চীন–ভারত: যে যুদ্ধে জেতেনি ভারত


ভারতে লোকসভা নির্বাচন শুরু হয়েছে। ৯০ কোটি ভোটার নতুন ৫৪৩ জন সাংসদ নির্বাচন করবেন। এবারের লোকসভা নির্বাচনে প্রচারযুদ্ধের প্রধান বিষয় পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ-উন্মাদনা। বিজেপি সাধারণ ভারতীয়দের ‘যুদ্ধজয়’-এর আমেজ দিয়ে পুনরায় ভোট পেতে চেয়েছে। তবে মাঠের রক্তপাতের চেয়ে উত্তেজনা বেশি ছড়িয়েছে জনসভা ও প্রচারমাধ্যমে। অতি প্রচারিত এই যুদ্ধের মধ্যেই আরেক অপ্রচলিত যুদ্ধে ভারতীয়রা জড়িয়েছিল চীনের সঙ্গে। একতরফা সেই যুদ্ধের ফলাফল নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার কোথাও আলোচনা নেই। ভারতীয় সংবাদমাধ্যমেও তেমন নয়।
চীনা পণ্য পোড়ানো
চীনের কূটনীতিবিদেরা সম্প্রতি জাতিসংঘে শক্তভাবে পাকিস্তানের পক্ষ নেওয়ায় ভারতীয় জাতীয়তাবাদীরা ভীষণভাবে ক্ষুব্ধ। তাঁরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চীনের পণ্য বয়কটের ডাক দেন। চীনের পণ্যবিরোধী নানান হ্যাশট্যাগযুক্ত দাবিতে ভরে আছে ফেসবুক ও টুইটারের ভারতীয় পরিসর। দেশটির সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ইতিহাসে এটা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সাড়া ফেলা হ্যাশট্যাগ আন্দোলন।
জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের অংশ হিসেবে বিদেশি পণ্য পোড়ানোর ঐতিহ্য ভারতে বেশ শ্রদ্ধেয় ঐতিহ্য। সেখানকার প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর স্থানীয় নেতারা এবং অনেক প্রচারমাধ্যম এবারও চীনা পণ্য বয়কটের ডাকে নানাভাবে উৎসাহ জুগিয়েছে। এই আন্দোলনে ফেডারেশন অব ইন্ডিয়া ট্রেডার্সের (সিএআইটি) যুক্ত হওয়া ছিল বড় ঘটনা। এদের সদস্যসংখ্যা কোটির ওপরে। মার্চে তাঁরা সাংবাদিকদের ডেকে আন্দোলনের প্রথম দিন একই সঙ্গে প্রায় পনেরো শ স্থানে চীনের পণ্যে আগুন দেন।
Eprothom Aloপ্রতিবেশীকে একটা ‘শিক্ষা’ দেওয়াই এই উদ্যোগের লক্ষ্য ছিল। কিন্তু কার্যত তাতে প্রত্যাশিত সাড়া মিলছে না। বয়কট আন্দোলনের মধ্যেই ১৩ মার্চ চীনা ব্র্যান্ড শাওমির ১৪ হাজার রুপির নতুন মোবাইল ফোন ‘রেডিমি নোট ৭ প্রো’ ভারতীয় বাজারে আসার কয়েক মিনিটের মধ্যে সব বিক্রি হয়ে যায়।
যেভাবে শুরু পণ্য বর্জন আন্দোলন
চীনবিরোধী চলতি বয়কট আন্দোলনের পটভূমি তৈরি করে কাশ্মীরে ‘জইশ-ই-মুহাম্মদ’-এর আত্মঘাতী হামলা, যাতে ৪০ জন ভারতীয় সৈনিক মারা যান। এ ঘটনার পরই আক্রমণকারী সংগঠনের নেতা মাসুদ আজহারকে ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে নথিভুক্তির জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্স ২৭ ফেব্রুয়ারি নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাব আনে। মূলত ভারতীয় কূটনীতিবিদদের পরিশ্রমেই এটা ঘটে। কিন্তু চীন পদ্ধতিগত কিছু আপত্তি তোলে তাতে। ২০০০ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘জইশ-ই-মুহাম্মদ’-এর নেতা মাসুদ আজহার এখন পাকিস্তানে। এর আগেও তিনবার চীন মাসুদ আজহারকে ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে তালিকাভুক্তির আয়োজনে ভেটো দিয়েছিল। জাতিসংঘে চীনের সর্বশেষ অবস্থান মুখ্যত দক্ষিণ কোরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের মিসাইল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার পাল্টা হিসেবে। সেটা আন্তর্জাতিক কূটনীতিকদের অজানা নেই। কিন্তু চীনের ক্রমাগত পাকিস্তানবান্ধব ভূমিকায় ভারতীয়রা ক্ষুব্ধ। এখান থেকেই ভারতজুড়ে বয়কট আন্দোলনের বিস্তৃতি।
জনসাধারণের কাছে বয়কটকারীদের আবেদন ছিল চীন ছাড়া যেকোনো দেশের পণ্য কিনতে। অনেকে এই আবেদনের সঙ্গে বিপুল আবেগও যুক্ত করেন এই বলে, চীনের পণ্য কেনা মানে ভারতীয় নিহত সৈনিকদের রক্তের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা। কারণ, চীন পাকিস্তানকে সহায়তা দিচ্ছে। পণ্য বর্জনের পাশাপাশি বয়কটের অনেক প্রচারক তিব্বত ও তাইওয়ানকে স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতিরও আহ্বান জানান।
ভারতীয়দের তরফ থেকে চীনের পণ্য বর্জনের আহ্বান এবারই প্রথম নয়। ২০১৭ সালে সিকিম ও ভুটান–সংলগ্ন সীমান্তে উত্তেজনাকালে ভারতীয় জাতীয়তাবাদীরা একইভাবে চীনের জিনিসপত্র না কেনার আহ্বান জানিয়েছিলেন। অথচ সেই বছরই ভারতে দুই বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে চীন। আগের বছর চীনা বিনিয়োগ ছিল মাত্র ৭০০ মিলিয়ন ডলার।
যে কারণে ব্যর্থ হলো বয়কট
ভারত এখন বিশ্বের এক বিশাল বাজার। ভারতের মোট আমদানি পণ্যের ১৩–১৪ শতাংশই আসে চীন থেকে। ২০১৮ সালের শেষ ১০ মাসে ভারত পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে মোট ৩২ লাখ কোটি রুপির পণ্য আমদানি করেছে। তাতে চীনের হিস্যা ছিল ৪ দশমিক ২ লাখ কোটি রুপি। ভারতের মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশের ফলে সর্বশেষ এক দশকে মোট আমদানি বেড়েছে তিন গুণ। স্বভাবত চীন এই বাজার হারাতে চায় না, কিন্তু সে জন্য পাকিস্তান প্রশ্নে কৌশলগত অবস্থানও বদলাচ্ছে না।
পণ্যবাজারের সাধারণ চরিত্র সম্পর্কে চীনের বিশ্লেষকদের পরীক্ষিত ধারণা আছে। দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিটি দেশের একদম তৃণমূল পর্যন্ত নিত্যপণ্য ব্যবহারের ধরন ও চাহিদা সম্পর্কে তারা ওয়াকিবহাল। চীন জানে, দক্ষিণ এশিয়ার পণ্যের বাজারে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের মূল বিবেচ্য বিষয় পণ্যের দাম, সেটা কোন দেশে তৈরি তা তাদের বিবেচ্য নয়। দামের প্রতিযোগিতায় চীনা পণ্য এগিয়ে থাকার ফলেই ভারতীয়দের বয়কট আন্দোলন পরাজিত হতে চলেছে।
এক ভারতীয় টুইটার ব্যবহারকারী কৌতুক করে লিখেছেন, যাঁরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চীনা পণ্য বর্জনের ডাক দিচ্ছিলেন, তাঁদের অধিকাংশই চীনে তৈরি মোবাইল ফোন ব্যবহার করেই তা করছিলেন। ভারতীয় জাতীয়তাবাদীরা যখন সামাজিক মাধ্যমে দেশপ্রেমের ঝড় তুলছেন, তখন দ্য প্রিন্ট–এর এক প্রতিবেদনে দেখা গেল, স্থানীয় বিবাহিত হিন্দু নারীরা যে সিঁদুর ব্যবহার করেন, তাও চীন থেকে আসে। লুঙ্গি ও স্যান্ডেল থেকে শুরু করে ভারতীয় ধুতির বাজারও এখন চীনের দখলে। চীন থেকে প্রায় ৮ হাজার সামগ্রী আসছে ভারতে, যাতে আছে গণেশের মূর্তিও।
দেশি পণ্যের চেয়ে চীনা পণ্যের দাম কম হওয়ায় স্থানীয় ক্রেতা-বিক্রেতা সবাই চীনা পণ্যে আসক্ত। ভারত ও চীনে তৈরি একই গুণগত মানসম্পন্ন পণ্যের দামে ২০ শতাংশ পর্যন্ত পার্থক্য পাওয়া যায়। ফলে ভারতীয় সেনাদের রক্তের দোহাই দিয়েও ক্রেতাকে সস্তা পণ্য থেকে ফেরানো যায়নি। ভারতের অর্থনীতিবিদ রেনু কোহলির ভাষায়, ‘কেউই কম দামের পণ্য ছেড়ে বেশি দামের পণ্য কিনে পকেট খালি করতে চাইবে না।’ হিন্দুস্তান টাইমস–এর জরিপেও একই প্রবণতারই আভাস মিলল। নয় হাজার মানুষের মধ্যে পরিচালিত জরিপে ৮৩ ভাগ বলেছেন, সস্তায় পাওয়া যায় বলেই তাঁরা চীনের জিনিস কেনেন।
চীন বিরক্ত, তবে উদ্বিগ্ন নয়
বয়কট আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী অনেক ভারতীয় তাদের সরকারকে অনুরোধ করেছিল চীনের পণ্য আমদানিতে প্রশাসনিক বাধা আরোপ করতে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নিয়মনীতির কারণে এখন একতরফাভাবে এ রকম পদক্ষেপ নেওয়া সহজ নয়। উপরন্তু প্রায় ৯০ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য সম্পর্কের অংশীদার চীন-ভারত। তারপরও ভারতের শাসক মহলের অনেক নেতা আন্দোলনকারীদের উৎসাহ জোগাচ্ছেন। বিজেপির বন্ধু সংগঠন ‘স্বদেশি জাগরণ মঞ্চ’ এ ক্ষেত্রে সবার চেয়ে এগিয়ে। কিন্তু ভুলে যাওয়ার সুযোগ নেই, ভারতও প্রতিবছর চীনে প্রায় ৬০ হাজার কোটি রুপির পণ্য রপ্তানি করে, যা তার মোট রপ্তানির ৪ শতাংশ। এ রকম বর্জন সংস্কৃতিতে ভারতীয় অর্থনীতিও বিপর্যয়ে পড়বে, সেটা ভারতের রপ্তানিকারকেরা চাইবেন না।
তবে চীন সরকার বা নাগরিকেরা এখনো ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক দেননি। চীনকে উদ্বিগ্ন মনে হচ্ছে না। কারণ, ভারতে যায় তাদের রপ্তানি পণ্যের মাত্র ৩ শতাংশ। তবে তাদের বিরক্তি গোপন নেই। চীনের গ্লোবাল টাইমস-এ একজন মন্তব্যকারী ভারতীয় পণ্য বর্জন আন্দোলনের পাল্টা হিসেবে ব্রহ্মপুত্রসহ তিব্বত থেকে নেমে আসা নদ–নদীগুলোর পানি বন্ধ করার পরামর্শ দিয়েছেন।
এটা একটা বিধ্বংসী হুমকি এবং ভারতীয় নীতিনির্ধারকেরা জানেন, গ্লোবাল টাইমস–এ চীন সরকারের দৃষ্টিভঙ্গিরই প্রতিফলন ঘটে।
*আলতাফ পারভেজ দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে গবেষক