ওয়ালশ-রফিককে অনুসরণ না করে এ কি ঘটনা ঘটালেন অশ্বিন?


ক্রীড়া ডেস্ক :: এ কি করলেন রবিচন্দ্রন অশ্বিন? ক্রিকেট যে শুধু খেলাই নয়, ভব্যতা-সৌজন্যতা ও শিষ্টাচারেরও অনুপম ক্ষেত্র! ম্যাচ জয়ের নেশায় তা কি বেমালুম ভুলে গেছেন ভারতের এ নামি ক্রিকেটার? ম্যাচ জিততে এক অখেলোয়াড়সুলভ ঘটনার জন্ম দিয়ে দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য ও রীতির ব্যত্যয় ঘটিয়ে ফেললেন কিংস ইলেভেন পাঞ্জাবের এ অফস্পিনার।

গতকাল (সোমবার) ২৫ মার্চ সোমবার রাতে জয়পুরে রাজস্থান রয়্যালসের বিপক্ষে অশ্বিন যা করলেন, তা কিন্তু ক্রিকেটীয় নিয়ম-নীতির বাইরে নয়। ক্রিকেটে পরিষ্কার নিয়ম আছে, বোলার রানআপ শুরুর পর যদি দেখে ননস্ট্রাইক প্রান্তে থাকা ব্যাটসম্যান সিঙ্গেলস বা এক রানের জন্য আগেই পপিং ক্রিজ (বোলিং প্রান্তে সাদা দাগের ভিতরের নির্ধারিত জায়গা) ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে যান, তখন বোলার ডেলিভারি না দিয়ে, মানে বল না ছুঁড়ে বেলস তুলে নিলে কিংবা বল দিয়ে উইকেট ভেঙে ফেললে ওই নন স্ট্রাইক এন্ডে থাকা ব্যাটসম্যান রান আউট হবেন। ক্রিকেট ব্যাকরণ তথা ক্রিকেট অভিধান-সংস্কৃতিতে যাকে বলা হয় ‘ম্যানকাড’।

এমন নয় ক্রিকেটে এ ধরনের ‘ম্যানকাড’ আউটের নজির নেই। কিংবা ক্রিকেটে কখনো কেউ এভাবে আউট হননি বা কোন বোলার এমন করে কাউকে আউট করেননি। পাড়া কিংবা গলির ক্রিকেটে হরহামেশাই হয় এমন ঘটনা। আর জাতীয় পর্যায়ের ক্রিকেটে এমনকি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও এক সময় ম্যাচ জিততে মরিয়া কোনো কোনো বোলার এভাবে প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানকে আউট করার ঘটনা রয়েছে।

কিন্তু বেশ কিছুদিন ধরে, বিশেষ করে ১৯৮৭ সালের বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও পাকিস্তানের সেমিফাইনাল নির্ধারনী ম্যাচের পর থেকে গত প্রায় তিন যুগে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এমন ঘটনা ঘটেনি বললেই চলে।

আজকাল আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তো নয়ই, কোন প্রথম শ্রেণি, লিস্ট ‘এ’ এমনকি পাড়া-গলির ক্রিকেটেও এভাবে কেউ কাউকে আউট করেন না। যেমন করেন না হ্যান্ডলড দ্য বলের আবেদনও। ক্রিকেটে নিয়ম আছে, বল ডেড হবার আগে ব্যাটসম্যান বল ধরে ফেললে ফিল্ডাররা আবেদন করলে, আউট। সেটা ‘হ্যান্ডলড দ্য বলের’ আওতায় পড়ে যায়।

অর্থাৎ, ক্রিকেটে যত রকমের আউট আছে, ম্যানকাডের মত সেটাও এক রকম আউট। বল ডেড হওয়ার আগে, মানে কোন ফিল্ডারের হাতে যাবার আগে মাটিতে পড়ে থাকা অবস্থায় ব্যাটসম্যান তা হাতে ধরে কোন ফিল্ডারের হাতে জমা দিলে ফিল্ডার আবেদন করলে আউট বলে গণ্য হতেন, হবেনও।

