চার লাখ টাকা খরচ করে পাঁচ মাস আগে ক্লিনারের কাজ নিয়ে সৌদি আরব গিয়েছিলেন নরসিংদীর মো. মিন্টু মিয়া। একদিন কাজ শেষে রুমে ফেরার সময় পুলিশ ধরে তাকে। তখন আকামা (কাজের অনুমতিপত্র) দেখানোর পরও ছাড় পাননি তিনি। সৌদি পুলিশ তাকে ধরে ফেরত পাঠিয়েছে স্বদেশে। শূন্য হাতে দেশে ফিরে নিজের সেই দুর্ভাগ্যকেই যেন দুষছিলেন মিন্টু মিয়া।
শনিবার (১৮ জানুয়ারি) সৌদি এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে দেশে ফেরেন নরসিংদীর এই বাসিন্দা। এদিন সৌদি এয়ারলাইন্সেরই দুটি ফ্লাইটে দেশে ফিরেছেন মিন্টুসহ ২২৪ জন।
রাত ১১টা ২০ মিনিটে এসভি ৮০৪ ফ্লাইটে ফেরেন ১০৮ জন। তার আগে দুপুর ১২টা ২০ মিনিটে এসভি ৮০৮ ফ্লাইটে ফেরেন আরও ১১৬ জন। এ নিয়ে নতুন বছরের ১৮ দিনে সৌদি থেকে দেশে ফিরেছেন ১ হাজার ৮৩৪ জন।
বরাবরের মতো শনিবারও যারা ফেরত আসেন, তাদের প্রবাসীকল্যাণ ডেস্কের সহযোগিতায় জরুরি সহায়তা দেয় ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম।
এদিন দেশে ফেরা বরিশালের আগৈলঝরা উপজেলার শামীম (৩০) জানান, মাত্র তিন মাস আগে তিন লাখ টাকা খরচ করে সৌদি আরব গিয়েছিলেন ড্রাইভিং ভিসা নিয়ে। সেখানে দুই মাস কাজ করলেও কোনো বেতন পাননি। পরে কফিলকে (নিয়োগকর্তা) বারবার অনুরোধ করলে তিনি অন্য জায়গায় কাজের ব্যবস্থা করে দেন। কিন্তু সেখানে কর্মরত অবস্থায় পুলিশ শামীমকে আটক করে। এ সময় কফিলকে ফোন দিলেও তিনি কোনো দায়িত্ব নেননি শামীমের।
নরসিংদীর মিন্টু মিয়া জানান, চার লাখ টাকা খরচ করে পাঁচ মাস আগে ক্লিনারের কাজ নিয়ে সৌদি গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সেখানে কাজ শেষে রুমে ফেরার সময় পুলিশ ধরে তাকে। আকামা দেখানোর পরও তাকে দেশে ফেরত পাঠানো হয়।
শামীম-মিন্টুর মতোই ফিরতে হয়েছে পটুয়াখালীর শাহিন সরদার, ময়মনসিংহের মো. আশরাফুল, মো. সুমন ও শফিক, নরসিংদীর সালাউদ্দিন, মানিকগঞ্জের আমিনুল, মুন্সিগঞ্জের মামুন কবিরসহ অনেককে, যারা এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে ফিরতে বাধ্য হয়েছেন।
ব্র্যাক অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান শরিফুল হাসান জানান, দেশে ফেরত আসা কর্মীরা বরাবরেই মতো অভিযোগ করেছেন, তাদের প্রত্যেককে নানা স্বপ্ন দেখিয়েছিল দালাল চক্র ও রিক্রুটিং এজেন্সি। কিন্তু সৌদি আরবে গিয়ে নানা সমস্যায় পড়েন তারা। অনেকে বেতন পাননি। অনেকে সৌদি আরব যাওয়ার কয়েক মাসের মধ্যে ফেরত এসেছেন। তারা সবাই ভবিষ্যত নিয়ে এখন দুশ্চিন্তায়।
শরিফুল হাসান আরও জানান, ২০১৯ সালে ২৫ হাজার ৭৮৯ বাংলাদেশিকে সৌদি আরব থেকে ফেরত পাঠানো হয়েছে। নতুন বছরের শুরুর ১৮ দিনে ১ হাজার ৮৩৪ জন বাংলাদেশি ফিরলেন দেশটি থেকে। ফেরত যারা এসেছেন, তাদের সবার ভোগান্তির বর্ণনা প্রায় একইরকম। প্রায় সবাই খালি হাতে ফিরেছেন। কয়েকমাস আগে গিয়েছিলেন এমন লোকও আছেন।
প্রবাসী কল্যাণ ডেস্কের তথ্য অনুযায়ী ২০১৯ সালে মোট ৬৪ হাজার ৬৩৮ জন অভিবাসী কর্মী দেশে ফিরেছেন। এর মধ্যে সৌদি আরব থেকে ২৫ হাজার ৭৮৯ জন, মালয়েশিয়া থেকে ১৫ হাজার ৩৮৯ জন, সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে ৬ হাজার ১১৭ জন, ওমান থেকে ৭ হাজার ৩৬৬ জন, মালদ্বীপ থেকে ২ হাজার ৫২৫ জন, কাতার থেকে ২ হাজার ১২ জন, বাহরাইন থেকে ১ হাজার ৪৪৮ জন ও কুয়েত থেকে ৪৭৯ জন শূন্য হাতে ফিরেছেন, যাদের পরিচয় ডিপোর্টি।
শরিফুল হাসান বলেন, কেউ যখন বিদেশে যান, তখন পরিবার-স্বজন সবাই খুশি হন। কিন্তু ফেরত আসা মানুষগুলোর পাশে সেভাবে থাকেন না। এমনকি পরিবারের সদস্যরাও তাদের নানা কটূ কথা বলেন। অথচ এই সময় তাদের পাশে সবার দাঁড়ানো উচিত। ফেরত আসা প্রবাসীদের আমরা শুধু বিমানবন্দরে সহায়তা দিয়েই দায়িত্ব শেষ করছি না, তারা যেন ঘুরে দাঁড়াতে পারেন, সেজন্য কাউন্সেলিং, দক্ষতা প্রশিক্ষণ ও আর্থিকভাবেও পাশে থাকার চেষ্টা করছি। সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা সবাই মিলে কাজটি করতে হবে। পাশাপাশি এভাবে যেন কাউকে শূন্য হাতে ফিরতে না হয় সেজন্য রিক্রুটিং এজেন্সিকে দায়িত্ব নিতে হবে। দূতাবাস ও সরকারকেও বিষয়গুলো খতিয়ে দেখতে হবে। বিশেষ করে ফ্রি ভিসার নামে প্রতারণা বন্ধ করা উচিত।