সেটিও সম্ভব হয়নি। এটি আগামী এপ্রিল মাস থেকে বাস্তবায়িত হবে বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *