এক নজরে ওমরার ধারাবাহিক কাজ


হজ ও ওমরা সম্পাদনের ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘোষণা করেছেন, ‘তোমরা তোমাদের হজের পদ্ধতি আমার কাছ থেকে গ্রহণ কর।’ তাই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে পদ্ধতিতে ওমরাহ সম্পাদন করেছেন, সেভাবে ওমরাহ সম্পাদন করাই আমাদের একান্ত কাজ।

অনেক মানুষ অর্থ খরচ করে শারীরিক কষ্ট সহ্য করে ওমরাহ পালন করে কিন্তু সঠিক নিয়ম-কানুন না জানার কারণে তা যথাযথভাবে সম্পাদন হচ্ছে না। তাই এক নজরে ওমরাহর কাজগুলো জেনে নেয়া জরুরি।

হজ ও ওমরার মাধ্যমে কয়েকটি দিন বা কিছু সময় ব্যয় করার মাধ্যমে জান্নাত লাভ করা যায। হাদিসে পাকে হজ ও ওমরাহ ফজিলত এভাবেই বর্ণনা করা হয়েছে।

হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য হজ (ওমরাহ) করল এবং স্ত্রী সহবাস, যাবতীয় অশ্লীল কাজ ও গালমন্দ থেকে বিরত থাকল; সে ওই দিনের মতো হয়ে ফিরে আসল, যেদিন তার মা তাকে ভূমিষ্ঠ করেছিল।’ (বুখারি, মুসলিম, মিশকাত)

হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘এক ওমরাহ থেকে আরেক ওমরাহর মধ্যবর্তী সময়ের ছোট গোনাহসমূহের কাফফারা স্বরূপ। আর মাবরুর (কবুল) হজের বিনিময় জান্নাত ছাড়া কিছুই নয়।’ (বুখারি, মুসলিম, মিশকাত)

এ কারণেই হজ ও ওমরাহর ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে দিক-নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। হাদিসে এসেছে-

হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘তোমরা হজ ও ওমরাহর ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখ। কারণ এ দুটি দারিদ্র্যতা ও গোনাহ উভয়ই দূর করে দেয়, যেমন হাপর লোহা ও সোনা-রূপার ময়লা দূর করে দেয়। আর মাবরূর (কবুল) হজের বিনিময় জান্নাত ছাড়া কিছুই নয়।’ (তিরমিজি, ইবনে খুজায়মা, নাসাঈ)

ওমরা পালনের নিয়ম
ওমরাহ পালনে মোট ফরজ কাজ ৩টি। যার কোনোটি ছেড়ে দিলে ওমরাহ সম্পাদন হবে না। আর তাহলো-
>> ইহরাম বাধা
ওমরার জন্য ইহরাম বাধা ফরজ। তাই নির্ধারিত মিকাত থেকে পুরুষরা সেলাইবিহীন দুটি কাপড় পরে ইহরামের নিয়ত করা। আর নারীরা শালিন পোশাক পরবে। ইহরামের নিয়ত করার পর ইহরাম ভেঙে যাবে এমন কোনো কাজ না করা। বাংলাদেশ থেকে যারা সরাসরি পবিত্র নগরী মক্কায় যায়, তারা দেশ থেকেই ইহরাম বেধে নেয়।

>> তাওয়াফ করা
ওমরাহর জন্য তাওয়াফ করা ফরজ। তাওয়াফে পুরুষরা ইজতিবা ও রমল করবে। নারীদের জন্য ইজতিবা ও রমল নেই। ইজতিবা ও রমল হলো-

– ইজতিবা
পুরুষ তাওয়াফকারীদের জন্য ইজতিবা সুন্নাতের অন্তর্ভুক্ত। মহিলাদের জন্য কেনো ইজতিবা নেই। আর ইজতিবা হলো তাওয়াফের সময় পুরুষরা গায়ের চাদরকে ডান বগলের নিচে দিয়ে চাদরের উভয় মাথাকে বাম কাঁধের ওপর দিয়ে সামনে এবং পেছনে ফেলে রাখা। হাদসে এসেছে-

– রমল
পুরুষ তাওয়াফকারীদের জন্য রমল করা সুন্নাতের অন্তর্ভুক্ত। আর রমল হলো- ফরজ তাওয়াফের সময় প্রথম তিন চক্কর বীরদর্পে দুই কাঁধ ও শরীর হেলিয়ে-দুলিয়ে ঘন ঘন পায়ে দ্রুত চলা।

ইজতিবা ও রমল সম্পর্কে হাদিসে এসেছে-
হজরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে এবং তার সাহাবাগণ ইজতিবা করেছেন এবং তিন চক্কর রমল করেছেন।

অন্য হাদিসে এসেছে-
‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন প্রথম তাওয়াফ করতেন তখন প্রথম তিন চক্করে দ্রুত চলতেন। আর বাকি চার চক্করে সাধারণভাবে চলতেন।’ (বুখারি ও মুসলিম)

>> সাফা-মারওয়া সাঈ করা
তাওয়াফের পর সাফা ও মারা ওয়া পাহাড়ের মাঝে ৭ বার সাঈ করা ফরজ। সাঈ করার মাধ্যমে ওমরার কাজ সম্পন্ন হবে। সাফা থেকে সাঈ শুরু হবে আর মারওয়ায় গিয়ে সাঈ শেষ হবে।

আর ওমরাহ পালনে রয়েছে ২টি ওয়াজিব বা আবশ্যক কাজ। ওয়াজিব তরক হলে ওমরাহকারীকে দম দিতে হবে। আর ওয়াজিব ২টি হলো-
>> নির্ধারিত মিকাত থেকে ইহরাম বাধা।
বাংলাদেশি ওমরাহকারীরা বিমানেই মিকাত অতিক্রম করে বিধায় তারা বাংলাদেশ থেকেই ইহরাম বেধে যায়।
>> মাথা মুণ্ডন বা চুল কাটা
সাফা-মারওয়া সাঈ করার পর পুরুষরা পুরো মাথার চুল ছোট বা মুণ্ডন করার মাধ্যমে ইহরাম থেকে বের হবে। আর নারীরা চুলের আগা কাটার মাধ্যমে ইহরাম থেকে বের হবে। মাথার চুল মুণ্ডন কিংবা চুলের আগা কেটে ইহরাম থেকে বের হওয়া ওয়াজিব।

এক নজরে ওমরাহ হলো-
>> ইহরাম বাধা। (ফরজ)
ইহরামের জন্য গোসল ও ওজু করে ইহরামের পোষাক সেলাইবিহীন ২ কাপড় পরা।
>> ইহরামের নিয়ত করা- ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা ওমরাতান’।
>> অতঃপর এ দোয়া পড়া-
اَللَّهُمَّ اِنِّي اُرِيْدُ (العُمْرَةَ – الْحَجَّ) فَيَسِّرْهُ لِيْ وَ تَقَبَّلْهُ مِنِّي
উচ্চারণ : ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি উরিদুল উমরাতা/হাজ্জা ফাইয়াসসিরহু লি ওয়া তাকাব্বালহু মিন্নি’
অর্থ : হে আল্লাহ! আমি ওমরার/হজের ইচ্ছা করছি; আপনি আমার জন্য তা সহজ করে দিন এবং আমার পক্ষ থেকে তা কবুল করুন।’
>> তালবিয়া পড়া। পুরো তালবিয়াকে ৪ ভাগে (নিশ্বাসে) ৩ বার পাঠ করা-
لَبَّيْكَ اَللّهُمَّ لَبَّيْكَ
لَبَّيْكَ لاَ شَرِيْكَ لَكَ لَبَّيْكَ
اِنَّ الْحَمْدَ وَالنِّعْمَةَ لَكَ وَالْمُلْكَ
لاَ شَرِيْكَ لَكَ

তালবিয়ার উচ্চারণ
> লাব্বাইকা আল্লা-হুম্মা লাব্বাইক,
> লাব্বাইকা লা শারিকা লাকা লাব্বাইক,
> ইন্নাল হামদা ওয়ান্‌নিমাতা লাকা ওয়ালমুল্‌ক,
> লা শারিকা লাক।

>> মসজিদে হারামে প্রবেশ।
মসজিদে হারামের বাবুস সালাম গেট তথা উঁচু স্থান দিয়ে প্রবেশ করাই উত্তম। মসজিদে হারামে প্রবেশ করার সময় ডান দিয়ে এ দোয়া পড়া-
أَعُوْذُ بِاللهِ الْعَظِيْمِ وَ بِوَجْهِهِ الْكَرِيْمِ وَ بِسُلْطَانِهِ الْقَدِيْمِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيْمِ
উচ্চারণ : আউজু বিল্লাহিল আজিম, ওয়া বি-ওয়াঝহিহিল কারিম, ওয়া বি-সুলত্বানিহিল কাদিমি মিনাশ শায়ত্বানির রাঝিম। আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা মুহাম্মাদিও ওয়া সাল্লিম, আল্লাহুম্মাফতাহলি আবওয়াবা রাহমাতিকা।

>> কাবা শরিফ দেখার সঙ্গে সঙ্গে দুই হাত উঁচু করে বলবে-
اَللهُ اَكْبَر – ‘আল্লাহু আকবার’

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দু’হাত আকাশের দিকে ওঠিয়ে এভাবে দোয়া করতেন-
اَللهُمَّ زِدْ هَذَا الْبَيْتَ تَعْظِيْمًا وَ تَشْرِيْفًا وَ تَكْرِيْمًا وَ مَهَابَةً
وَ زِدْ مَنْ شَرَّفَهُ وَ كَرَّمَهُ مِمَّنْ حَجَّهُ اَوِ اعْتُمَرَهُ
تَشْرِيْفًا وَ تَكْرِيْمًا وَ تَعْظِيْمًا وَ بِرًّا
اَللهُمَّ اَنْتَ السَّلَامُ وَ مِنْكَ السَّلَامُ حَيِّنَا رَبَّنَا بِالسَّلَامِ
উচ্চারণ : আল্লাহুম্মা যিদ হাজাল বাইতা তা’জিমান ওয়া তাশরিফান ওয়া তাকরিমান ওয়া মাহাবাতান;
ওয়া যিদ মান শাররাফাহু, ওয়া কাররামাহু মিম্মান হাজ্জাহু আওয়ি’তামারাহু
তাশরিফান ওয়া তাকরিমান ওয়া তাজিমান ওয়া বিররান;
আল্লাহুম্মা আংতাস সালাম ওয়া মিনকাস সালাম হাইয়্যিনা রাব্বানা বিসসালাম।’

>> কাবা শরিফ তাওয়াফ। (ফরজ)

হাজরে আসওয়াদ থেকে তা স্পর্শ করে সম্ভব না হলে ইশারা করে এ দোয়া পড়ে কাবা শরিফ তাওয়াফ শুরু করা-
بِسْمِ اللهِ اَللهُ اَكْبَر – اَللَّهُمَّ اِيْمَنًا بِكَ و بصديقًا بِكِتَابِكَ وَرَفَعًا بِعَهْدِكَ وَ اِتِّبَعًا لِسُنَّةِ نَبِيِّكَ
উচ্চারণ : বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার; আল্লাহুম্মা ইমানান বিকা ওয়া তাসদিকান বিকাতাবিকা ওয়া রাফাআন বিআহদিকা ওয়া ইত্তিবাআন লিসুন্নাতি নাবিয়্যিকা।’
তাওয়াফের সময় সম্ভব হলে রোকনে ইয়ামেনিও স্পর্শ করা। সম্ভব না হলে দূর থেকে দু’হাতে ইশারা করা। অতঃপর রোকনে ইয়ামেনি থেকে হাজরে আসওয়াদ পর্যন্ত প্রান্তে এ দোয়া পড়া-
رَبَّنَا اَتِنَا فِى الدُّنْيَا حَسَنَةً وَّ فِى الْاَخِرَةِ حَسَنَةً وَقِنَا عَذَابَ النَّارِ
উচ্চারণ : রাব্বানা আতিনা ফিদদুনিয়া হাসানাতাও ওয়া ফিল আখিরাতি হাসানাতাও ওয়াক্বিনা আজাবান্ নার।’

এভাবে এক চক্বর সম্পন্ন হবে। আর ৭ চক্করে সম্পন্ন হবে তাওয়াফ।

>> মাকামে ইবরাহিমে নামাজ (সুন্নাত)
তাওয়াফ সম্পন্ন হলে মাকাকে ইবরাহিমে ২ রাকআত নামাজ আদায় করা।

>> জমজমের পানি পান
হজ ও ওমরা পালনকারীরা যখন পবিত্র কাবা শরিফ তাওয়াফ সম্পন্ন করবে তখন তারা মাকামে ইবরাহিমে ২ রাকাআত নামাজ পড়বে। তারপরই পান করবে জমেজমের এ বরকতময় পানি। হাদিসে এসেছে-

– রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘তাওয়াফ শেষে ২ রাকাআত নামাজ আদায় করে মাতআফ (তাওয়াফের স্থান) থেকে বেরিয়ে পাশেই জমজম কূপ এলাকায় প্রবেশ করবে এবং সেখানে বিসমিল্লাহ বলে দাঁড়িয়ে জমজমের পানি পান করবে। আর (হাতের কোষে নিয়ে) কিছু পানি মাথায় দেবে।’ (বুখারি-মুসলিম, মিশকাত ও মুসনাদে আহমদ)

– রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘ভূপৃষ্ঠের মধ্যে সেরা পানি হলো- জমজমের পানি। এর মধ্যে রয়েছে পুষ্টিকর খাদ্য (উপাদান) এবং রোগ হতে আরোগ্য (লাভের উপাদান)।’ (তাবারানি)

– অন্য হাদিসে প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘নিশ্চয় এটি বরকতময় (পানি)।’ মুসনাদে আহমাদ, মুসলিম)
>> সাফা-মারওয়া সাঈ করা (ফরজ)
সুন্নাত তরিকায় সাঈ সম্পন্ন করতে ‘বাবুস সাফা’ দিয়ে সাফা পাহাড়ের ওপরে উঠতে হবে। সাফা পাহাড়ে উঠে কাবার দিকে মুখ করে উভয় হাত কাঁধ পর্যন্ত তুলে পড়বে-
‘আবদাউ বিমা বাদাআল্লাহু বিহি ইন্নাস সাফা ওয়াল মারওয়াতা মিন শাআইরিল্লাহি’

অঃপর তিনবার হামদ ও ছানা পাঠ করা। তারপর উচ্চস্বরে তাকবির ও তাহলিল (আল্লাহু আকবার ও লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু) পাঠ করা। তারপর দুরুদ পাঠ করা। তারপর নিজের প্রয়োজনীয় দোয়া করা। অতঃপর সাফা পাহাড় থেকে মারওয়া পাহাড়ের দিকে চলতে শুরু করা
সাফা পাহাড় থেকে মারাওয়ার দিকে যেতেই সবুজ বাতি চিহ্নিত স্থান। সে স্থানটি পুরুষরা দৌড়ে আর নারীরা স্বাভাবিকভাবেই হাটবে। সে সময় এ দোয়া পড়া-
‘রাব্বিগফির ওয়ারহাম আনতাল আআ’যযু ওয়াল আকরাম।’

মারওয়া পাহাড়ে গিয়ে হামদ ছানা, দরূদ ও দোয়া করে পুনরায় সাফা পাহাড়ের দিকে রওয়ানা করবে। এভাবে সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের মধ্যে ৭ বার সাঈ করতে হবে।

>> মাথা মুণ্ডন বা চুল কাটা (ওয়াজিব)
সাফা-মারওয়া সাঈ করার পর পুরুষরা মাথার চুল ছোট বা মুণ্ডন করবে আর নারীরা চুলের আগা কেটে ইহরাম থেকে বের হবে।

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে যথাযথভাবে ওমরাহ সম্পাদন করার তাওফিক দান করুন। আমিন।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *