চট্টগ্রাম কারাগারে ইয়াবাসহ মাদক বিস্তারে জড়িত রক্ষী-বন্দিরা


চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের অভ্যন্তরে কারারক্ষী ও বন্দিরা নানা কৌশলে মাদক নিয়ে প্রবেশ করে। বন্দি শীর্ষ সন্ত্রাসীসহ মাদকসেবী হাজতি-কয়েদিরা জড়িয়ে পড়ছে মাদকসেবন ও ব্যবসায়।

এছাড়া চট্টগ্রাম কারাগারে কারাবিধি লঙ্ঘন করে হাজতি-কয়েদিরা মোবাইল ফোন ব্যবহার করছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে মাদক সরবরাহের অভিযোগে ইয়াবাসহ গ্রেফতার এক কারারক্ষীসহ ৪ জনকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে কারাভ্যন্তরে মাদকের প্রবেশ ও বিকিকিনির বিষয়টি ওঠে এসেছে।

অভিযোগ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার মো. নাশির আহমেদ সোমবার বিকালে যুগান্তরকে বলেন, যাদের নিয়ে মাদক নিয়ন্ত্রণ করব, তাদের কেউ যদি মাদক পাচার বা ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে, তা খুবই দুঃখজনক। তবে এরপরও কারারক্ষীসহ যে কোনো পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী কিংবা বন্দি যদি কারাভ্যন্তরে মাদকসেবন ও ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ে, তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।

শনিবার নগরীর কোতোয়ালি থানার কদমতলী ফ্লাইওভারের ওপর একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশায় তল্লাশি চালিয়ে কারারক্ষী সাইফুল ইসলামকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এ সময় তার পকেট থেকে ৫০ পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ওই কারারক্ষীকে গ্রেফতার করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সাইফুল স্বীকার করেছেন কারাবন্দি শীর্ষ সন্ত্রাসী নুরুল আলম ওরফে হামকা আলমের জন্যই তিনি ওই ইয়াবা সংগ্রহ করেন। তিনি এভাবে কারাভ্যন্তরে সন্ত্রাসীদের কাছে ইয়াবা সরবরাহ করেন। কারারক্ষী ছাড়াও জমাদার, দফাদারসহ অনেকেই এই ব্যবসা করেন।

এদিকে কারারক্ষী সাইফুলসহ গ্রেফতার চার আসামিকে একদিনের রিমান্ডে নেয়ার আদেশ দিয়েছেন আদালত। পুলিশের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সোমবার চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার জাহান এই আদেশ দেন। চার আসামি হল- কারারক্ষী সাইফুল ইসলাম (২২), মাদক বিক্রেতা দিদারুল আলম মাছুম ওরফে আবু তালেব মাছুম (৩৫), আজিজুল ইসলাম জালাল (৩৬) ও আলো বেগম (৩৫)।

গ্রেফতার কারারক্ষী সাইফুল পুলিশকে জানান, কারাবন্দি ভয়ংকর সন্ত্রাসী নুর আলমের জন্য নগরীর লালদিঘীর পাড় এলাকার মাছুমের কাছ থেকে তিনি (সাইফুল) ৫০ পিস ইয়াবা সংগ্রহ করেছিলেন। নুরুল আলমের নির্দেশে নগরীর হালিশহর কাঁচাবাজার এলাকায় লিটন নামে একজনকে ২ হাজার টাকার বিনিময়ে ১০ পিস ইয়াবা দিতে যাওয়ার পথে সাইফুল ধরা পড়ে। তার স্বীকারোক্তি অনুযায়ী গ্রেফতার হয় আরও তিনজন। সন্ত্রাসী নুরুল আলমের বিরুদ্ধে নগরীর বিভিন্ন থানায় ১০টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে দুটি মামলায় ১৭ বছরের সাজা ভোগ করছেন। দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা আর্থিক সুবিধা নেয়ার কারণে অনিয়মের আখড়ায় পরিণত হয়েছে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার। কারাগারের ৩২ নম্বর সেলের ৩ নম্বর কক্ষে থাকেন নুরুল আলম। গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদে সাইফুলের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী অন্যদের গ্রেফতার করে কোতোয়ালি থানা পুলিশ।

কোতোয়ালি থানার ওসি মোহাম্মদ মহসিন যুগান্তরকে বলেন, কারারক্ষীর মাধ্যমে চট্টগ্রাম কারাগারের ভেতরে বন্দিদের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে ইয়াবা-গাঁজাসহ বিভিন্ন ধরনের মাদক। কারাগারে মাদকসেবন তো চলছেই। এমনকি বন্দিদের কেউ কেউ আবার সেখানে বসেই মাদক ব্যবসা পরিচালনা করছে। কারাবিধি লঙ্ঘন করে কারাগারের ভেতরে বন্দিরা মোবাইলও ব্যবহার করছে। মোবাইল ফোনের মাধ্যমেই চলছে তাদের মাদক ব্যবসা। কারারক্ষী সাইফুলকে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করলে এসব তথ্য জানিয়েছেন তিনি।

সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে নানা কৌশলে ইয়বাসহ মাদকদ্রব্য পাচার করা হচ্ছে। হাজতিরা চট্টগ্রাম আদালতে হাজিরা দিতে এলে ঢোকার সময় মাদক নিয়ে যাচ্ছে। কারারক্ষীরাও মাসোহারার বিনিময়ে মাদক নিয়ে বন্দি সন্ত্রাসী ও মাদকসেবীদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে। কারারক্ষীর কাছ থেকে ইয়াবা উদ্ধারের পর রোববার নুর মোহাম্মদ (১৯) নামে এক হাজতির কাছ থেকে ৩৫০ পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় পুরো কারাগারে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। এ ঘটনায় কোতোয়ালি থানায় নুর মোহাম্মদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।

সূত্র আরও জানায়, গ্রেফতার কারারক্ষী সাইফুল দীর্ঘদিন ধরে কারাগারে মাদক সরবরাহ করে আসছিলেন। এসব মাদক কারা অভ্যন্তরে পৌঁছে দেয়ার বিনিময়ে নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা পেতেন। জুতার তলায় করে বিশেষ কায়দায় ইয়াবা ও গাঁজার পুঁটলি নিয়ে তিনি সন্ত্রাসী আলমের কাছে পৌঁছে দিতেন। কারাগারে প্রতি পিস ইয়াবা ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকায় বিক্রি হয়। গাঁজার পুঁটলি সাইজ অনুযায়ী ৫০ থেকে ১০০ টাকায় বিক্রি হয়। বড় সাইজের পুঁটলি বস্তা নামে পরিচিত। যার প্রতিটি ২৫০ টাকায় বিক্রি করা হয়। ২০১৬ সালের ১৬ আগস্ট আদালতে হাজিরা থেকে ফেরার পথে কারাগারে প্রবেশের সময় ৪০০ পিস ইয়াবা ও ৩ কেজি গাঁজাসহ ধরা পড়েছিলেন সন্ত্রাসী নুরুল আলম ওরফে বাচা ওরফে বাচাইয়্যা। সূত্র জানায়, সেলে দায়িত্বরত জমাদার, সুবেদার, কারারক্ষী সবাইকে নিয়মিত টাকা দেন সন্ত্রাসী ও ইয়াবাসেবীরা।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *