চীনে যুগান্তকারী প্রযুক্তি ব্লকচেইন চালু, ডলারকে হারিয়ে নতুন বিশ্ব আনবে?


জাতীয় পর্যায়ে ব্লকচেইন চালু করেছে চীন। ব্লকচেইনবেইজড সার্ভিস নেটওয়ার্ক (বিএসএন) নামের এই ব্লকচেইন নেটওয়ার্কটি গত শনিবার থেকেই চালু হয়েছে। আসছে জুনে তা বৈশ্বিকভাবে উন্মোচন করা হবে। এর মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী ডিজিটাল মুদ্রার লেনদেনে পরিবর্তন আসতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

বিএসএন হচ্ছে চীনের জাতীয় ব্লকচেইন কৌশলের সবচেয়ে ক্রিটিক্যাল অংশ, যা গত অক্টোবরে ঘোষণা করেছিলেন দেশটির প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। বিএসএনকে বিশ্বব্যাপী পাবলিক ইনফ্রাস্ট্রাকচার নেটওয়ার্ক হিসেবে নকশা করা হয়েছে। এটির লক্ষ্য হলো ধারাবাহিকভাবে ব্লকচেইন অ্যাপ্লিকেশনগুলোর উন্নয়ন, স্থাপনা, পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ, ব্লকচেইনের নিয়ন্ত্রণ ও এটির ব্যবহার ব্যয়কে হ্রাস করা। এটি ব্যবহারকারীদের চেইনগুলো বেছে বেছে প্লাগ ইন করতে এবং কোড করতে পারবে। দেশটির সরকারের হোয়াইট পেপার থেকে এই তথ্য জানা গেছে।

ব্লকচেইন হচ্ছে তথ্য সংরক্ষণ করার একটি নিরাপদ এবং উন্মুক্ত পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে তথ্য বিভিন্ন ব্লকে একটির পর একটি চেইন আকারে সংরক্ষণ করা হয়। এটি একটি অপরিবর্তনযোগ্য ডিজিটাল লেনদেন যা শুধুমাত্র অর্থনৈতিক লেনদেনের জন্যই প্রযোজ্য নয়। এ প্রযুক্তি ব্যবহার করে যেকোনো কার্য-পরিচালনা রেকর্ড করা যেতে পারে। এটা এমন একটি বণ্টনযোগ্য ডাটাবেজ যাতে অংশগ্রহণকারী পক্ষগুলোর মধ্যে সব লেনদেনের নথি করে রাখা যায়। প্রতিটি লেনদেন আবার সিস্টেমের সংখ্যাগরিষ্ঠতা দ্বারা যাচাই করা হয়। একবার লেজারে কোনো তথ্য প্রবেশ করলে স্থায়ীভাবে তা থেকে যায় এবং কখনো মুছে ফেলা যায় না। ব্লকচেইন প্রতিটি একক লেনদেনের যাচাইযোগ্য রেকর্ড নিয়ে গঠিত হয়। এই অন্তর্নিহিত প্রযুক্তি নির্ভুলভাবে কাজ করে এবং বিভিন্ন কাজে এটির প্রয়োগ করা যেতে পারে।

অন্যান্য ডাটা বেইসের মতো ব্লকচেইনেও রেকর্ড হিসেবে তথ্য সংরক্ষণ করা হয়। প্রতিটি রেকর্ডকে বলা হয় ব্লক। প্রতিটি ব্লকে তথ্যের সঙ্গে পূর্ববর্তী ব্লকের ক্রিপ্টোগ্রাফিক হ্যাশ এবং টাইম স্টাম্প যুক্ত করা থাকে, পাশাপাশি আরো থাকে ট্রানজেকশন ডাটা। ‘ক্রিপ্টোগ্রাফিক হ্যাশ’ হচ্ছে, একটি ব্লক তৈরির পর তার বিশেষত্বগুলো নিয়ে তৈরি করা একটি কোড। কোনো কারণে যদি ব্লকটিতে পরিবর্তন করা হয়, তাহলে তার ক্রিপ্টোগ্রাফিক হ্যাশও বদলে যায়। ব্লকে থাকা রেকর্ড কোনো ব্যক্তি কখন যুক্ত বা পরিবর্তন করেছেন তা দেওয়া থাকে টাইম স্টাম্প এবং ট্রানজেকশন ডাটায়। আর ব্লকগুলো পরস্পরের সঙ্গে মিলে তৈরি হয় ‘ব্লকচেইন’। তথ্যের পরিমাণ যত বাড়বে, চেইনে তত বেশি ব্লক যুক্ত হবে। চেইনে প্রয়োজনে অসীম সংখ্যক ব্লকও যুক্ত করা সম্ভব।

যখন ব্লকচেইনের তথ্য কোনো ব্যবহারকারী দেখবেন বা পরিবর্তন করতে চাইবেন, তখন তার কাছে পুরো চেইনটিই পাঠানো হবে। এভাবে কোনো কেন্দ্রীয় সার্ভার ছাড়া শুধু ব্যবহারকারীদের ডিভাইসে অগণিত কপি সংরক্ষণের মাধ্যমে ব্লকচেইন টিকে থাকতে পারে। এ ধরনের সার্ভারবিহীন তথ্য সংরক্ষণ ও আদান-প্রদানের উপায়কে বলা হয় ‘পিয়ার টু পিয়ার নেটওয়ার্কিং’। পুরো চেইনের প্রতিটি কপি যে ডিভাইসগুলোতে আছে, তাকে বলা হয় ‘নোড’। প্রতিবার নতুন ব্লক যুক্ত বা পরিবর্তন হলে প্রতিটি নোডেই সঙ্গে সঙ্গে তা আপডেট করা হবে। ফলে নতুন তথ্য প্রত্যেক ব্যবহারকারীর কাছে পৌঁছে যাবে নিমেষেই।

গত বছরের অক্টোবরে এটির বিটা পরীক্ষা শুরু হয়। এরপর গত বুধবার শেষ হয়। আর শনিবার থেকে দেশটিতে এটি চালু হয়। নেটওয়ার্কটি চ্যারিটি, আইটেম ট্রেসেবিলিটি, ইলেকট্রনিক চালান, কপিরাইট সুরক্ষা এবং সরবরাহ শৃঙ্খলা ব্যবস্থাপনার মতো উদ্ভাবনী অ্যাপ্লিকেশনগুলোর একটি ব্যাচকে নিয়ন্ত্রণ করেছে সফলতার সঙ্গে। এই নেটওয়ার্কটি আটটি বিদেশি ও একশ ২৮টি সরকারি সিটি নোড স্থাপন করেছে। মূলধারার ক্লাউস সার্ভিস প্রদানকারীরাও এটির সেবায় অন্তর্ভুক্ত ছিল। স্মার্ট সিটি ও ডিজিটাল অর্থনীতির উন্নয়নে শক্ত ভিত্তি স্থাপনের জন্য বিএসএনের প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন ও পারফরম্যান্স অপ্টিমাইজেশন বৃদ্ধিতে আরো ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বিএসএনের প্রতিষ্ঠাতা কনসোর্টিয়ার অংশীদার হলো চীনের স্টেট ইনফরমেশন সেন্টার (চীনের শীর্ষ পর্যায়ের সরকারি নীতি ও কৌশলবিষয়ক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড রিফর্ম কমিশনের সঙ্গে যুক্ত), চায়না মোবাইল (নয় হাজার মিলিয়নেরও বেশি গ্রাহক নিয়ে চীনের বৃহত্তম জাতীয় টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা), চীন ইউনিয়নপে (শীর্ষস্থানীয় পেমেন্টবিষয়ক প্রতিষ্ঠান) এবং রেড ডেট টেকনোলজিস (বিএসএনের প্রধান ব্লকচেইন স্থপতি)।

বিএসনের প্রোটোকলটি দিয়ে যে অপারেটিং পরিচালনা করবে তার স্বার্থ রক্ষার জন্য শক্তিশালী ক্রিপ্টোগ্রাফিক সুরক্ষা এবং গোপনীয়তা ব্যবস্থা তৈরি করা হয়েছে। এটির মূল টিসিপি / আইপি ইন্টারনেট প্রোটোকলের মতোই। যা মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডিফেন্স অ্যাডভান্সড রিসার্চ প্রজেক্ট এজেন্সি সামরিক উদ্দেশ্যে তৈরি করেছিল। তবে এখন পুরো বিশ্ব বাণিজ্যিকভাবে এবং ব্যক্তিগতভাবে ব্যবহার করছে। বিএসএনের ব্লকচেইন ব্যবহার করা যাবে কম খরচে। তাই এই উদ্ভাবন ক্ষুদ্র ও মাঝারি আকারের উদ্যোক্তা এবং ব্যক্তিদের উত্সাহিত করবে। এর ফলে ব্লকচেইন প্রযুক্তির দ্রুত বিকাশ ও ব্যাপক ব্যবহার বাড়বে।

ব্লকচেইনে বিনিয়োগ করে চীন প্রযুক্তিখাতে উঁচু জায়গায় যাওয়ার সুযোগ দেখছে। যেহেতু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পিছিয়ে রয়েছে। এদিকে, আবার চীনের সরকার নিয়ন্ত্রিত ডিজিটাল মুদ্রা কেবল ডিজিটাল লেনদেনের সুবিধাগুলোই দেবে এমন নয়। পাশাপাশি কোথায় অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে এবং কারা ব্যয় করছে, অর্থ পাচার বন্ধ এবং নজরদারি বৃদ্ধি করতে পারবে বিএসনের মাধ্যমে। এটি সরকারকে অর্থ সরবরাহের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে সহায়তা করবে। এটি চীনের নগদ লেনদেনহীন সমাজের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবে। কারণ ২০১৭ সালে চীনা প্রাপ্তবয়স্কদের ৮২ শতাংশই ডিজিটাল অর্থ দিয়ে লেনদেন করেছেন।

চীন সরকারের হোয়াইট পেপার অনুসারে জানা যায়, বিএনএসের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের দুটি প্রধান অংশ রয়েছে। প্রথমটি হলো তথাকথিত পাবলিক সিটি নোডগুলো, প্রয়োজনীয় ডেটা সেন্টারগুলো বা ক্লাউড কম্পিউটিং সংস্থাগুলো নির্দিষ্ট শহরগুলোতে স্থাপন করা। আর দ্বিতীয় অংশটি হলো ক্রিপ্টোগ্রাফি এবং সফ্টওয়্যার ডেভলপমেন্ট কিটসের (এসডিকে) মতো ইউনিফর্ম মানগুলোর জন্য এন্টারপ্রাইজ ব্লকচেইন প্রোটোকলের কনফিগারেশন করা ও পরিবর্তন আনা। যাতে এই সিস্টেমগুলো একে অপরের সঙ্গে একযোগে কাজ করতে পারে।

চীনের এই বিএসএন আদর্শের দ্বিধা-দ্বন্দ্বের কারণে ভাগ হয়ে থাকা বৈশ্বিক বাণিজ্য ও দ্বিপক্ষীয় অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপকে সহজতর করতে পারে। এটি বর্তমানের এই সময়ে আন্তঃসীমান্ত বাণিজ্য, বিনিয়োগ এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে। ডিজিটালভাবে অনলাইনে ব্যবসা পরিচালনার ক্ষমতা বাড়াবে এই নেটওয়ার্ক।

নতুন আর্থিক যুগের সূচনা?

বিএসএন ভবিষ্যতের বিশ্বব্যাপী ডিজিটাল অর্থনীতিকে অনুপ্রেরণা যোগাবে। ডিজিটাল মুদ্রার লেনদেনে আমূল পরিবর্তন আসতে পারে এর কারণে। ব্লকচেইনের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্টের ডলারের প্রভাবকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিতে পারে চীন। এমনটি ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে ভয়েস অব আমেরিকার এক প্রতিবেদনে।

বিশ্বব্যাপী সরকার নিয়ন্ত্রিত ক্রিপ্টোকারেন্সি, ডিসি/ইপি নামে পারিচিত; আর্থিক প্রকল্প চালু হয়েছে প্রথম চীনেই। দেশটির এই পদক্ষেপটিই মৌলিক। মনে করা হচ্ছে, দেশটি এই উদ্যোগটিকে আগের চেয়ে আরো বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। অনলাইনে প্রকাশিত স্ক্রিনশটের ভিত্তিতে, এটি স্পষ্ট যে ক্রিপ্টো-ইউয়ান খুব দ্রুতই চালু করা হবে। আর বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি পুরো বিশ্বব্যাপী আর্থিক ব্যবস্থাকে পরিবর্তন করতে পারে।

২০১৪ সাল থেকে চীন ডিজিটাল মুদ্রাকে মার্কিন ডলারের মারপ্যাঁচ থেকে সরে যাওয়ার উপায় হিসেবে দেখে আসছে। এরপর থেকে ডিজিটাল মুদ্রা প্রযুক্তি নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে দেশটি। আর বর্তমানে একটি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় কৌশলগত লক্ষ্য হিসেবে দেখছে।

২০১৬ সালের জাতীয় অর্থনৈতিক পরিকল্পনাগুলোতে চীন উন্নত ব্লকচেইনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে। বিটকয়েনের মতো জনপ্রিয় ডিজিটাল মুদ্রার পেছনে প্রযুক্তি ব্যবহার করা জন্য পরিকল্পনা করে। এরপর ২০১৯ সালের অক্টোবর মাসে দেশটির প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ব্লকচেইনকে ‘অবশ্যই’ উন্নত করার জন্য পলিটব্যুরোতে প্রস্তাব রাখেন। আর গতকাল চীনজুড়ে চালু হয়েছে ব্লকচেইনের সবচেয়ে বড় নেটওয়ার্ক বিএসএন।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *