বাউল শাহ আবদুল করিম এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘একদিন এই পৃথিবীটা বাউলের পৃথিবী হবে’। এই কথার মধ্যদিয়েই চেনা যায় একজন শাহ আবদুল করিমকে। তিনি আজীবন কথা বলেছেন মানুষের পক্ষে। গরিব, শ্রমিক ও দিনমজুর মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য লড়েছেন সারাজীবন। গানেই বলেছেন-‘শোষণের বিরুদ্ধে আমি শোষিতের গান গাই।/ আপোসহীন সংগ্রাম করে বেঁচে থাকতে চাই‘। বিপ্লব আর সংগ্রামই ছিলো বাউল করিমের গানের মূল চেতনা। নৈরাশাকে দূরে সরিয়ে যিনি আশার বীজ বুনতেন তাঁর গীতে। সমাজে বিভিন্ন কুসংস্কার ও অসাম্প্রদায়িক সমাজ বিনির্মাণে তাঁর লড়াই–সংগ্রাম ইতিহাসে লেখা থাকবে। শ্রোতা কিংবা আপামর জনসাধারণ তাঁকে চিনতো ‘বাউল সম্রাট’ হিসেবে। ভাটি বাংলার গানের আসরে দাঁড়িয়ে তাৎক্ষণিক গান রচনায় তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। তাঁর একতারার সুরে প্রেম–বিরহ যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে যেকোনো অন্যায়ের প্রতিবাদ। এমন বিরল প্রতিভার গুণেই তিনি আজও সমান জনপ্রিয়তায় বাস করছেন ভক্তের অন্তরে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা বাঙালির হৃদয়ে ঠাঁই নিয়েছে তাঁর গীত।
কেবল গীত রচনা নয়, তিনি ছিলেন শিল্পী ও সুরকার। তাঁর দরদী কন্ঠের মায়াময় জাদুতে বশ ছিলেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। অজস্র গণসংগীত তিনি লিখেছেন; গেয়েছেন নিজ কন্ঠে। ১৯৫৭ সালে কাগমারী সম্মেলনে মৌলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সহ উপস্থিত সকলকে মুগ্ধ করেছেন তাঁর গাওয়া গণসঙ্গীতে।
শাহ আবদুল করিমের অসাম্প্রদায়িক চেতনায় রচিত গানগুলো আজও আমাদেরকে ব্যাপকভাবে নাড়া দেয়। ধর্মীয় ব্যাপারে এখনও আমাদের দেশে এমন সব ঘটনা ঘটছে যেগুলো স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে এসে মোটেও কাম্য নয়। বাউল করিমই আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেন– ‘গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু–মুসলমান / মিলিয়া বাউলা গান আর মুর্শিদি গাইতাম / আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম।’
আমাদের ধর্মীয় সম্প্রীতির বন্ধন চিরকালই অটুট ছিলো যার প্রমাণ এইসব কথামালায় ওঠে এসেছে।
বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিম ১৯১৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সুনামগঞ্জ জেলার দিরাই উপজেলার ধলআশ্রম গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পরবর্তীকালে তিনি স্থায়ীভাবে উজানধল গ্রামে বসবাস শুরু করেন। তাঁর পিতা ইব্রাহিম আলী ছিলেন একজন দরিদ্র কৃষক, মাতা নাইওরজান বিবি। দারিদ্রের যাঁতাকলে পিষ্ঠ হয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষালাভ বেশিদূর এগোয়নি। পরিবারে ছিলো সংঙ্গীতের বীজ। তাঁর বাউল হয়ে ওঠার পেছনের শক্তি ছিলো কালনী নদী। তিনি নিজেই এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন-“ নিঃসন্দেহে কালনী নদী। বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া কালনী নদীর প্রেমে পড়েই আমি বাউল হয়েছি। তাছাড়া হাওরের আফাল (ঢেউ) আমাকে বাউল বানিয়েছে। ভাটির অপরূপ রূপবৈচিত্র্য না থাকলে হয়তো আমি বাউল হতে পারতাম না। কালনী নদীর উত্তাল স্রোত আর হাওর আমাকে প্রেম শিখিয়েছে। তবে এরও আগে একটা ঘটনার কথা বলতেই হয়। আমি তখন খুব ছোটো ছিলাম।আমার এক দাদা সারিন্দা বাজিয়ে গাইতেন—’ভাবিয়া দেখ তোর মনে/ মাটির সারিন্দারে বাজায় কোন জনে‘। এ গানটি আমার মনের ভেতরে ঢুকে যায়। এরপর ধীরে ধীরে গানের জগতে ঢুকে পড়ি।”
ভাটি অঞ্চলের বৈচিত্রময় জীবন, মানব জীবনের সুখ, প্রেম–ভালোবাসা শাহ আবদুল করিমের গানে যেমন প্রাণ পেয়েছে তেমনি সকল অন্যায়, অবিচার, কুসংস্কার আর সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সবসময় সোচ্চার। গানের অনুপ্রেরণা পেয়েছেন ফকির লালন শাহ, পাঞ্জু শাহ ও দুদ্দু শাহের দর্শন থেকে। তিনি বাউলগানের দীক্ষা লাভ করেন সাধক রশীদ উদ্দীন, শাহ ইব্রাহীম মস্তান বকশের নিকট থেকে। শরিয়ত, মারফত, দেহতত্ত্ব, গণসংগীতসহ বাউলগান এবং অন্যান্য গানের ভূবনে তিনি বিচরণ করেছেন আজীবন।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার লোকসংগীতে অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ২০০১ সালে তাঁকে ‘একুশে পদক‘ প্রদান করে। এ ছাড়াও তিনি বহু পদক, সম্মাননা ও সংবর্ধনা পেয়েছেন। তাঁর প্রকাশিত বই : আফতাব সঙ্গীত (১৯৪৮), গণসঙ্গীত (১৯৫৭), কালনীর ঢেউ (১৯৮১), ধলমেলা (১৯৯০), ভাটির চিঠি (১৯৯৮), কালনীর কূলে (২০০১) ও শাহ আবদুল করিম রচনাসমগ্র (২০০৯)।
২০০৯ সালের এই দিনে (১২ সেপ্টেম্বর) সিলেটের একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর রেখে যাওয়া কর্মগুলো আমাদের নিকট প্রেরণার উৎস। শুধু শিষ্যদের অন্তরে নয়, তিনি বিরাজমান আছেন সু–মানুষদের হৃদয়ে।
বাউল শাহ আবদুল করিমের প্রয়াণ দিবসে তাঁর প্রতি রইলো নিরন্তর ভালোবাসা, বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।
লেখক : এম. এ. হাসান
সিনিয়র প্রভাষক, ইংরেজি বিভাগ, নারী শিক্ষা একাডেমী ডিগ্রি কলেজ।