দোদুল্যমান রাজ্য ফ্লোরিডায় প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনী সভা চলছে। খোলা মঞ্চ। চারপাশে ঠাসা দর্শক। রিপাবলিকান প্রার্থী জানতে চাইলেন, ‘আগাম ভোট দিয়েছেন কে কে, হাত তুলুন?’ চারপাশ থেকে প্রায় সব দর্শকের হাত ওপরে উঠে গেল। এই রাজ্যের প্রায় ৪০ লাখ ভোটার এরই মধ্যে তাঁদের গণতান্ত্রিক দায়িত্ব পালন করে ফেলেছেন, যা ২০১৬ সালে পড়া ভোটের অর্ধেকেরও বেশি। এই চিত্র শুধু ফ্লোরিডার নয়, পুরো যুক্তরাষ্ট্রের। গত মঙ্গলবার পর্যন্ত সাত কোটি ১০ লাখ মানুষ ভোট দিয়েছেন। নির্বাচনের বাকি এখনো পাঁচ দিন। অর্থাৎ এই সংখ্যা আরো বাড়বে। বিশ্লেষকদের ধারণা, এবার গত ১০০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ ভোট পড়বে, যা ১৫ কোটি অর্থাৎ ৬৫ শতাংশ ছাড়াবে। এর আগে এত ভোট পড়েছিল ১৯০৮ সালে।
এদিকে জরিপ বলছে, এই ভোটারদের মধ্যে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী জো বাইডেনের গ্রহণযোগ্যতা বেশি। গত জুন মাস থেকে জাতীয় পর্যায়ে পরিচালিত প্রায় সব জরিপেই এগিয়ে আছেন বাইডেন। এই এগিয়ে থাকা সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে দুই অঙ্কের সংখ্যায় পৌঁছে গেছে। যদিও চূড়ান্তভাবে কিছু বলার সময় এখনো আসেনি। বিশেষ করে, প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকা অন্য ব্যক্তির নাম যখন ডোনাল্ড ট্রাম্প। যেকোনো সময় অঘটন ঘটিয়ে বসতে পারেন তিনি।
জরিপ প্রসঙ্গে অঘটন ঘটন পটীয়সী ট্রাম্পের চেয়েও যে বিষয়টি বেশি আলোচনায় আসছে, তা হলো ২০১৬ সালের নির্বাচন। সেবারও প্রায় সব জরিপে এগিয়ে ছিলেন ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী হিলারি ক্লিনটন।
কিন্তু নির্বাচনের ফসল ঘরে তোলেন ট্রাম্প। কাজেই প্রতিটি জরিপের ফল ঘোষণার সময়ই এ প্রসঙ্গের অবতারণা হচ্ছে গণমাধ্যমে। যদিও এ ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় লক্ষ করা প্রয়োজন। প্রথমত, জরিপের অর্থই জনমত, এটি ইলেকটোরাল ভোটের হিসাব নয়। ২০১৬ সালে যে জরিপগুলো প্রকাশ করা হয়েছিল, তা ব্যক্তি মতকেই প্রকাশ করে। সে হিসাবে হিলারি এগিয়ে ছিলেন। ভোটের পরও দেখা গেছে, জনগণের ভোটে হিলারি এগিয়ে। ট্রাম্পের চেয়ে তিনি অন্তত ৩০ লাখ ভোট বেশি পান। কিন্তু গতবারের নির্বাচন যে তিক্ত শিক্ষাটি হিলারিকে দিয়ে গেছে, তা হলো ভোটের সংখ্যা নয়, বরং ভোটগুলো কোন কোন রাজ্য থেকে এলো সে বিষয়টিই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
এর সঙ্গে আরেকটি বিষয়ও মনে করা দরকার। নির্বাচনের মাত্র ১০ দিন আগে সে সময়ের এফবিআই প্রধান জেমস কোমি জানান, পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকার সময় হিলারি দাপ্তরিক ই-মেইলের জন্য ব্যক্তিগত সার্ভার ব্যবহার করেছেন এবং সেই সার্ভার থেকে লাখ লাখ মেইল মুছে ফেলা হয়েছে। বিষয়টি গুরুতর এবং এর তদন্ত প্রয়োজন। ট্রাম্পের ভাগ্যের গতিপথ পাল্টে দেয় কোমির বক্তব্য। জরিপগুলোতে এর আগে দুই প্রার্থীর ব্যবধান ছিল ৫ থেকে ৬ শতাংশ। বক্তব্যের পর তা ১ থেকে ২ শতাংশে গিয়ে ঠেকে। ২০১৬-কে উদাহরণ হিসেবে দাঁড় করানোর সময় বেশির ভাগ গণমাধ্যমই বিষয়টি এড়িয়ে গেছে। অন্যদিকে দীর্ঘ তদন্তের পরও সাবেক ফার্স্ট লেডির বিরুদ্ধে অন্যয় কিছু খুঁজে পাওয়া যায়নি।
তৃতীয়ত, ট্রাম্পের ভোটব্যাংক। ট্রাম্পকে মূলত ভোট দিয়েছেন কখনো কলেজে যাননি এমন শ্রমজীবী শ্রেণি। ২০১৬ সালের জরিপগুলো বিশেষভাবে তাঁদের ওপর ফোকাস করে পরিচালিত হয়নি। এবারের জরিপগুলো সে ত্রুটিমুক্ত। দুই মাস ধরে যেসব যুক্তি সাজিয়ে সব ধরনের সব জরিপের ফলকে আস্থার অযোগ্য বলে বিবেচনা করা হচ্ছে—তা পুরোপুরি সত্য নয়। ট্রাম্প বড় কোনো ঘটনা ঘটিয়ে উঠতে না পারলে তাঁর জন্যই হয়তো কোনো অঘটন অপেক্ষা করছে।
সার্বিকভাবে পিছিয়ে থাকা ছাড়াও ট্রাম্পের জন্য সবচেয়ে বড় সংকট হয়ে যেটি দেখা যাচ্ছে, তার অনুমোদনের হার কমে গেছে। উদাহরণ দিলে বিষয়টি সহজে বোঝা যাবে। গতবার হিলারিকে যে সংখ্যক ভোটার সমর্থন দিয়েছেন, তার চেয়ে বেশি মানুষ বলেছেন, তাঁরা সাবেক ফার্স্ট লেডিকে পছন্দ করেন না। তাঁদের একটা বড় অংশ ভোটও দেননি। ডেমোক্রেটিক পার্টিকে সমর্থন করার পরও তাদের ভোটকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। ট্রাম্পের ক্ষেত্রে বিষয়টি ছিল বিপরীত—সমর্থকের চেয়ে তাঁকে পছন্দ করা মানুষ বেশি ছিল। সে ক্ষেত্রেই এবার ভাটা পড়েছে।
সর্বশেষ সিএনবিসি ও অল অমেরিকা ইকোনমিক জরিপে দেখ গেছে, বাইডেনকে এখন সমর্থন করেন ৫১ শতাংশ মানুষ। ট্রাম্পকে করেন ৪০ শতাংশ। দুই প্রার্থীর অনুমোদনের হার ৪৭ শাতংশ করে। বিষয় আলাদা করে দেখিয়ে দেওয়া হয়েছে কোথায় পিছিয়ে পড়েছেন ট্রাম্প। বলা হচ্ছে, স্বাস্থ্যব্যবস্থা ও কভিড-১৯ ব্যবস্থাপনা নিয়ে ট্রাম্পের তৎপরতায় খুশি নন বেশির ভাগ ভোটার। এর পরই আসে আইন-শৃঙ্খলা ও অর্থনীতি। এ ক্ষেত্রেও ট্রাম্পের পারফরম্যান্স অনুমোদন করেননি ৫৩ শতাংশ ভোটার। প্রার্থীর স্বভাব-চরিত্রের ব্যাপারেও মত চাওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে ট্রাম্পকে পছন্দ করে ২৯ শতাংশ মানুষ, অন্যদিকে বাইডেনকে পছন্দ ৬৬ শতাংশের। এরপর জানতে চাওয়া হয় কর, অভিবাসন ও চীনের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে। এ ক্ষেত্রেও বাইডেনের (৪৮ শতাংশ) চেয়ে পিছিয়ে আছেন ট্রাম্প (৩৮ শতাংশ)। পিছিয়ে আছেন জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে অবস্থানে। এ ব্যাপারে এবার ট্রাম্পের কোনো অবস্থানই নেই। বাইডেনের ইশতেহারের অন্যতম প্রধান বিষয় এটি।
যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে জনমত একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তবে প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য এটিই একমাত্র নিয়ামক নয়। বরং এ ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান ভূমিকা পালন করে ইলেকটোরাল কলেজের ভোট। জনসংখ্যার অনুপাতে রাজ্য অনুসারে মোট ৫৩৮টি ইলেকটোরাল ভোট ভাগ করে দেওয়া আছে। এ কারণেই মানুষের মোট ভোটের চেয়ে রাজ্য জয় বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বেশির ভাগ রাজ্য বছরের পর বছর একইভাবে ভোট দেয়। কিছু রাজ্যে প্রতিবার ভোটের পাল্লা ভিন্নভাবে ওঠানামা করে। এ কারণে এই রাজ্যগুলোকে বলা হয় দোদুল্যমান রাজ্য। এগুলোর সিদ্ধান্তের ওপরই নির্ভর করে কে প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন। গতবার মিশিগান, পেনসিলভানিয়া ও উইসকনসিনে ট্রাম্প জয়লাভ করেন ১ পয়েন্টেরও কম ব্যবধানে। এবার এই রাজ্যগুলোতে বাইডেন ভালো ব্যবধানে এগিয়ে। আর আইওয়া, ওহাইও ও টেক্সাসে দুই প্রার্থী হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করছেন। এ কারণেই এবার রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা, বাইডেনের আসার সুযোগ বেশি। জরিপ পুরোপুরি ফলে না গেলেও, বড় অঘটন না ঘটলে, ট্রাম্পকে হয়তো দ্বিতীয় মেয়াদে হোয়াইট হাউসে দেখা যাবে না।
সূত্র : বিবিসি, গার্ডিয়ান, এনবিসি।