গণমাধ্যমকে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোতে আনার তাগিদ

banglashangbad

গণমাধ্যমের প্রাতিষ্ঠানিক কোনো কাঠামো নেই। মালিকদের বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মতো এটি একটি ব্যবসা। তাদের অন্য প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন সুযোগ থাকলেও কিন্তু এখানে কোনো গ্রাচুইটি বা বেতন বৃদ্ধি নেই। এমনকি অনেক প্রতিষ্ঠানে মাসের পর মাস বেতন হয় না। তাই এই মাধ্যমকেও একটা প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোতে আনার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বিশিষ্টজনরা।

বৃহস্পতিবার (২৪ অক্টোবর) প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশে (পিআইবি) ‘সম্প্রচার গণমাধ্যমের সংকট’ শীর্ষক এক মতবিনিময় সভায় খাত সংশ্লিষ্টরা এসব কথা বলেন। ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট সেন্টার ও প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ যৌথভাবে এ আলোচনার আয়োজন করে।

অনুষ্ঠানে টেলিভিশন মালিকদের উদ্দেশ্যে তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেন, সাংবাদিক ভাইদের বঞ্চিত করবেন না। তারা অনেক কষ্ট করে চ্যানেলগুলো চালায়। তারা যদি সবাই একযোগে স্ট্রাইক করে তবে কী হবে? অনেক মালিকপক্ষই তা বুঝতে পারে না। আমি স্ট্রাইক করার পক্ষে বলছি না। কিন্তু এটি তো চাইলেই তারা করতে পারেন, সেটি তারা করছেন না, সেজন্য তাদের ধন্যবাদ জানাই। খেয়ে না খেয়ে, তিন-চার মাস বেতন না পেয়ে এবং শিশুকে স্কুলে রেখে বা হসপিটালে দিয়েও তারা সংবাদ সংগ্রহ করছেন। টেলিভিশনের জন্য কাজ করছেন। তাদের সেই দরদটা অনুধাবন করবেন। অনুধাবন করে সাংবাদিক ভাইদের কেউ বঞ্চিত করবেন না। অহেতুক কারো চাকুরিচ্যুতি ঘটবে না এটাই আমার প্রত্যাশা।

তিনি বলেন, তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে সম্প্রচার আইন বহু আগেই আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। তবে আইন মন্ত্রণালয় থেকে এখনও প্রতি-উত্তর আসেনি। গণমাধ্যমকর্মী আইন নিয়ে অগ্রগতি আছে। বেশ অগ্রগতি হয়েছে। খুব সহসাই তা পার্লামেন্ট হয়ে পাস হয়ে আসবে। সেখানে গণমাধ্যমকর্মীদের শ্রমিক হিসবে যে আখ্যা দেওয়া হয়ছিল, তা থাকবে না।

তিনি আরও বলেন, টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর জন্য অষ্টম ওয়েজ বোর্ডের আলোকে একটি নীতিমালা তৈরি করা দরকার। প্রত্যেক কর্মীকেই নিয়োগপত্র দেয়া উচিত।

অনুষ্ঠানে একাত্তর টিভির সিইও মোজাম্মেল বাবু বলেন, দেশে অহেতুক চ্যানেল বাড়িয়ে লাভ নেই। চ্যানেলগুলো পরিচালনার জন্য সঠিক কাঠামো তৈরি করতে হবে। গণমাধ্যমকে রাষ্ট্রীয় প্রোটেকশন দিতে হবে। বর্তমানে যে বাজার রয়েছে সেই পরিস্থিতিতেও সবকটি চ্যানেল উইন উইন সিচুয়েশনে থাকতে পারে। সেজন্য সরকারের সহযোগিতা প্রয়োজন।

ব্রডকাস্ট জার্নালিস্টের চেয়ারম্যান রেজওয়ানুল হক রাজা বলেন, ওয়েজ বোর্ড বাস্তবায়নে মালিকদের সরকারের চাপ দেওয়া উচিত। গণমাধ্যমকর্মী আইন বাস্তবায়ন হলে আমাদের অনেক অধিকার রক্ষা পাবে।

সারাবাংলা ডটনেট ও জিটিভির এডিটর ইন চিফ সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা বলেন, গণমাধ্যমের প্রাতিষ্ঠানিক কোনো কাঠামো নেই। মালিকদের বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মতো এটি একটি ব্যবসা। তাদের অন্য প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন সুযোগ থাকলেও এখানে কোনো গ্রাচুইটি বা বেতন বৃদ্ধি নেই। গণমাধ্যমকর্মীদের বেতন হয় না, বেতন অনিয়মিত, তবু কী অনুষ্ঠান বন্ধ থাকে? সংবাদ বন্ধ থাকে? সন্তানকে দুধ দিতে না পেরে, স্ত্রীকে হাসপাতালে রেখেও আমাদের কর্মীরা অফিস করেন বেতন না পেলেও। তার এই ডেডিকেশনের মূল্য কখনও সাংবাদিকরা পায় না, বিশেষ করে টেলিভিশন সাংবাদিকরা।

তিনি বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশের আকাঙ্ক্ষিত সরকার ক্ষমতায়, উদার-অসাম্প্রদায়িক সরকার ক্ষমতায়, কিন্তু বাংলাদেশের গণমাধ্যম আজ সবচেয়ে বেশি বিপর্যস্ত অবস্থায় আছে। কিন্তু কী কারণে তারা কেন উদ্যোগ নেননি এ জায়গায়, সেটাও কিন্তু আমাদের জিজ্ঞাসার ব্যাপার। আমরা এই উত্তরাটা চাই আমাদের সরকারের কাছে। বলা হয়, সবচেয়ে গণমাধ্যমবান্ধব সরকার, তাহলে কেন আমাদের জন্য একটি আইন আজ পর্যন্ত হলো না। ২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর একটি কমিটি করে দেওয়া হলো, অনলাইনের জন্য নীতিমালা করতে। কিন্তু আজ পর্যন্ত সেই অনলাইনের নীতিমালা হয়নি। ২০১০ সাল থেকে চেষ্টা করে ব্রডকাস্ট সম্প্রচার আইন করা হয়েছে, ড্রাফট দেওয়া হয়েছে, সেটি আসেনি।

তিনি আরও বলেন, গণমাধ্যমকর্মী আইনে সব স্টেকহোল্ডারকে নিয়ে মতামত দেওয়া হয়েছে, কিন্তু এখনও হয়নি। বাংলাদেশের মানুষের মনে আজ উন্নয়নের স্পৃহা জেগেছে শেখ হাসিনার সরকারের কারণে। বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের মহাসড়কে হাঁটছে। এই উন্নয়নের বার্তা আমরা মানুষের কাছে পৌঁছে দেই, বিশ্বের কাছে পৌঁছে দেই। কিন্তু বাংলাদেশের মিডিয়ার কোনো পরিবর্তন নেই, উন্নয়ন নেই। আজ যদি মিডিয়াকে শুধু লাভ-ক্ষতির বিচারে দেখা হয়, তাহলে আমি বলবো বাংলাদেশের মিডিয়া না থাকাই ভালো। যে মালিক তার সব ব্যবসার প্রোটেকশন দেয়, সুরক্ষা নেয় মিডিয়ার মাধ্যমে গণমাধ্যমকর্মীদের ব্যবহার করে, সেই গণমাধ্যমকর্মীদের কোনো সুরক্ষা নেই। আমার মনে হয় তাদের আত্মজিজ্ঞাসার সময় এসেছে তারা কোন পথে হাঁটবেন?

অনুষ্ঠানে আয়োজকদের পক্ষে জানানো হয়, কমপক্ষে ১৮টি চ্যানেলে ২ থেকে ৫ বছর ধরে ইনক্রিমেন্ট বন্ধ। এক থেকে তিন মাসের বকেয়া আছে ৮ থেকে ১০টি চ্যানেলে। ছয় মাসের বকেয়া আছে দুটি চ্যানেলে। গত এক বছরে কমপক্ষে ৯টি চ্যানেল থেকে জনবল ছাঁটাই করা হয়েছে। বার্তা বিভাগ বন্ধ করা দেওয়া হয়েছে একটি চ্যানেলে। ৩০টি টিভি চ্যানেলের ২৮টিতে নেই গ্রাচুইটি, ২৫টিতে নেই প্রভিডেন্ট ফান্ড। বিজ্ঞাপনের বড় একটি অংশ ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম বা দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। দ্রুত গণমাধ্যমকর্মী আইন বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন।

পিআইবির মহাপরিচালক জাফর ওয়াজেদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন বিএফইউজে’র সভাপতি মোল্লা জালাল, ডেইলি অবজারভারের সম্পাদক ইকবাল সোবহান চৌধুরী, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) সাধারণ সম্পাদক সোহেল হায়দার চৌধুরী, একাত্তর টিভির হেড অব কনটেন্ট নূর সাফা জুলহাজ প্রমুখ।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *