খেলাপি ঋণ ছাড়ালো ১ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকা


ঋণ খেলাপি কমাতে নানা সুযোগ দিচ্ছে সরকার। কাগজে কলমে খেলাপি ঋণ কমাতে ঋণ পুনঃতফসিল, ঋণ পুনর্গঠন ও অবোলপনের বিশেষ সুবিধা দেয়া হচ্ছে। তারপরও লাগাম টানতে পারছে না খেলাপি ঋণের। তিন মাসের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১৬ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা, যা এ যাবৎকালের রেকর্ড। পরিমাণের পাশাপাশি খেলাপি ঋণের হারও বেড়েছে।

ব্যাংকসংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজনৈতি প্রভাব খাটিয়ে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা নিয়ে নিয়মিত করা ঋণ পরিশোধ করছে না। এসব ঋণ এখন নতুন করে খেলাপি হয়ে পড়েছে। এছাড়া বিশেষ সুবিধায় পুনঃতফসিল করতে অনেকে ঋণ পরিশোধ করেননি। সব মিলিয়ে খেলাপি ঋণ বেড়ে গেছে।

খেলাপি ঋণ কমাতে ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্টে ৯ শতাংশ সুদহারে ঋণ পুনঃতফসিলের বিশেষ সুবিধার দেয়া হচ্ছে। প্রভাবশালী ঋণ খেলাপি শিল্প গ্রুপ পাচ্ছে ঋণ পুনর্গঠনের সুযোগ। এছাড়া কাগজে-কলমে খেলাপি ঋণ কমাতে ঋণ অবলোপনের বিভিন্ন শর্ত শিথিল করা হয়। তারপরও বাড়ছে খেলাপি ঋণ।

এদিকে অর্থমন্ত্রী হিসেবে আ হ ম মুস্তফা কামাল দায়িত্ব নেয়ার পরই ঘোষণা দেন খেলাপি ঋণ এক টাকাও বাড়বে না। কিন্তু তার এ হুঁশিয়ারির পর গত ৯ মাসে খেলাপি ঋণ না কমে উল্টো বেড়েছে ২২ হাজার কোটি টাকার বেশি।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা নিয়ে ঋণ নিয়মিত করছে কিন্তু পরে তা পরিশোধ করছে না। এছাড়া ঋণ পুনর্গঠন ও পুনঃতফসিল করতে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা দিচ্ছে। এজন্য অনেক খেলাপি সুবিধা নিতে ঋণ পরিশোধ করছে না। এসব কারণে খেলাপি ঋণ বাড়ছে।

তিনি বলেন, খেলাপি ঋণ কমাতে আদায় বাড়াতে হবে। সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্মকর্তাদের আদায়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করে দিতে হবে। যারা আদায় করতে পারবে না তাদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। এছাড়া খেলাপিরা ঋণ পরিশোধ না করলে তাদের সুযোগ সুবিধা বন্ধ করে দিতে হবে।

সাবেক এ গভর্নর বলেন, নানা কেলেঙ্কারির কারণে ব্যাংক খাতের অবস্থা খুব খারাপ। ঋণ খেলাপি এখন বড় ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। খেলাপিদের দৃশ্যমান শাস্তি আর সুশাসন নিশ্চিত করা ছাড়া ব্যাংক খাতের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা কঠিন বলে জানান তিনি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তৈরি করা সেপ্টেম্বর ’১৯ প্রান্তিকের সর্বশেষ প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯ লাখ ৬৯ হাজার ৮৮২ কোটি টাকা। এর মধ্যে অবলোপন বাদে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ লাখ ১৬ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ১১ দশমিক ৯৯ শতাংশ। অবলোপনসহ খেলাপি ঋণের পরিমাণ দেড় লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। গত বছর একই সময়ে (সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে) খেলাপি ঋণ ছিল ৯৯ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা। এ হিসাবে গত এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৬ হাজার ৯১৮ কোটি টাকা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, জুন প্রান্তিকের তুলনায় সেপ্টেম্বরে অর্থাৎ গত তিন মাসে সরকারি, বেসরকারি ও বিদেশি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে। বিশেষায়িত ব্যাংকে সামান্য কমেছে।

সেপ্টেম্বর ‘১৯ শেষে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাণিজ্যিক (সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী, বেসিক ও বিডিবিএল) ব্যাংকগুলোর খেলাপি দাঁড়িয়েছে ৫৪ হাজার ৯২২ কোটি টাকা, যা জুন শেষে ছিল ৫৩ হাজার ৭৪৪ কোটি টাকা। সেপ্টেম্বর শেষে বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৫৪ হাজার ৫৭৪ কোটি টাকা। গত জুন শেষে ছিল ৫১ হাজার ৯২৪ কোটি টাকা।

বিদেশি ব্যাংকগুলোর খেলাপি দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৯১ কোটি টাকা। জুন শেষে ছিল ২ হাজার ৫৭ কোটি টাকা। এবং বিশেষায়িত দুই ব্যাংকের খেলাপি ঋণ কমে ৪ হাজার ৪০০ কোটি টাকা হয়েছে, যা জুনে ছিল ৪ হাজার ৬৯৬ কোটি টাকা।

নানা উদ্যোগের পরও কমছে না খেলাপি ঋণ। তাই আর্থিক বিবরণী ভালো দেখাতে দ্রুত অবলোপন (রাইট অব) মাধ্যমে কাগজে-কমলে খেলাপি ঋণ কমাতে চাচ্ছে ব্যাংকগুলো। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠক করে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) এ প্রস্তাব দেয়।

বর্তমানে তিন বছরের মন্দ মানের খেলাপি ঋণ স্থিতিপত্র থেকে বাদ দিতে অবলোপন করার সুযোগ রয়েছে। এটি দেড় বছর করার দাবি করেছেন এমডিরা। শর্ত সাপেক্ষে বিষয়টি বিবেচনা করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *