করোনা সংকট: বাণিজ্য সাম্রাজ্যে আধিপত্য শেষ চীনের!


প্রায় ৩০ বছর ধরে বিশ্ব অর্থনীতিতে দাপট দেখাচ্ছে চীন। দেখতে দেখতে তারা হয়ে উঠেছে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি। বিশ্বের বড় বড় কোম্পানি এখন অনেকটাই চীননির্ভর। তবে সেই সুদিন হয়তো শেষ হতে যাচ্ছে চীনাদের। করোনাভাইরাসের এক ধাক্কাই বুঝিয়ে দিয়েছে, এক-দেশ নির্ভরশীলতা ব্যবসার জন্য কতটা ক্ষতিকর।

করোনাভাইরাস সংক্রমণে গত দুই মাসে সবচেয়ে বড় আঘাতটা এসেছে চীনের ওপরই। এর উত্তাপ বুঝতে পারছে যুক্তরাষ্ট্রও। গত সপ্তাহে দেশটির এসঅ্যান্ডপি ৫০০-এর সূচক পড়ে গেছে প্রায় ৮ শতাংশ, যা বিশ্বের শেয়ারবাজারগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বাজে অবস্থা। এমনকি কয়েকগুণ বেশি করোনা আক্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও ইতালির শেয়ারবাজারেও এত বড় ধস নামেনি।

স্থবির চীন

গত ৩১ ডিসেম্বর চীনের উহানে প্রথমবারের মতো শনাক্ত হয় নভেল করোনাভাইরাস, এরপর দ্রুতই দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে এটি। ভাইরাস সংক্রমণ বাড়তে থাকায় ২৩ জানুয়ারি চীনা নববর্ষের ছুটি বাড়ানোর ঘোষণা দেয় বেইজিং। বন্ধ করে দেয়া হয় কল-কারখানা, যান চলাচল, অবরুদ্ধ ঘোষণা করা হয় বেশ কয়েকটি শহর। ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা ও কোয়ারেন্টাইনের মুখে পড়েন হুবেই প্রদেশের প্রায় ছয় কোটি মানুষ। করোনা আতঙ্কে চীনগামী ফ্লাইট বাতিল করে বেশিরভাগ এয়ারলাইন্স।

করোনা সংকটে বন্ধ হতে চলছে চীনকেন্দ্রিক সব ধরনের বাণিজ্য। আরও বড় আতঙ্কের বিষয়, এ সংকটে শুধু স্বল্পকালীন অর্থনৈতিক ক্ষতিই নয়, দীর্ঘমেয়াদে এর প্রভাব থাকবে বৈশ্বিক সরবরাহের ওপরও।

চায়না বেজ বুকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেহজাদ এইচ কাজী বলেন, চীনে অন্য শিল্পের চেয়ে সবচেয়ে বেশি বন্ধ হয়েছে গাড়ি নির্মাণ ও রাসায়নিক কারখানাগুলো। গত সপ্তাহেও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর বেশিরভাগ কর্মী কাজে ফেরেনি। জাহাজ চলাচল ও সরবরাহ প্রতিষ্ঠানগুলোও স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি দিন বন্ধ রয়েছে। বিশ্বব্যাপী মোটর যন্ত্রাংশ, ইলেক্ট্রনিক্স ও ওষুধ সরবরাহ ব্যবস্থার ওপর এ সংকটের প্রভাব আগামী কয়েক মাস ধরে অনুভূত হবে।

পরিবর্তন শুরু

ব্যবসায়ীরা সবসময় কম খরচে বেশি লাভের রাস্তা খোঁজেন। সেটা হতে পারে কম মজুরি, কম উৎপাদন খরচ, কাঁচামালের সহজ লভ্যতা ও পরিবহন সুবিধা। চীনে এসব সুবিধা সহজে পাওয়ায় অল্প সময়ের মধ্যেই তারা হয়ে উঠেছে বিশ্বের অন্যতম প্রধান উৎপাদন ও বাণিজ্য কেন্দ্র।

বিশ্ব বাণিজ্যে চীনের একচ্ছত্র প্রভাবের নেতিবাচক ফলাফল নিয়ে উদ্বেগ ছিল আগে থেকেই। এ কারণে বড় বড় কোম্পানি চীনের বিকল্পও খুঁজছিল বহুদিন ধরে। তবে সেসব কার্যক্রম চলছিল অনেকটাই কচ্ছপগতিতে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শাসনামলে সেই গতি কিছুটা বৃদ্ধি পায়। কারণ কোনও প্রতিষ্ঠানই অধিক ও অনিশ্চিত শুল্ক পছন্দ করবে না। ফলে তারা বিকল্প রাস্তা খুঁজবেই। চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর পরিবর্তনের গতি অনেকটাই বৃদ্ধি পায়। বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর চীনা অংশীদাররা ইতোমধ্যে ভিয়েতনাম, বাংলাদেশসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সরে আসার চেষ্টা করছে।

তবে করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরুর পর চীননির্ভর বাণিজ্য ব্যবস্থা পরিবর্তনের বিষয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করেন ব্যবসায়ীরা।

ইউরোপের ফার্মেসিগুলো বলছে, তাদের কাছে সার্জিক্যাল মাস্কের সংকট দেখা দিয়েছে। কারণ সেগুলোর সবটাই তৈরি হয় চীনে। তাদের প্রশ্ন, আলবেনিয়ায় শ্রমিক মজুরি চীনের চেয়েও কম, অবস্থানও কাছেই, তাহলে এ দেশটিতে কেন বানানো হচ্ছে না মাস্ক?

বর্তমানে চীনের গলার কাঁটা হয়ে উঠেছে করোনাভাইরাস। এই সংকট কাটিয়ে আবার আগের অবস্থায় ফেরা তাদের জন্য যথেষ্ট কঠিন বলে মত বিশেষজ্ঞদের। তার ওপর ডোনাল্ড ট্রাম্প যদি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আবারও জিতে যান, তবে চীন-যুক্তরাষ্ট্র দ্বিতীয় পর্যায়ের চুক্তি হবে কি না, তা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে ব্যবসায়ীদের।

চীনের বিকল্প দেশ খুঁজে বের করা সহজ নয়। আর কোনো দেশেরই চীনের মতো শক্তিশালী সরবরাহ ব্যবস্থা নেই। কিছু বড় দেশে চীনের মতো শুল্ক ব্যবস্থা রয়েছে। এর মধ্যে ব্রাজিল নেই, ভারত আছে। তবে ভারতের সরবরাহ সুবিধা মোটেও চীনের মতো নয়।

সময় এখন মেক্সিকোর

হ্যাঁ, চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য যুদ্ধ আর করোনা সংকটে ব্যবসায়িকভাবে সবচেয়ে লাভবান দেশটির নাম মেক্সিকো। গত বছরই যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো-কানাডা চুক্তিকে (ইউএসএমসিএ) আইনে পরিণত করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। এতে সবচেয়ে বেশি লাভ হচ্ছে উত্তর আমেরিকার দেশ মেক্সিকোরই।

গত ২৫ ফেব্রুয়ারি উৎপাদক, গাড়িনির্মাতা ও প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর ১৬০ জন নির্বাহী কর্মকর্তার মতামতের ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য এবং প্রবণতা সমীক্ষা ২০২০ প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক আইনি প্রতিষ্ঠান ফোলে অ্যান্ড লার্ডনার এলএলপি। নির্বাহীদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, তাদের প্রতিষ্ঠান আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে ব্যবসা অন্য দেশ থেকে মেক্সিকোতে সরিয়ে নেবে কি না বা এ ধরনের পরিকল্পনা আছে কি না।

ফোলের অংশীদার ক্রিস্টোফার সুইফট বলেন, আমাদের জরিপে দেখা গেছে, বিপুল সংখ্যক প্রতিষ্ঠান তাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রমের কিছু অংশ অন্য দেশ থেকে মেক্সিকোতে সরিয়ে নিয়েছে বা নিচ্ছে। আর এসব হচ্ছে বাণিজ্য যুদ্ধ ও ইউএসএমসিএ পাস হওয়ার কারণে।

বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান টেম্পেস্ট ক্যাপিটালের ব্যবস্থাপনা অংশীদার সেবাস্তিয়ান মিরালেস বলেন, যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ইউরোপ থেকে সরে এক বছরে মেক্সিকোতে আসা সম্ভাব্য সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) দাঁড়াতে পারে ১২ বিলিয়ন থেকে ১৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। উৎপাদনখাতে বিদেশি বিনিয়োগ কয়েকগুণ বাড়ার ফলে মেক্সিকোর বার্ষিক প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৪ দশমিক ৭ শতাংশ।

চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য যুদ্ধে লাভবান হওয়ার দিক থেকে সবচেয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে মেক্সিকো। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের এমনিতেই মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি রয়েছে। আছে ২৫ বছর আগে করা নাফটা (নর্থ আমেরিকান ফ্রি ট্রেড ডিল) চুক্তিও। ফলে ইতোমধ্যে বিশ্বের অন্যতম গাড়ি, ইলেক্ট্রনিক্স, টেলিভিশন ও কম্পিউটার উৎপাদক এবং রফতানিকারক দেশ হয়ে উঠেছে মেক্সিকো। যেখানে বেইজিং থেকে যুক্তরাষ্ট্রে জাহাজে পণ্য পৌঁছাতে সময় লাগে ৪০ দিন, সেখানে মেক্সিকো থেকে নিউইয়র্ক যেতে সময় লাগে মাত্র পাঁচদিন।

বিমানের ইঞ্জিন ও মাইক্রো সেমিকন্ডাক্টরের মতো জটিল যন্ত্রাংশও তৈরি করছে মেক্সিকো। বিশ্বের অষ্টম সর্বোচ্চ ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রিধারী দেশ তারা। এরই মধ্যে সেখানে বিনিয়োগ করেছে অসংখ্য বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান। বিশ্বখ্যাত জেনারেল ইলেক্ট্রিক সেখানে গেছে, বোয়িং গেছে, কিয়া বিনিয়োগ করেছে মেক্সিকোতে।

প্রশ্ন শুধু নিরাপত্তায়

মেক্সিকোয় ব্যবসার ক্ষেত্রে এখনও বড় বাধা নিরাপত্তা। দেশটিতে খুন, অপহরণ, অবৈধ মাদক ব্যবসার হার অত্যন্ত বেশি। আতঙ্ক ছড়ায় ব্যক্তিগত সুরক্ষা বাহিনীগুলোও।

বিশ্লেষকদের মতে, মেক্সিকো যদি চীনের অর্ধেকও নিরাপদ হয়, তাহলেও এটি বিশ্বঅর্থনীতির অন্যতম প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠবে। শুধু নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করলেই তারা হবে ল্যাটিন আমেরিকার সেরা দেশ।

তবে চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য যুদ্ধের সুফল ঠিকই পেতে শুরু করেছে মেক্সিকো। ইতোমধ্যে তারা চীনকে হটিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার হয়ে উঠেছে। শুধু অল্প কিছু ক্ষেত্রেই মেক্সিকোর চেয়ে এগিয়ে রয়েছে চীন।

ফোলের জরিপে অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তাদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, তারা চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য যুদ্ধের কারণেই মেক্সিকোতে ব্যবসা নিচ্ছেন কি না। জবাবে দুই-তৃতীয়ংশই জানিয়েছেন, আগে থেকেই তাদের এই পরিকল্পনা ছিল। আর এক-চতুর্থাংশ বাণিজ্য যুদ্ধ শুরুর পর ব্যবসা সরিয়ে নিয়েছেন।

মেক্সিকোতে ব্যবসা সরিয়ে নিচ্ছেন এমন ৮০ শতাংশই জানিয়েছেন, তারা আগামী দুই বছরের মধ্যেই এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করবেন।
এছাড়া, সরবরাহ ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনছেন এমন ৬৪ শতাংশই জানিয়েছেন, তারা মেক্সিকোতেই নতুন গন্তব্য নির্ধারণ করেছেন।

সৌজন্যে : ফোর্বস


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *