করোনা ভাইরাস নিয়ে ভয়ের কারণ কী?


গত কয়েক দিন থেকেই বিশ্বজুড়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে রহস্যময় করোনা ভাইরাস। এতে আক্রান্ত হয়ে চীনের উহান শহরে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত অন্তত ১৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। ৫৪০ জনেরও বেশি মানুষ ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হয়েছে বলে জানা গেছে। যদিও প্রকৃত আক্রান্তের চেয়ে এ সংখ্যা অনেক কম বলে ধারণা বিশেষজ্ঞদের। এরই মধ্যে করোনা ভাইরাস ধরা পড়েছে আরও অন্তত সাতটি দেশে, যা বিশ্বজুড়ে উদ্বেগ ও শঙ্কা সৃষ্টি করেছে।

এখনো কোনো ওষুধ বা প্রতিষেধক আবিষ্কার না হওয়ায় এই ভাইরাস কি মহামারি আকার ধারণ করবে নাকি আরও বড় কোনো বিপদ অপেক্ষা করছে বিশ্ববাসীর সামনে, তা জানতে অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই।

করোনা ভাইরাস কী?
চীনা কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেছেন, দেশটিতে ১৭ জনের মৃত্যু হয়েছে করোনা ভাইরাসের কারণেই। তবে সব ভাইরাসই প্রাণঘাতি নয়। বিজ্ঞানীদের মতে, মাত্র ছয় ধরনের (নতুনটিসহ সাতটি) ভাইরাস মানুষকে রোগাক্রান্ত করতে পারে।

সিভিয়ার অ্যাকিউট রেসপিরেটরি সিন্ড্রোম বা সার্স এক ধরনের করোনা ভাইরাসের কারণেই হয়। ২০০২ সালে চীনে সার্সের প্রাদুর্ভাবে অন্তত ৮ হাজার ৯৮ জন আক্রান্ত হয়েছিলেন, এর মধ্যে প্রাণ হারান অন্তত ৭৭৪ জন।

করোনা ভাইরাস আক্রান্ত হওয়ার লক্ষণ কী?
এ ভাইরাসে আক্রান্ত হলে শুরুতে জ্বর ও শুষ্ক কাশি হতে পারে। এর সপ্তাহখানেক পর শ্বাসকষ্টও দেখা দেয়। অনেক সময় নিউমোনিয়াও হতে পারে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে রোগীর অবস্থা বেশি খারাপ হওয়ায় তাদের হাসপাতালে ভর্তি করা লাগে। তবে এসব লক্ষণ মূলত রোগীরা হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পরই জানা গেছে। সেক্ষেত্রে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার একদম প্রাথমিক লক্ষণ কী বা আদৌ তা বোঝা যায় কিনা তা এখনো অজানা।

তবে নতুন এ করোনা ভাইরাস যথেষ্ট বিপজ্জনক। সাধারণ ঠান্ডা-জ্বরের লক্ষণ থেকে এটি মৃত্যুর দুয়ার পর্যন্তও নিয়ে যেতে পারে।

করোনা ভাইরাস কতটা প্রাণঘাতি?
চীনে এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ১৭ জন মারা গেছেন, যা আক্রান্তের সংখ্যার মাত্র তিন শতাংশ। তবে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কেউ মারা যায় না, তারা বেশ কিছুদিন ভুগে তারপর প্রাণ হারান। সেক্ষেত্রে যেহেতু এখনো এর প্রতিষেধক আবিষ্কৃত হয়নি তাই ধরে নেয়া যায়, এর কারণে আগামী দিনগুলোতে আরও অনেক মানুষ মারা যাবে।

সবচেয়ে বড় কথা, করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার বেশিরভাগ ঘটনাই এখনো প্রকাশ্যে আসেনি বলে ধারণা বিশেষজ্ঞদের।

কোথা থেকে আসলো?
বিশ্বে প্রতিনিয়তই নতুন নতুন ভাইরাস আবিষ্কৃত হচ্ছে। তারা এক প্রজাতি থেকে অন্য প্রজাতিতে স্থানান্তরিত হয়, সেখান থেকে মানবদেহেও সংক্রমিত হতে পারে।

নটিংহ্যাম ইউনিভার্সিটির ভাইরোলজিস্ট প্রফেসর জোনাথন বল বলেন, যদি অতীতের প্রাদুর্ভাবগুলোর কথা চিন্তা করা যায় তাহলে দেখা যাবে, যখনই নতুন কোনো করোনা ভাইরাস পাওয়া গেছে, সেটি এসেছে কোনো প্রাণীর শরীর থেকে।

সার্স ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হয়েছিল বাদুরের শরীরে, সেখান থেকে খাটাশ বা বিড়াল, এরপর এসেছিল মানুষের মধ্যে। মিডল ইস্ট রেসপিরেটরি সিন্ড্রোম (মার্স) ছড়ানো শুরু হয়েছিল উট থেকে। ২০১২ সালে এই ভাইরাসে মারা যান ৮৫৮ জন, আক্রান্ত হয়েছিলেন অন্তত ২ হাজার ৪৯৪ জন।

কোন প্রাণী থেকে ছড়ায়?
যে প্রাণীর শরীরে বাসা বাঁধার পর ভাইরাস ছড়াচ্ছে তা নির্ণয় করা গেলে সমস্যার সমাধান অনেকটাই সহজ হয়ে যায়। নতুন করোনা ভাইরাসের ক্ষেত্রে এর উৎস হচ্ছে উহান শহরে সামুদ্রিক খাবারের পাইকারি বাজার। ধারণা করা হচ্ছে, বেলুগা তিমির মতো সমুদ্রগামী কিছু স্তন্যপায়ী প্রাণী এই ভাইরাস বয়ে এনেছে। তবে বাজারে অহরহ বিচরণ করা মুরগি, বাদুর, খরগোশ, সাপের মতো প্রাণীগুলোও সন্দেহের বাইরে নয়।

চীনেই কেন?
প্রফেসর উলহাউসের মতে, চীনের জনসংখ্যা ঘনত্ব অনেক বেশি এবং পশুপাখির সহজ সাহচার্যের কারণে দেশটিতে করোনা ভাইরাস সহজেই ছড়াচ্ছে।

মানুষের মধ্যে কীভাবে?
শুরুতে করোনা ভাইরাস মানুষের মাধ্যমে ছড়াচ্ছে না দাবি করলেও শিগগিরই নিজেদের ভুল শুধরে নেয় চীনা কর্তৃপক্ষ। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির প্রফেসর পিটার হরবি বলেন, এটি যে মানুষ থেকেই মানুষে ছড়াচ্ছে তা একেবারে পারিষ্কার। বড় প্রশ্ন হচ্ছে, কত সহজে ছড়ায় এটি? এটা কি স্থায়ী হতে চলেছে?

সার্স ভাইরাস মানুষের মধ্যে সহজে ছড়ালেও মার্সের জন্য সেটি বেশ কঠিন ছিল। মার্স ছড়ানোর জন্য প্রাণীর ঘনিষ্ঠ সাহচার্য প্রয়োজন ছিল।

নতুন ভাইরাস সংক্রমণের ক্ষেত্রে কিছু মানুষ অতিরিক্ত দুর্বল কি না এবং তারা সহজেই এটি পরিবহন করছে কি না তা খুঁজে বের করাও জরুরি হয়ে পড়েছে।

কবে থেকে এ ভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হয়েছে এখন পর্যন্ত সেটাও ঠিকঠাক জানা যায়নি। করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কি লক্ষণগুলো প্রকাশ পায় নাকি তা প্রকট আকার ধারণ করার পরই বাইরে আসে সেটাও পরিষ্কার নয়।

কত দ্রুত ছড়াচ্ছে?
সংবাদমাধ্যমের খবর অনুসারে, এক সপ্তাহেরও কম সময়ে করোনা ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা ৪০ থেকে ৪৪০-এ পৌঁছে গেছে। তবে এটা আসলে ভুল ধারণা।

চীনা কর্তৃপক্ষের কড়া নজরদারির কারণেই বেশিরভাগ নতুন আক্রান্তদের খুঁজে পাওয়া গেছে। প্রকৃতপক্ষে তারা আগে থেকেই এ ভাইরাসে আক্রান্ত ছিলেন।

ঠিক কী হারে করোনা ভাইরাস আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে তা সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা এখনও পাওয়া যায়নি। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নতুন ভাইরাসে অসুস্থ হয়ে পড়া মানুষের প্রকৃত সংখ্যা খবরে প্রকাশিত সখ্যার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি।

এছাড়া করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব চীনের উহান শহরে শুরু হলেও এখন পর্যন্ত থাইল্যান্ড, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রেও এর দেখা পাওয়া গেছে। এর মধ্যে প্রায় সব ক’টি উহান ভ্রমণের কারণে হলেও থাইল্যান্ডেরটি স্থানীয়ভাবেই ছড়িয়েছে। এ কারণে চলতি মাসের শেষ দিকে চীনা নববর্ষ উদযাপনের সময় লাখ লাখ ভ্রমণকারী নতুন করে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

ভাইরাসটি কি পরিবর্তিত হতে পারে?
হ্যাঁ! ভাইরাসরা সাধারণত সময়ের সঙ্গে পরিবর্তিত ও পরিবেশের সঙ্গে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে পারে। ছড়িয়ে পড়ার সুবিধার্থে ভাইরাসগুলো প্রয়োজন মতো পরিবর্তিত হতে পারে। বিজ্ঞানীরা এ বিষয়টিও কঠোরভাবে নজরে রেখেছেন।

করোনা ভাইরাস থামানোর উপায় কী?
নতুন ভাইরাসটির এখনও কোনো প্রতিষেধক আবিষ্কৃত হয়নি। এ কারণে এর ছড়িয়ে পড়া থামানোর আপাতত একমাত্র উপায় হচ্ছে, আক্রান্তদের আবদ্ধ জায়গায় রেখে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ও পরীক্ষা করা। যারা আক্রান্তদের সংস্পর্শে আসছেন তাদের পর্যবেক্ষণ করা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে কাজে আসতে পারে। এছাড়া গণজমায়েতে নিষেধাজ্ঞাও জারি করা যেতে পারে।

চীন কী করছে?
চীনের ন্যাশনাল হেলথ কমিশন বলছে, করোনা ভাইরাসের উৎস যেহেতু উহান, এ কারণে পর্যটকদের ওই এলাকা ভ্রমণ করা এবং স্থানীয়দের শহর ছেড়ে বাইরে যাওয়া উচিত নয়।

ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি কমাতে সেখানে আক্রান্তদের অনেকটা জনবিচ্ছিন্ন অবস্থায় রেখে চিকিৎসা করা হচ্ছে। ভ্রমণকারীদের শারীরিক তাপমাত্রা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। আর শহরের সামুদ্রিক খাবারের বাজারটি আপাতত বন্ধ রাখা হয়েছে।

বিশ্বের প্রতিক্রিয়া কী?
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা সারাবিশ্বের হাসপাতালগুলোকে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার বিষয়ে সতর্ক করেছে। সিঙ্গাপুর-হংকংসহ এশিয়ার বেশিরভাগ দেশই উহান থেকে আসা পর্যটকদের শারীরিক পরীক্ষা করে তারপর ঢুকতে দিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যও একই পদ্ধতি অবলম্বন করছে।

যদিও এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা কতটা কাজে দেবে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। যদি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর এর লক্ষণ প্রকাশ পেতে অন্তত পাঁচদিন লাগে, তাহলে ততদিনে একজন রোগী খুব সহজেই অর্ধেক বিশ্ব ঘুরে আসতে পারে। তখন কোনো স্ক্যানারেই তার এই অসুখ ধরা পড়বে না।

বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন?
লন্ডনভিত্তিক বেসরকারি দাতব্য সংস্থা ওয়েলকাম ট্রাস্টের ড. জোসি গোল্ডিং বলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা যথেষ্ট পরিমাণ তথ্য না পাচ্ছি, ততক্ষণ বলা যাচ্ছে না এটা নিয়ে ঠিক কতটা উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত। যতক্ষণ পর্যন্ত সূত্র নিশ্চিত না করছে, ততক্ষণ আমাদের অস্বস্তিতেই থাকতে হচ্ছে।

প্রফেসর বল বলেন, মানুষ যখনই নতুন কোনো ভাইরাস আবিষ্কার করে, তখনই সেটা নিয়ে উদ্বিগ্ন হতে হয়। কারণ ততদিনে এটি তার প্রথম বড় বাধা অতিক্রম করে এসেছে। একবার মানবকোষে ঢুকে বংশবৃদ্ধি শুরু করলে সেটি আরও ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে। ভাইরাসকে সেই সুযোগ দেয়া উচিত নয়।

সূত্র: বিবিসি


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *