কাবা ঘরের যে ৯ বিস্ময়কর তথ্য মানুষের অজানা


ডেস্ক রিপোর্ট :: মুসলিম উম্মাহর ক্বেবলা পবিত্র কাবা শরিফ। এটি মুমিন মুসলমানের সবচেয়ে প্রিয় ও পবিত্র স্থান। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রতি বছর এ কাবার জিয়ারতে আসে লাখোকুটি মুসলিম জনতা। তারা লাব্বাইক ধ্বনিতে মুখরিত করে তোলে কাবা চত্ত্বর।

এ কাবা সম্পর্কেই রয়েছে বিস্ময়কর কিছু তথ্য। যা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য জানা আবশ্যক। বিশ্ব মুসলিমের জন্য তা তুলে ধরা হলো-

>> কাবা ঘর নির্মাণ
বর্তমান যে স্থানে কাবা শরিফ স্থাপিত এ স্থানে তা নির্মাণ করেছিলেন মুসলিম জাতির পিতা হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম ও তাঁর ছেলে হজরত ইসমাইল আলাইহিস সালাম।
বর্তমান সময়ে কাবার যে অবকাঠামো তা প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনকালের সময় এমন ছিল না। আর বর্তমান সময় পর্যন্ত তা বেশ কয়েকবার সংস্কার করে এর উন্নয়ন করা হয়েছে।
সর্বশেষ ১৯৯৬ সালে উন্নত সরঞ্জাম ও পাথরের ব্যবহারে কাবা চত্ত্বরসহ এর বেশি কিছু উন্নয়ন কাজ করার মাধ্যমে কাবার ফাউন্ডেশনকে শক্তিশালী ও মজবুত করা হয়।
সৌদি আরব সরকারের ভিশন ২০৩০-এর আওতায় রয়েছে কাবার বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড। যা সময়ের প্রয়োজনেও করা জরুরি ছিল।

– সৌদি গেজেটের তথ্য মতে, কাবা ঘরের উচ্চতা পূর্ব দিকে ১৪ মিটার (অন্য একটি সূত্র তা ১২.৮৪ মিটার), পশ্চিম দিকে ১২.১১ মিটার, উত্তর দিকে ১১.২৮ মিটার এবং দক্ষিণ দিকে ১২.১১ মিটার। (সৌদি গেজেট, ৩ জানুয়ারি, ২০১০ ইং)
>> কাবা ঘরের দরজা ও জানালা
কাবা ঘরের ২টি দরজা ছিল। একটি দিয়ে প্রবেশের জন্য আর অন্যটি দিয়ে বের হওয়ার জন্য। আর ছিল একটি জানালা। বর্তমানে একটি দরজাই রাখা হয়েছে।
ভূমি থেকে ২.৫ মিটার উচ্চতায় রয়েছে কাবার দরজা। এটির দৈর্ঘ্য ৩.০৬ ও প্রস্থ ১.৬৮ মিটার। দরজাটি বাদশা খালেদ ২৮০ কেজি স্বর্ণ দ্বারা তৈরি করে উপহার দেন।

>> কাবা ঘরের গিলাফে রঙের ব্যবহার
কাবা ঘরের গিলাফের রঙ কখনোই কালো ছিল না। বর্তমানে কাবা ঘরের গিলাফের রঙ কালো ব্যবহার করা হয়। আব্বাসীয় খলিফাদের পরিবারের প্রিয় রঙ ছিল কালো। তাদের সময় থেকে কাবা ঘরে কালো গিলাফ পরানো হয়। এর আগে কাবা ঘরে সবুজ, লাল ও সাদা রঙের গিলাফ ব্যবহার করা হতো।

– কাবা ঘরে প্রথম গিলাফ পরান : হিমিয়ারের রাজা তুব্বা আবুল আসাদ।

>> কাবা ঘরের চাবি
মক্কা বিজয়ের পর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কাবা ঘরের চাবি বনি শায়বাহ গোত্রের ওসমান ইবনে তালহা রাদিয়াল্লাহু আনহুর কাছে হস্তান্তর করেন। বংশ পরম্পরায় এখনো তারাই কাবা ঘরের চাবির দায়িত্ব পালন করে আসছেন।
অনেকদিন ধরেই কাবা ঘরের বিভিন্ন ধরনের বিশেষ তালা ও চাবির ব্যবহার হয়ে আসছে। দীর্ঘ দিন পরপর পরিবর্তন করা এসব তালা কিংবা চাবি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত থাকার তথ্য পাওয়া যায়। এখন পর্যন্ত কাবা শরিফে ৫৮টি তালা-চাবির নিবন্ধনের তথ্য পাওয়া যায়।

– যার মধ্যে তুরস্কের সাবেক রাজধানী ও প্রাচীন শহর ইস্তাম্বুলে তোপকাপি জাদুঘরেই রয়েছে ৫৪টি চাবি।
– ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের একটি জাদুঘরে রয়েছে ২টি চাবি এবং
– মিসরের রাজধানী কায়রোর ইসলামি আর্ট জাদুঘরে রয়েছে ১টি চাবি।
কাবা শরিফের চাবি রাখার জন্য কিসওয়ার কাপড় দ্বারা তৈরি বিশেষ বক্স তৈরি করা হয়। যার মধ্যে রাখা হয় পবিত্র কাবা শরিফের চাবি।

>> কাবা সবার জন্য উন্মুক্ত!
একসময় কাবা ঘরের দরজা সবার জন্য উন্মুক্ত ছিল। সবাই পবিত্র কাবা ঘরে প্রবেশ করতে পারতো। পরে কাবা ঘরে সবার অবাধ প্রবেশ বন্ধ করে দেয়া হয়।
এখন তা বিশেষ নিয়ম মেনে দেশটির রাষ্ট্র প্রধান ও দায়িত্বশীল ব্যক্তিরাই প্রবেশ করতে পারে। বিশ্বের বিভিন্ন মুসলিম রাষ্ট্র প্রধানসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা নিয়ম মেনে কাবা ঘরে প্রবেশ করতে পারেন।

– কাবা ঘরের অভ্যন্তর বিশেষ পানি দ্বারা বছরে দুই বার ধোয়া হয়।
– মক্কা বিজয়ের দিন সর্ব প্রথম কাবা ঘর গোসল দেন হজরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।

>> সাঁতার কেটে তাওয়াফ!
এখন পর্যন্ত দুবার কাবা চত্বরে পানি তলিয়ে যাওয়ার তথ্য পাওয়া যায়। একবার ইসলামের স্বর্ণ যুগে। আর দ্বিতীয়টি ১৯৪১ সালে।
১৯৪১ সালে সপ্তাহব্যাপী প্রবল বৃষ্টির কারণে কাবা চত্বরসহ মক্কার বিভিন্ন এলাকা পানিতে তলিয়ে যায়। আর সে সময় কাবা ঘর জিয়ারতকারীদের কেউ কেউ সাঁতার কেটে কাবা ঘর তাওয়াফ করেন। সেসময় সপ্তাহব্যাপী বৃষ্টির কারণে কাবা চত্বরে প্রায় ৬ ফট পানি জমে যায়।

তবে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনকালের সময়ও একবার কাবা চত্বরে পানি জমে থাকার তথ্য জানা যায়। সে সময় হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে জুবায়ের রাদিয়াল্লাহু আনহু সাতরে কাবা তাওয়াফ করেছিলেন বলে জানা যায়।

>> হাজরে আসওয়াদ ভাঙা!
কাবা শরিফে দক্ষিণ-পূর্ব কোনে স্থাপিত কালো পাথর হলো হাজরে আসওয়াদ। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, কাবা ঘরে স্থাপিত হাজরে আসওয়াদটি ভাঙা।
ঐতিহাসিক বর্ণনা অনুযায়ী ৬০৫ খ্রিস্টাব্দে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিরাট দ্বন্দ্বের অবসান ঘটাতে বিভিন্ন গোত্রের লোকদের সহায়তায় নিজ হাতে তা কাবা ঘরের কোনে স্থাপন করেন।
হাজরে আসওয়াদ চুম্বন করতে গিয়ে তা রূপা দিয়ে বাধাই অবস্থায় দেখে অনেকের মনে এ প্রশ্ন জাগে যে হাজরে আসওয়াদ বাধানো কেন? আবার হাজরে আসওয়াদে এত ফাটলই বা কিসের? বিভিন্ন তথ্যে জানা যায়-

