ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে শুক্রবার স্থানীয় সময় রাত ১১টায় (বাংলাদেশ সময় ভোর ৫টা) যুক্তরাজ্যের বিচ্ছেদ কার্যকর হচ্ছে। গণভোটে ব্রেক্সিটের পক্ষে রায়ের সাড়ে তিন বছরে তিনটি নির্বাচন, দুজন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ এবং ব্যাপক রাজনৈতিক বাকবিতণ্ডার পর অবশেষে এক কোটি ৭৪ লাখ ব্রিটিশের ইচ্ছা পূরণ হতে যাচ্ছে।
ব্রিটিশদের প্রত্যাশা পূরণ হতে চললেও এ নাটকের অবসান এখনই হচ্ছে না। আজ একটা পৃষ্ঠা ওল্টানো হলেও অপর পাতায় আশঙ্কাজনক কিছু বিষয় রয়েই যাচ্ছে। আজ থেকে ব্রেক্সিট কার্যকর হলেও রূপান্তরকাল ধরা হয়েছে চলতি বছরের শেষ পর্যন্ত। এ সময়ের মধ্যে ঠিক করা হবে ভবিষ্যতে যুক্তরাজ্যের সঙ্গে ইইউ-এর সম্পর্ক কেমন হবে।
এতদিন তো এক ছাতার নিচে ছিল বিশ্বের সবচেয়ে বড় আঞ্চলিক জোট ইউরোপীয় ইউনিয়ন। কিন্তু যুক্তরাজ্যের বিদায়ের মধ্য দিয়ে প্রথমবারের মতো জোটটিতে ভাঙনের ঘটনা ঘটল। কিন্তু যুক্তরাজ্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে গেলে কী কী পরিবর্তন ঘটবে, সেই প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। এখানে সে সম্পর্কে কিছু বিষয় তুলে ধরা হলো।
ফেব্রুয়ারির ১ তারিখ যা ঘটবে
আপাতত ফেব্রুয়ারির ১ তারিখ থেকে বেশিকিছু পরিবর্তন হচ্ছে না। কারণ এ বছরের শেষদিন অর্থাৎ ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলবে রূপান্তরকাল। যুক্তরাজ্য ইইউ-এর রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান থেকে বাদ পড়লেও আগামী ১১ মাস দেশটিতে ইইউ-এর আইন মেনে চলতে হবে। ঠিক আগের মতো করেই।
ব্রিটিশ ও ইউরোপীয়ান নাগরিকরা আগের মতোই মুক্তভাবে চলাচল করতে পারবেন। তারা নিজ নিজ দেশে যেমনভাবে এতদিন বসবাস করতেন তেমনই থাকবেন। কিন্তু চুক্তি অনুযায়ী, যখন বিচ্ছেদ চূড়ান্তভাবে কার্যকর হবে তখন আর ব্রিটিশ নাগরিকরা ইইউভুক্ত দেশগুলোতে মুক্তভাবে চলাচল করতে পারবেন না।
যুক্তরাজ্যে বসবাসরত ইইউ নাগরিকদের এখনই যুক্তরাজ্যের ইউরোপীয় ইউনিয়ন সেটেলমেন্ট স্কিমের জন্য আবেদন করার অনুরোধ করা হচ্ছে, তবে তারা চুক্তির সময়সীমা অবধি অপেক্ষা করতে পারবেন। চুক্তি হলে এ সময়সীমা হবে ২০২১ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত। যদি চুক্তি ছাড়াই ব্রেক্সিট কার্যকর হয় তাহলে সময়সীমা হবে ২০২০ সালের ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত।
যুক্তরাজ্য ও ইইউ–এর মধ্যে কী বাণিজ্য চুক্তি হবে
দুই পক্ষের মধ্যে বাণিজ্য চুক্তি হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও তা নিশ্চিত নয়। নিজেদের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার ইইউ-এর সঙ্গে একটি বিস্তারিত বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদন ব্রিটিশ সরকারের চূড়ান্ত লক্ষ্য। কিন্তু এমন কোনো চুক্তির বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানো কোনো সহজ বিষয় নয়, বিশেষ করে মাত্র ১১ মাস সময়ের মধ্যে তা আরও কঠিন।
আলোচনা শুরুর আগেই উভয় পক্ষ কোন কোন বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে চায় তা প্রকাশ করতে হবে। জোট নেতৃত্বের কাছ থেকে আনুষ্ঠানিক সমর্থনও পেতে হবে। ফেব্রুয়ারি শেষ হওয়ার আগে এটার সম্ভাবনা কম।
এ মুহূর্তে আন্তরিকভাবে উভয় পক্ষ সম্মত হলেই আলোচনা শুরু হতে পারে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, এ আলোচনা শুরু হতে পারে আগামী মার্চের প্রথম দিকে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন অটোয়ার সঙ্গে ইইউ-এর সম্পর্কের মডেল ‘কানাডা স্টাইল’ অনুযায়ী একটি চুক্তি করতে চাচ্ছেন।
কানাডার সঙ্গে ইউরোপের ‘দ্য কমপ্রিহেনসিভ ইকোনমিক অ্যান্ড ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট’ (সিইটিএ) চুক্তির মাধ্যমে বাণিজ্যিক পণ্যের ৯৮ শতাংশের ওপর কোনো করারোপ করা হয় না, তবে পণ্যের আকারের ওপর কিছু বিধিনিষেধ রয়েছে। প্রস্তাবিত ইইউ-যুক্তরাজ্য চুক্তির চেয়ে কম উচ্চাকাঙ্ক্ষী ওই চুক্তি চূড়ান্ত হতে সাত বছর সময় লেগেছিল।
যদি দুই পক্ষ কোনো চুক্তিতে সম্মত হতে না পারে তাহলে চুক্তিবিহীনভাবে ব্রেক্সিট কার্যকর হবে। তার মানে দাঁড়াবে, অন্য দেশের মতো নিয়ন্ত্রণের বাঁধা, শুল্ক ও কোটার মতো বিষয়গুলো তখন সামনে চলে আসবে। ফলে যুক্তরাজ্যের সঙ্গে ইইউ-এর বাণিজ্য সম্পর্ক নিয়ে নানা অনিশ্চয়তা তৈরি হবে।
অভিবাসনের ওপর যুক্তরাজ্যের কি পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে
৩১ জানুয়ারি থেকে মাইগ্রেশন বিষয়ে কিছু পরিবর্তন আসবে। ব্রেক্সিট কার্যকরে যে রূপান্তরকাল ধরা হয়েছে এ সময়ে যুক্তরাজ্যকে ইইউ নাগরিকদের জন্য নিজেদের সীমান্ত উন্মুক্ত রাখতে হবে। পরিস্থিতি ঠিক আগের মতোই থাকবে। পাসপোর্ট কিংবা ভিসা সংক্রান্ত কোনো জটিলতা তৈরি না করে চলাচলের পূর্ণ স্বাধীনতা থাকবে।
কিন্তু ব্রেক্সিট আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যকর হওয়ার পর যুক্তরাজ্যে গমনাগমনের সংখ্যা অনেকটা কমে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। লন্ডনভিত্তিক অভিবাসন বিষয়ক আইনজীবী এমনটা জানিয়ে বলেছেন, অনিশ্চয়তাসহ নানা কারণে সামনের বছরগুলোতে ইইউ নাগরিকদের চলাচল উল্লেখযোগ্য হারে কমে যাবে। কারণ ইইউ সেটেলমেন্ট স্কিম সম্পর্কে তাদের বেশ সচেতনতার অভাব রয়েছে।
২০০৩ সালের পর গত বছর ইউরোপের মাইগ্রেশন সংখ্যা ছিল সর্বনিম্ন। গত বছর ৫০ হাজারেরও কম ইইউ নাগরিক যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমিয়েছেন। ২০১৬ সালে যখন ব্রেক্সিট প্রশ্নে গণভোট হয় তখন এ সংখ্যা ছিল দুই লাখ। এ ঘাটতি যুক্তরাজ্যের শিল্প খাতের জন্য উদ্বেগের একটি বিষয়।
যুক্তরাজ্য কি ইইউ আইন মানতে বাধ্য থাকবে
২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত যুক্তরাজ্যকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের আইন-কানুন মেনে চলতে হবে। উদাহরণ হিসেবে কর্মসংস্থান বিধিমালা, ভোক্তার মান ও প্রতিযোগিতা আইন ইত্যাদি।
ইইউ আইনের আওতায়, ইউরোপীয়ান কোর্ট অব জাস্টিস তার কাজ চালিয়ে যাবে। যদি নতুন কোনো আইন তৈরি হয় তা নিয়েও আপত্তি তুলতে পারবে না যুক্তরাজ্য। এ সময়ে ব্রাসেলস দ্বারা পরিচালিত আইনগুলো লন্ডন প্রত্যক্ষ করবে। তবে তা স্বল্পমেয়াদে, কিছু ক্ষেত্রে তা বছরের পর বছর নয়।
প্রধানমন্ত্রী জনসন খুব জোর গলায় বলেছেন, রূপান্তরকাল শেষ হয়ে গেলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন যুক্তরাজ্যের ওপর আর কোনোরকম কর্তৃত্ব খাটাতে পারবে না। কিন্তু ইউরোপীয়ান আইন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মাইকেল ডগান বলছেন, প্রধানমন্ত্রীর বিচ্ছেদ চুক্তি যুক্তরাজ্যের কিছু নীতিনির্ধারণী ক্ষেত্রে ইইউ-এর তদারকির বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে।
নর্দান আয়ারল্যান্ড নিয়ে কী ঘটবে
শনিবার অর্থাৎ ১ ফেব্রুয়ারি সকাল থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে ৩০০ মাইলের একটি সীমান্ত ভাগাভাগি শুরু করবে যুক্তরাজ্য। এ সীমানা রয়েছে স্বাধীন দেশ আয়ারল্যান্ড ও যুক্তরাজ্যের অংশ নর্দান আয়ারল্যান্ডের মধ্যে। রূপান্তরকালীন এ সীমানা উন্মুক্ত থাকবে এবং অবাধে মানুষ চলাচল করবে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের উন্মুক্ত সীমান্তনীতির কারণে এতদিন এ সীমান্ত বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। কিন্তু যুক্তরাজ্য ইইউ থেকে বের হয়ে যাওয়ার কারণে বন্ধ করে দেয়া হবে নর্দান আয়ারল্যান্ড সীমান্ত। সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে ও ডেভিড ক্যামেরুন ব্রেক্সিটের পর এ ‘ব্যাক স্টপ’ ব্যবস্থা নির্ধারণ নিয়ে বিপদে পড়েছিলেন।
আজ ব্রেক্সিট আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যকর হলেই যুক্তরাজ্য ও ইইউ প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত একটি বিশেষ কমিটি এ সীমান্ত ব্যবস্থাপনা নিয়ে আলোচনা শুরু করবেন। সীমান্তে কড়াকড়ি আরোপ করা হবে- এমন সিদ্ধান্তে নাকি দুই পক্ষই একমত হয়েছেন। তবে শেষ পর্যন্ত বিতর্কিত এ সীমানা নিয়ে কী সিদ্ধান্ত হয় তা সময়ই বলে দেবে।