তবে এখন আর কেউ তা করেন না। আজকাল হরহামেশা দেখা যায় উইকেটরক্ষক উইকেটের অন্তত ১২-১৪ গজ দুরে গ্লাভস হাতে দাঁড়িয়ে স্লিপ, গালি কিংবা কাছাকাছি বা ক্লোজ ইন ফিল্ডিং পজিশনে কেউ নেই। ব্যাটসম্যান তখন ডিফেন্স করা বল মাটি থেকে তুলে ফিল্ডারের কাছে অহরহ তুলে দিচ্ছেন। কেউ আর ‘হাউ ওয়াজ দ্যাট’ বলে আবেদন করছেন না। এটা নিয়মের মধ্যে থেকেও এখন অলিখিত নিয়মে পরিণত হয়েছে।

সেখানে ম্যানকাডে কাউকে আউট! রীতিমত দূর্লভ ঘটনা বলেই পরিগণিত। অথচ সোমবার আইপিএলে তাই করেছেন অশ্বিনের মত নামি ও নন্দিত ক্রিকেটার। বলার অপেক্ষা রাখে না, ক্লোজ ম্যাচ জিততেই এ কাজটি করেছেন কিংস অব পাঞ্জাব অধিনায়ক অশ্বিন।

অথচ ইতিহাস জানাচ্ছে এর আগে গত ৩২ বছরে অন্তত দু’ দু’বার এমন পরিস্থিতিতে প্রতিপক্ষ নন স্ট্রাইক এন্ডে থাকা ব্যাটসম্যানকে আউট না করে উল্টো নন্দিত ও প্রশংসিত হয়েছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের কোর্টনি ওয়ালশ এবং বাংলাদেশের মোহাম্মদ রফিক।

প্রথমটা ছিল ১৯৮৭ সালের ১৬ অক্টোবরের ঘটনা। লাহোরের গাদ্দাফি স্টেডিয়ামে পাকিস্তানের বিপক্ষে বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্বের গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে শেষ ওভারে গিয়ে হার মেনেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। শেষ ওভারে পাকিস্তানের দরকার ছিল ১৪ রানের। বোলার ছিলেন তখনকার ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ফাস্ট বোলার (বর্তমানে বাংলাদেশের পেস বোলিং কোচ) কোর্টনি ওয়ালশ। উইকেটে ছিলেন পাকিস্তানি লেগস্পিনার আব্দুল কাদির এবং ফাস্ট বোলার সেলিম জাফর।

শেষ ওভারে স্ট্রাইকে ছিলেন আব্দুল কাদির। নন স্ট্রাইকার ছিলেন সেলিম জাফর। একবার ওয়ালশ বল করার আগে দৌড় শুরুর পর দেখলেন সেলিম জাফর সিঙ্গেলসের জন্য ননস্ট্রাইক এন্ড বা ক্রিজ ছেড়ে দু’পা বেরিয়ে গেছেন। ওয়ালশ তাকে আউট করতে পারতেন; কিন্তু তা না করে উল্টো জাফরকে সতর্ক করে দেন, ‘শোন হে, আমি কিন্তু তোমাকে আউট করতে পারতাম। নিয়ম অনুযায়ী আমি বেলস তুলে নিলে বা উইকেট ভেঙে দিলে তুমি আউট। কিন্তু আমি তা করলাম না।’

সে ঘটনার পর ক্যারিবীয়দের টপকে বিশ্বকাপে সেমিফাইনালে পৌঁছে যায় পাকিস্তান। আর ১৯৭৫-১৯৭৯ সালের বিশ্বকাপ বিজয়ী এবং ১৯৮৩ সালের রানার্সআপ ওয়েস্ট ইন্ডিজ বিশ্বকাপের চতুর্থ আসরে এসে প্রথমবার বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল না খেলে বিদায় নেয়।

অথচ সেলিম জাফরকে আউট করলেই ক্যারিবীয়রা উল্টো পাকিস্তানকে পিছনে ফেলে চলে যেতে পারতো সেমিফাইনালে। কিন্তু ওয়ালশ তা করেননি। ওই ওভার তথা খেলার ১০০ নম্বর ওভারে ওয়ালশকে ছক্কা হাঁকিয়ে পাকিস্তানকে জিতিয়ে দেন কাদির। সেদিন পাকিস্তান ম্যাচ জিতলেও সারা জনমের জন্য সারা বিশ্বের ক্রিকেটপ্রেমীদের মন জয় করে নিয়েছিলেন ওয়ালস। যা ক্রিকেট ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় স্পোর্টসম্যানশিপের ঘটনা হয়ে আছে।

কেন ওয়ালশ কাদিরের সঙ্গী সেলিম জাফরকে সুযোগ পেয়েও এবং নিয়ম ও আইনের ভেতরে থেকেও আউট করেননি? দল বিশ্বকাপের মত মহা আসরের সেমিফাইনাল খেলবে, তা জেনে বুঝেও কেন সেদিন সেলিম জাফরকে ম্যানকাডের ফাঁদে ফেলেননি ওয়ালশ? তার কি মাথায় ছিল না, সেলিম জাফরকে আউট করা মানেই পাকিস্তান অলআউট, আমরা আবার সেমিফাইনালে? তারপরও কেন ওই ক্যারিবীয় সেদিন এমন ঘটনার জন্ম দেননি? তা না করে ওয়ালশ কি সমালোচিত বা নিন্দিত হয়েছিলেন?

নাহ! একটুও না। বরং ‘ভদ্রলোকের খেলা বা জেন্টলম্যান গেম’ ক্রিকেটে শেষ অবধি শিষ্টাচার, নম্রতা, ভদ্রতা যে জয় পরাজয়ের চেয়ে বড়, তার নজির দেখিয়ে বিশ্বের কোটি ক্রিকেট অনুরাগির অকুন্ঠ প্রশংসা কুড়িয়ে নিয়েছিলেন ওয়ালশ। ধন্য-ধন্য সাড়া পড়ে গিয়েছিল সর্বত্র। ওয়ালশ হয়েছিলেন দারুণভাবে নন্দিত এবং প্রশংসিত।

সেটাই শেষ নয়। ২০০৩ সালে মুলতান টেস্টে প্রায় একই ঘটনার জন্ম দিয়ে সবার মন জয় করেছিলেন বাংলাদেশের বাঁ-হাতি স্পিনার মোহাম্মদ রফিক। বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের তিন টেস্টের সিরিজে মুলতানে শেষ ম্যাচের শেষ ঘণ্টার ঘটনা। সময় কাল ২০০৩ সালের ৩ থেকে ৬ সেপ্টেম্বর।

ইনজামাম উল হকের পাকিস্তানের বিপক্ষে টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম জয়ের হাতছানি ছিল বাংলাদেশের সামনে। ম্যাচের একেবারে শেষ ইনিংসে পাকিস্তানের নবম উইকেট জুটিতে তখনকার পাকিস্তান অধিনায়ক ইনজামাম উল হকের সঙ্গী ছিলেন ফাস্ট বোলার উমর গুল।

পাকিস্তানের জয়ের নায়ক ও ওই সিরিজের অধিনায়ক ইনজামাজাম-উল হকের সঙ্গী ফাস্ট বোলার উমর গুলকে আউট করার দারুণ এক সুযোগ পেয়েও করেননি বাংলাদেশের বাঁ-হাতি স্পিনার মোহাম্মদ রফিক। ম্যাচের এক পর্যায়ে রফিকের কোন এক ওভারের শেষ বলে প্রান্ত বদলের জন্য ননস্ট্রাইকার উমর গুল বোলিংয়ের আগেই ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন।

রফিক তাকে আউট না করে মৌখিকভাবে সতর্ক করে দেন, ‘এই যে, তুমি কিন্তু ক্রিজের বাইরে। আমি ইচ্ছে করলে আউট করতে পারতাম; কিন্তু ভদ্রলোকের খেলা ক্রিকেটে এখন আর কেউ এভাবে কাউকে আউট করে না। তাই অমিও করলাম না।’

ইনজামামের সঙ্গে ৫২ রানের পার্টনারশিপে গুলের অবদান ছিল মোটে ৫ রান। ওই রান করার আগে একবার ‘ম্যানকাড’ আউটের হাত থেকে বেঁচে যান গুল। ননস্ট্রাইকার গুলকে আউট করার সযোগ পেয়েও করেননি বাঁ-হাতি স্পিনার রফিক। বলার অপেক্ষা রাখে না, শেষ পর্যন্ত ১ উইকেটের ন্যূনতম ব্যবধানে হার মানে বাংলাদেশ।

ওপরের ঘটনা দুটি পরিস্কার বলে দিচ্ছে, ওয়ালশ আর রফিক দল জেতানোর অভিপ্রায় থেকে প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানকে আউট করার সুযোগ পেয়েও ম্যানকাড করেননি। কারণ একটাই- বিষয়টা চোখে লাগে। দৃষ্টিকটু এবং ক্রিকেটীয় ভদ্রতা, ভব্যতা, সৌজন্যতা ও শিষ্টাচারের সাথে যায় না।

দুঃখজনক হলেও সত্য সোমবার রাতে রবিচন্দ্রন অশ্বিন সে দীর্ঘদিনের রীতি ও শিষ্টাচার ভেঙে দৃষ্টিকটুভাবে ইংলিশ ব্যাটসম্যান বাটলারকে আউট করলেন। আরও দুঃখজনক, তিনি খেলা শেষে নিজের করা কাজের পক্ষে সাফাইও গাইলেন। এছাড়াও কেউ কেউ এটাকে শিষ্টাচার এবং ক্রিকেটীয় রীতি ও সৌজন্যতার বরখেলাপের চেয়ে ক্রিকেটের নিয়মের অংশ বলে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টায় রত।

তাদের উদ্দেশ্যে একটাই কথা, বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল খেলা আর প্রথম টেস্ট জয়ের চেয়েও কি কালকের (আইপিএলে রাজস্থান রয়্যালসের বিপক্ষে) ম্যাচ জেতা বড় ঘটনা? বড় কৃতিত্ব বা অবিস্মরণীয় সাফল্য বলে গণ্য হবে? আর তা যদি না হবে, তাহলে কেন ৩২ বছর আগে ওয়ালশ আর ১৬ বছর আগে মোহাম্মদ রফিক ম্যানকাড করার সুযোগ পেয়েও তা কাজে লাগাননি?

আসলে ক্রিকেট ভদ্রলোকের খেলা। যেখানে জয় পরাজয় ছাপিয়ে ভদ্রতা, সৌজন্যতা আর শিষ্টাচার অনেক বড়। তবে কি এই ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ ক্রিকেটের প্রকৃত সৌন্দর্য্য আর গৌরব কেড়ে নিচ্ছে? রবিচন্দ্রন অশ্বিনের এ আচরণ ও ঘটনা কি বার্তা দিচ্ছে?

ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট তাহলে বিশ্বকাপ ও টেস্টে বাইরে অন্য রকম ক্রিকেট! যেখানে ক্রিকেটীয় আচার, আচরণ, রীতিনীতি, ভদ্রতা, সৌজন্যতা ও শিষ্টাচার ছাপিয়ে চার-ছক্কার অবাধ প্রদর্শনি, মারমার কাটকাট ক্রিকেট আর বিপণন-বাণিজ্য ও বিনোদনটাই বড়।

আর যে কোনোভাবে জেতাটাই মুখ্য? এরপর কি তাহলে বিগব্যাশ আর বাংলাদেশের বিপিএল, সিপিএল, পিএসএলসহ সব ফ্র্যাঞ্চাইজি আসরে এমন ঘটনা ঘটবে? যদি তাই ঘটে, তাহলে যে অচিরেই ক্রিকেট তার চিরায়ত সৌন্দর্য্য ও ঐতিহ্য হারাবে, তাতে সন্দেহ নেই।