ইংল্যান্ডে উঁচিয়ে ধরুক বাংলাদেশ তাদের ক্রিকেটীয় মশালটা


বিশ্বকাপ ক্রিকেট সভ্যতাকে কোন বাঁকে নিয়ে দাঁড় করিয়েছে? এ নিয়ে তর্ক হতে পারে। পক্ষে-বিপক্ষে নানা যুক্তি দাঁড় করানো যাবে। তবে একটা কথা বলা যায়, বিশ্বকাপের সৌজন্যে ক্রিকেট বিনোদনের বক্স অফিসে রূপ নিয়েছে। বিপণনযোগ্য পণ্য হয়েছে। ক্রিকেট বিশ্বায়নের পথ খুঁজে পেয়েছে। সব মিলিয়ে বিশ্বকাপ ক্রিকেট গ্রহে বড় ধরনের একটা বিপ্লব ঘটিয়েছে। সেই বৈপ্লবিক পরির্বতনের পথ ধরে বাঙালিও দারুনভাবে ক্রিকেট বিনোদন উপভোগ করে এখন।

বাঙালি আজ বিশ্বকাপ বা ক্রিকেটের মধ্যে দিয়ে যে স্বর্গীয় আনন্দ খুঁজে নিচ্ছে, তাঁর পেছনে অবশ্য এক স্বর্গীয় ভদ্রলোকের কিছুটা অবদান আছে। তিনি স্বর্গীয় জগমোহন ডালমিয়া। বাঙালির প্রথম বিশ্বকাপের সময় তিনি-ই ছিলেন আইসিসির প্রেসিডেন্ট। তবে বাংলাদেশের প্রথম বিশ্বকাপ খেলার যোগত্যা অর্জনের পেছনে তাঁর প্রত্যক্ষ কোন ভূমিকা ছিল না। কিন্তু প্রথম বিশ্বকাপ খেলার পর বাংলাদেশ যে টেস্ট স্ট্যাটাস পেয়েছিল সেখানে ভারতীয় এই ক্রিকেট কর্তার বড় একটা ভূমিকা ছিল। সেটা অস্বীকার করার অসৌজন্যতা এদেশের মানুষ দেখান না।

তবে শুধু বাংলাদেশ আর বাঙালি নয়, ক্রিকেট দুনিয়া মিস্টার ডালমিয়ার কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে। কারণ, ইংলিশ আভিজাত্য আর আর্থিক দাপটকে টেক্কা দিয়ে তিনিই প্রথম বিশ্বকাপ এই উপমহাদেশে এনেছিলেন। তার পেছনেও বোধহয় ১৯৮৩’র ২৫ জুন বড় একটা ভূমিকা রেখেছিল।

কারণ, ‘কালো ঘোড়া’ হিসেবে সেদিন ক্যারিবীয় ক্রিকেট সাম্রাজ্য তচনচ করে দিয়ে ভারত বিশ্বকাপ জিতেছিল। প্রুডেনসিয়াল কাপ চলে এল ভারতে। তারপরের বিশ্বকাপ ভারত আয়োজন করে পাকিস্তানের সাথে যৌথভাবে। টেলিভিশন সম্প্রচারের মাধ্যমে ক্রিকেট ঢুকে পড়লো এই উপমহাদেশের মানুষের রান্না ঘর পর্যন্ত!

এই কথাটা লিখতে গিয়ে একটু পেছন ফিরে দেখতে হচ্ছে। অনেকে অবশ্য মনে করেন, ক্রিকেট বিশ্বে প্রতিদিন যেখানে বিপ্লব ঘটছে, সেখানে পেছন ফেরার কী দরকার! দরকার অবশ্যই আছে। কারণ,প্রুডেনসিয়াল বিশ্বকাপের সময় জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে কপিল দেবের সেই অতিমানবীয় অপরাজিত ১৭৫ রানের ইনিংসের কোন ভিডিও নেই।

আপনি যতোই ইউটিউবে সার্চ দিন না কেন, পাবেন না। পেতে পারেন গোটা কয়েক স্টিল ইমেজ! কারণ, সেদিন বিবিসির টেলিভিশন ক্রুরা ধর্মঘট করেছিলেন। কোন খেলা দেখানো সম্ভব হয়নি। আর আজ বিশ্বের দু’শর বেশি দেশে একাধিক চ্যানেলে মানুষ বিশ্বকাপ দেখেন। তারা এখন আর চ্যানেল নির্ভর হয়েও বসে নেই।

অনলাইন, ফেইসবুকসহ অন্যান্য কত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পয়সার বিনিময়ে খেলা দেখার সুযোগ পাচ্ছেন। এটাই হয়তো সভ্যতার এগিয়ে চলা। তবে ক্রিকেটে অংকের কথাটা যতটা সযত্নে রাখা হয়, স্মৃতিগুলো অতোটা সযত্নে রাখা হয় না। বা থাকে না। স্মৃতি মুছে যেতে বেশি সময় লাগে না।

তবুও স্মৃতি হাতড়ে বলছি। প্রথম তিনটে বিশ্বকাপের নাম ছিল প্রুডেনসিয়াল কাপ। তারপর চতুর্থৃ বিশ্বকাপ হয়ে গেলো আরেকটা ইনস্যুরেন্স কোম্পানির নামে। রিলায়েন্স। প্রুডেনসিয়াল আর রিলায়েন্সন, এই দুটো ইনস্যুরেন্স কোম্পানির সৌজন্যে ক্রিকেট বিনোদন এভাবে মানুষের কাছে, বীমা করা হয়ে যাবে সে সময় কেউ কি ভাবতে পেরেছিলেন তা! এটাই ক্রিকেট। যা ভাবা যায় না, তাই ঘটে।

বিশ্বকাপ ক্রিকেট কত মানুষের জীবনের অসামান্য মুহূর্তের জন্ম দিয়েছে। কত সুখের স্মৃতিতে দুলিয়েছে মানুষকে। আগামীতেও দোলা দেবে। আবার একইভাবে কত মানুষকে স্বপ্ন ভঙ্গের বেদনায় ডুবিয়েছে। প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছরের ক্রিকেট বিশ্বকাপ ইতিহাস কত উজ্জ্বল-আর একই সঙ্গে ঝাপসা স্মৃতিতে ঠাসা!

প্রথম দুই বার ক্লাইভ লয়েড লর্ডসের ব্যালকনিতে কাপ উচিয়ে ধরেছেন। চশমা পরা ওই ভদ্রলোক ছাড়া আর কাউকে তখন ভাবা যায়নি,কাপ উঁচিয়ে ধরার যোগ্য হিসেবে। কারণ, ক্রিকেট দুনিয়ায় ক্যারিবীয় সাম্রাজ্যে তখন আঘাত হানার মত শক্তি কারো ছিল বলে ভাবা হতো না। কিন্তু তৃতীয় বিশ্বকাপ জন্ম দিল কী অবিশ্বাস্য নাটকের।

যাদের প্রথম কেউ পাত্তা দিতে চায়নি। গণনায় ধরা হয়নি সেই ভারত নাটকীয়ভাবে ফাইনাল জিতলো। তাও লয়েডের ওয়েস্ট ইন্ডজিকে হারিয়ে! স্কোরবোর্ডে ১৮৩ রানের পুঁজি নিয়ে ৬০ ওভারের বিশ্বকাপ ফাইনাল জেতা যায়! হ্যাঁ, সেটাও দেখলো ক্রিকেট বিশ্ব। পরের বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়া অ্যালান বর্ডারের নেতৃত্বে এটা ভাঙাচোরা দল নিয়ে ফাইনালে চলে গেলো।

সেটাই অবিশ্বাস্য মনে হয়েছিল। তারা শেষ পর্যন্ত বিশ্বকাপ জিতলো। তাও লাখ খানেক দর্শকের সামনে ক্রিকেটের নন্দন কানন ইডেনে! অবশ্য ক্রিকেট পন্ডিতরা বলেন, সেটা সম্ভব হয়েছিল; মাইক গ্যাটিং এর ‘ম্যাডনেস মোমেন্ট’ এর কারণে। জেতা ম্যাচ ইংল্যান্ড হাত ছাড়া করেছিল গ্যাটিং এর রিভার্স সুইপে।

ইংলিশদের ক্রিকেট ইতিহাসে দুঃখ আর হতাশায় ভরা এক মুর্হুত হিসেবে সেই রিভার্স সুইপ জায়গা পেয়েছে। এরপর থেকে বিশ্বকাপ স্মৃতিগুলো আরো ব্যতিক্রমী হতে শুরু করলো। পাল্টাতে শুরু করলো বিশ্বকাপের চেহারা। চরিত্র। সবই। সাদা বল। কালো পর্দা। রঙীন পোশাক। রাতের আলো। জাঁকজমক আর বিগ হিটিং, পিঞ্চ হিটিং-এর যুগ।

রাতের আলোয় প্রথম বিশ্বকাপ ট্রফি উঁচিয়ে ধরেছিলেন পাকিস্তানের অধিনায়ক ইমরান খান। ইমরানের উজ্জ্বল মুখ হয়তো ফাইনাল শেষে ঝাঁপসা হয়ে দেখা দিত, যদি বিশ্বকাপ ইতিহাসের সেরা দুটো ডেলিভারি বেরিয়ে না আসত ওয়াসিম আকরামের বাঁ-হাত থেকে। বিশেষ করে ক্রিস লুইসকে বোল্ড করা সেই ডেলিভারি ক্রিকেট বিশ্ব না দেখলে ইংলিশরা বিশ্বকাপটা ছুঁয়ে দেখতে পারত।

কাপ শোক নিয়ে বারবার ইংল্যান্ড আয়োজক হচ্ছে। যেখানে বাংলাদেশেরও বেশ কিছু সুখস্মৃতি আছে। সাসেক্সের মাঠে বিশ্বকাপ অভিষেক হয়েছিল বাংলাদেশের। ভুলবেন কীভাবে সেই মুহূর্তটা? স্টিফেন ফ্লেমিং-এর সাথে বাংলাদেশের প্রথম বিশ্বকাপ অধিনায়ক হিসেবে টস করতে নামছেন আমিনুল ইসলাম বুলবুল।

ভুলতে চাইলেও কি ভুলতে পারবেন, স্কলটল্যান্ডের এডিনবারায় মিনহাজুল আবেদীনের সেই বীরোচিত ইনিংস। যা বাংলাদেশকে এনে দিয়েছিল প্রথম জয়। আর নর্দাম্পটন বাংলাদেশ ক্রিকেট ইতিহাসের বড় এক অধ্যায় জুড়ে থাকবে। কারণ, সেখানেই সেবারের ফাইনালিস্ট পাকিস্তানকে হারিয়েছিল বাংলাদেশ। সেটা অবশ্য আজকের পাকিস্তানের মত তারকাহীন দল ছিল না। এক গাধা তারকা, মহাতারকায় ঠাসা পাকিস্তানকে হারিয়ে বাঙালি সেদিন খুঁজে পেয়েছিল, বিজয়ের অন্যরকম এক স্বাদ!

এবারও সেই ইংল্যান্ডে বাংলাদেশ গেছে বিশ্বকাপ খেলতে। মাঝখানে পার হয়ে গেছে বিশ বছর। বাঙালির ক্রিকেট মহলেও কিছু সাফল্য জমা হয়েছে। আছে কিছু যন্ত্রনাও। ক্রিকেট বিশ্বে অনেক বিবর্তন হয়েছে। তারপরও বিশ্বকাপ তো ওয়ানডে খেলাই। যেখানে ক্রিকেট স্কিলের সবোর্চ্চ পরীক্ষা হয় না। তারপরও বিশ্বকাপে একটা চাপ সব সময় থাকে।

সেটা সামাল দেয়াই বড় ক্রিকেটারদের কাজ। তেমন বড় কিছু ক্রিকেটার এবারের বাংলাদেশ দলে আছেন। সঙ্গে আছেন কিছু তরুণ। যারা নিজেদের প্রমাণের তাগিদটা অনুভব করছেন। বাংলাদেশ কাপ জিতুক, সেটা হয়তো সবাই চাইবেন। চাইছেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে বিশ্বকাপের আগুনের মধ্যে দিয়ে কাপ নিয়ে অক্ষত অবস্থায় বেরিয়ে আসার মত দল কি বাংলাদেশ?

ক্রিকেট পন্ডিতরা বলবেন- না। হয়তো তাই। তারপরও বাংলাদেশ অঘটন ঘটাতে পারে। সেটা অন্য একটা কারণে। এই দলে বেশ কয়েকজন ক্রিকেটার আছেন, যারা ক্রিকেট বিশ্বে নিজেদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করতে চাইবেন। প্রমাণ করতে চাইবেন নিজেদের দক্ষতা।

বিশ্বকাপ সে তো ক্রিকেটেরও বড় বাজার। সেখানে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারলে, নিজের মর্যাদা বাড়িয়ে নেয়া যায়। তা ভাল করেই জানেন তারা। বিশ্বকাপ শুধু ক্রিকেটীয় দক্ষতার খেলা নয়। নিজেকে প্রমাণ করার জন্য দরকার হয় শক্ত মানসিকতা। মনের জোর। তার প্রমাণ গত বিশ্বকাপে বাংলাদেশের একজন রেখেছিলেন। ব্যাক টু ব্যাক সেঞ্চুরি করেছিলেন অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডে। তাও ইংল্যান্ড আর নিউজিল্যান্ডের মত দলের বিপক্ষে। সত্যিই অসাধারণ ব্যাট করেছিলেন মাহমুদউল্ল্যাহ গত বিশ্বকাপে।

অসাধারণ- শব্দটার উল্টোপাল্টা ব্যবহার হয়েছে অনেক। বহু ব্যবহারে শব্দটাই যেন ক্লিশে হয়ে গেছে। তবু লিখছি; ‘অসাধান’-র চেয়ে আর কোন উপযুক্ত শব্দ কি খুঁজে পাবেন অধিনায়ক মাশরাফি সম্পর্কে? কত ইনজুরির যন্ত্রনা সইতে সইতে দেড় যুগের ক্যারিয়ার বইয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি! এটা তার শেষ বিশ্বকাপ।

সেই পটভুমিতে ইংল্যান্ড বিশ্বকাপকে স্মরণীয় করে রাখুক বাংলাদেশ। তার জন্য কাপ জয়ের দরকার নেই। ইংল্যান্ডে বাংলাদেশ উচিয়ে ধরুক ক্রিকেট আর্দশের জ্বলন্ত মশালটা। যার আলোয় আলোকিত হবে ক্রিকেট বিশ্ব। আর সেই আলোয় বাংলাদেশের ক্রিকেটীয় অবয়বটা আরো স্পষ্ট দেখতে পাবে বাকি বিশ্ব।

লেখক: সিনিয়র জার্নালিস্ট ও কলাম লেখক।