– ৬৪ হিজরিতে হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে জুবায়ের রাদিয়াল্লাহু আনহু শাসনকালের সময় কাবা ঘরে আগুন লাগলে হাজরে আসওয়াদটি ভেঙে একাধিক খণ্ড হয়ে যায়। কেউ কেউ বলেন এটি ৩ খণ্ডে বিভক্ত হয়ে যায়। পরে তিনি এটিকে রুপার আবর দিয়ে একত্রিত করে পুনরায় কাবা চত্বরে স্থাপন করেন।
– ৩১৭ হিজরীতে পূর্ব আরবের কারামতি সম্প্রদায় কাবা ঘর আক্রমণ করে ভাংচুর ও লুন্ঠন চালায়। কাবা ঘরের বিভিন্ন জিনিসের সঙ্গে হাজরে আসওয়াদও লুণ্ঠন করে নিয়ে যায় তারা।
– ২২ বছর পর পাথরটি তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়। লুণ্ঠনের সময় পাথরটি ব্যাপক ক্ষতি ও টুকরো টুকরো হয়ে যায়। হাজরে আসওয়াদের ভাঙা অংশগুলোর মধ্যে এখনো কয়েকটি খন্ড নিখোঁজ রয়েছে। কেউ কেউ বলেন এখনো ৮ খণ্ড পাথর নিখোঁজ অবস্থায় রয়েছে।
হাজরে আসওয়াদের ভাঙা অংশগুলো কাদামাটি, মোম, অম্বর ইত্যাদি দিয়ে মেরামতপূর্বক বাধাই করে রাখা হয়েছে।

>> কাবা ঘরে ঢুকলে কোন দিকে নামাজ?
কাবা ঘরের বাইরে তাওয়াফের চত্বরে কাবা ঘরের ৪ পাশে দাঁড়িয়েই মানুষ নামাজ আদায় করে। কিন্তু যারা কাবা ঘরের ভেতরে ঢুকে নামাজ আদায় করে, তারা কোন দিকে ফিরে নামাজ আদায় করে? এ কৌতুহল কিংবা প্রশ্ন অনেকেরই।
কাবা ঘরের ভেতরে যে কোনো দিকে ফিরেই নামাজ আদায় করা যায়। তাতে কোনো বিধি-নিষেধ নেই।
আবার কাবা ঘরের বাইরে যে কোনো পাশে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়া যায়। তবে কাবা ঘরের ইমাম সাহেবগণ বেশির ভাগ সময় মাকামে ইবরাহিম চত্বরে বর্তমান দরজার সামনে দাঁড়িয়েই নামাজ পড়ান।

>> কাবা ঘরের দরজা কখন খোলা হয়?
রাষ্ট্রীয় কিংবা বিদেশি মেহমান না আসলে বছরে দুইবার কাবা ঘরের দরজা খোলা হয়। আর সে সময় কাবা ঘরে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয় এবং বিশেষ পানি দ্বারা ধোয়া হয়। আর এ কাজে নেতৃত্ব দেন দুই পবিত্র মসজিদের খাদেম সৌদির বাদশাহসহ দেশটির উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ।

কাবা ঘরের আরো কিছু তথ্য- 

– কাবা ঘরের সিলিংয়ে তিনটি কাঠের পিলার আছে। প্রতিটি পিলারের ব্যাস ৪৪ সে.মি.।
– কাবা ঘরের ভেতরের দেয়ালগুলো সবুজ ভেলভেটের পর্দা দিয়ে আবৃত। যা প্রতি তিন বছর পর পর পাল্টানো হয়।
– কাবা ঘরের ছাদ লম্বায় ১২৭ সে.মি আর প্রস্থে ১০৪ সে.মি.।
– কাবা ঘরে আলো প্রবেশের জন্য একটি ভেন্টিলেটার রয়েছে। কাঁচ দিয়ে ঢাকা এ ভেন্টিলেটারটি প্রস্থের দিকে স্থাপিত। কাবা ঘর ধোয়ার সময় এ কাচের ভেন্টিলেটার খোলা হয়।
– কাবা ঘরের ছাদ প্রথমে কুসাই নির্মাণ করেন অতঃপর কুরাইশ।
– কাবা ঘরে প্রথম মূর্তি স্থাপন করে আমর বিন লুহাই।
– কাবা ঘরে প্রথম আজান দেন হজরত বেলাল বিন রাবাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *