হবিগঞ্জের চুনারুঘাটে দুলা মিয়া নামে এক যুবককে অপহরণের পর হত্যা করা হয়েছে। আর এ হত্যার সাথে নিহতের ভাজিতা র্যাব-২ এর সদস্য সাদেক মিয়ার সংশ্লিষ্টতা পাওয়ার পর মঙ্গলবার (১৬ জুলাই) তাকে আটক করেছে চুনারুঘাট থানা পুলিশ।
নিহত দুলা মিয়া উপজেলা শানখলা ইউনিয়নের পাট্টাশরীফ গ্রামের মকসুদ আলীর পুত্র এবং এ হত্যার জড়িত মো. সাদেক মিয়া বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) একজন ল্যান্সনায়েক, প্রেষণে ঢাকায় র্যাব-২-এ কর্মরত। তাঁর গ্রামের বাড়িও চুনারুঘাটের পাট্টাশরীফে।
নিহত দুলা মিয়ার পরিবার সূত্রে জানা যায়, নিহত দুলা মিয়ার সঙ্গে র্যাব সদস্য সাদেকের জায়গা নিয়ে বিরোধ অনেক দিনের। সাদেকের চাচার কাছ থেকে দুলা মিয়া তিন শতক জায়গা কিনেছিলেন। সাদেক এই জায়গা দাবি করলে দুলা মিয়া তা দেননি। এরই জের ধরে দুলা মিয়াকে পরিকল্পিতভাবে অপহরণ করে হত্যা করা হয়।
পুলিশ সূত্রে জানা যায়, গত ১৭ জুন সন্ধ্যায় দুলা মিয়াকে অপহরণ করে ঢাকায় আনা হয়। ১৮ জুন দুপুরে রাজধানীর হাজারীবাগের সিকদার মেডিকেল কলেজের পেছনে বুড়িগঙ্গা নদী থেকে পাটের বস্তায় মোড়ানো এক ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। পরে এই অজ্ঞাত লাশটিই দুলা মিয়ার বলে চিহ্নিত করেন তার স্বজনেরা।
এদিকে এই হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ঢাকা মহানগর পুলিশ দুজনকে গ্রেপ্তার করে। একজন হলেন মাইক্রোবাসের চালক মো. ইউসুফ সর্দার এবং ঘটনার সঙ্গে জড়িত মো. মামুন মিয়া। আদালতে দেওয়া এই দুজনের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে র্যাব সদস্য সাদেক মিয়ার পরিকল্পনায় দুলা মিয়াকে অপহরণ ও হত্যার পুরো বিষয়টি উঠে আসে।
পরে হবিগঞ্জের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ উল্ল্যা গত সোমবার (১৫ জুলাই) র্যাব-২-এর অধিনায়কের কাছে চিঠি পাঠান। এতে তিনি বলেছেন, জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাদেককে চুনারুঘাট থানা-পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হোক। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে র্যাব ২-এর অধিনায়ক মো. আশিক বিল্লাহ বলেন, হবিগঞ্জের পুলিশ সুপার তাঁকে বিষয়টি জানিয়েছেন। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
এদিকে মঙ্গলবার রাতেই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নাজমুল হকের উপস্থিতিতে চুনারুঘাট থানা-পুলিশের কাছে সাদেক মিয়াকে হস্তান্তর করা হয়। ঢাকা মহানগর পুলিশের ধানমন্ডি অঞ্চলের অতিরিক্ত উপ কমিশনার মো. আব্দুল্লাহিল কাফী বলেন, ঘটনার সঙ্গে জড়িত বাকিদেরও গ্রেপ্তারের জন্য অভিযান চলছে।
পুলিশ সূত্রে জানা যায়, দুলা মিয়াকে অপহরণের পর তাঁর ছোট ভাই ইদু মিয়া চুনারুঘাট থানায় মামলা করেন। ঘটনা তদন্তে নামে চুনারুঘাট থানা-পুলিশ। প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা ধরে দুলা মিয়াকে যে মাইক্রোবাসে তুলে আনা হয়, সেটি একটি টোল প্লাজার সিসি ক্যামেরা থেকে শনাক্ত করে তারা। এরপর গাড়ির নম্বর ধরে এর চালক ইউসুফ সর্দারকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী গ্রেপ্তার করা হয় মামুন মিয়াকে।
পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে মো. মামুন মিয়া বলেছেন, তিনি পুলিশের সোর্স হিসেবে কাজ করে আসছিলেন। এরই সূত্র ধরে বছর খানেক আগে র্যাব সদস্য সাদেকের সঙ্গে তাঁর পরিচয়। গত ১৪ জুন সাদেক তাঁকে রায়েরবাজার বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে ডেকে নিয়ে দুলা মিয়াকে অপহরণ করে ঢাকায় নিয়ে আসতে বলেন। ১৬ জুন তাঁকে গাড়ি ভাড়াসহ অন্য খরচের জন্য ১৪ হাজার টাকা তুলে দেন। ১৭ জুন চালক ইউসুফসহ শামীম, বাদল, জামাল, জসিম, ওয়াহাবসহ সাতজন মোহাম্মদপুর শিয়া মসজিদের কাছে র্যাবের ক্যাম্পে যান। কিছুক্ষণ পর তিনি (মামুন) সেখানে গেলে সাদেক মিয়া বলেন, তাঁর ভাগিনা আফরাজ এলাকা থেকে দুলা মিয়াকে অপহরণ করে ঢাকায় নিয়ে আসতে সহায়তা করবে।
মামুন জানিয়েছেন, তাঁরা সাতজন মাইক্রোবাস নিয়ে বিকেল সাড়ে পাঁচটা-ছয়টার দিকে চুনারুঘাট পৌঁছান। সাদেকের কথা অনুযায়ী আফরাজ তাঁদের সঙ্গে দেখা করেন। তাঁরা আফরোজদের বাড়ির সামনে অপেক্ষা করতে থাকেন। সন্ধ্যা সাতটার দিকে আফরাজ তাঁদের জানান দুলা মিয়া হলুদ লুঙ্গি, সাদা চেক শার্ট পরে টমটমে করে আসছেন। টমটম তাঁদের গাড়ির কাছাকাছি এলে জসিম, ওয়াহাব ও বাদল গাড়িটি থামান। নিজেদের ‘ডিফেন্সের লোক’ পরিচয় দিয়ে তাঁরা দুলা মিয়াকে গাড়িতে তোলেন। পানি খেতে চাইলে ঘুমের ওষুধ গুলিয়ে দুলা মিয়াকে খাইয়ে দেওয়া হয়।
পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে ইউসুফ ও মামুন জানিয়েছেন, রাত আনুমানিক ১২টার দিকে তাঁরা দুলা মিয়াকে নিয়ে ঢাকায় র্যাব ২ ক্যাম্পের সামনে পৌঁছান। ফোন পেয়ে সাদেক ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে এসে তাঁদের নিয়ে সিকদার মেডিকেলের পেছনে যান। সাদেক নির্দেশ দেন দুলা মিয়ার হাত-পা বাঁধতে। ঘুমের ওষুধ খাওয়ানোর ফলে দুলা মিয়ার শরীর এমনিতেই নিস্তেজ ছিল। জোর খাটানোর শক্তি পাননি। এরপর সাদেক নিজে মাছ মারার জাল দিয়ে দুলা মিয়ার গলায় প্যাঁচ দেন, নিস্তেজ হয়ে পড়েন তিনি। এরপর অন্যরা মিলে লাশটি বস্তায় ভরে সেটি বেড়িবাঁধের নিচে নদীতে ফেলে দেন। জিজ্ঞাসাবাদে তারা আরো জানান, দুলা মিয়াকে হত্যার পর মামুনকে আরও টাকা দেন সাদেক। এর মধ্যে গাড়িচালক ইউসুফকে সাড়ে ১০ হাজার টাকা দেওয়া হয়। বাকি টাকা মামুনসহ অন্যরা ভাগ করে নেন।
এদিকে ঢাকার হাজারীবাগ থানা পুলিশ বুড়িগঙ্গা নদী থেকে দুলার মরদেহ উদ্ধারের পর ৫ দিন মরদেহটি অজ্ঞাত হিসেবে রেখে জুরাইন কবরস্থানে দাফন করে। পরে সোমবার (১৫ জুলাই) চুনারুঘাট থানার (ওসি) শেখ নাজমুল হক, ওসি (তদন্ত) আলী আশরাফ ও এসআই এস এম নাজমুল হকের নেতৃত্বে একদল পুলিশ এক নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে সাথে নিয়ে জুরাইন কবরস্থান থেকে লাশ উত্তোলন করে বলে জানান চুনারুঘাট থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ নাজমুল হক।