জামালগঞ্জে স্বর্গে যাওয়ার মোহে স্বামী-স্ত্রীর আত্মহত্যা!


সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ উপজেলার পল্লীতে স্বর্গে যাওয়ার মোহে স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে বিষপানে আত্মহত্যা করার খবর পাওয়া গেছে।

শনিবার (২৯ জুন) নিহত দম্পতির পরিবার, গ্রামবাসী ও থানা পুলিশের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা যায়।

উপজেলার ফেনারবাঁক ইউনিয়নের ভাটি ধৌলতপুর গ্রামের প্রয়াত দীগেন্দ্র তালুকদারের ছেলে অমৃকা তালুকদার (৫২) ও তারই স্ত্রী তৃপ্তি রাণী তালুকদার (৩৮)। এ দম্পতির একসঙ্গে বিষপানে আত্মহত্যার পেছনে কারণ খুঁজতে গিয়ে সকাল থেকে দিনভর সরেজমিন অনুসন্ধানে এমন তথ্যই উঠে এসেছে।

উল্লেখ্য, উপজেলার ভাটি দৌলতপুর গ্রামের নিজ বাড়িতেই শুক্রবার (২৮ জুন) সকাল সাড়ে ৭টার পর শিশু সন্তানদের ঘুমন্ত অবস্থায় রেখে ওই দম্পতি বিষপান করেন।

নিহত এ দম্পতির সাত বছর বয়সী সরস্বতী রাণী তালুকদার নুপুর নামে এক শিশুকন্যা ও অভি তালুকদার নামে চার বছর বয়সী এক শিশুপুত্র রয়েছে।

নিহত অমৃকার সহোদর বড় ভাই শনিবার (২৯ জুন) দুপুরে এ প্রতিবেদকে জানান, উপজেলার ভাটি দৌলতপুর গ্রামে শিশু সন্তানদের ঘুমন্ত অবস্থায় রেখে শুক্রবার সকালে রান্না করা পায়েসের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে প্রথমে স্ত্রী তৃপ্তি রাণী তালুকদার ও পরবর্তীতে স্বামী অমৃকা তালুকদার দুজনই খান। বিষ মেশানো পায়েস খাওয়ার পরপরই বিষক্রিয়া শুরু হলে স্বামী-স্ত্রী দু’জনের চিৎকার শুনে শিশুরা জেগে উঠে কান্নাকাটি করতে থাকে। এক পর্যায়ে পরিবারের আলাদা ঘরে বসবাসরত অমৃকার সহোদর ভাই, তার পরিবারের লোকজন ও প্রতিবেশীরা এ অবস্থা দেখে দ্রুত ছুটে আসেন।

এ সময় একসঙ্গে বিষপানের কারণ জানতে চাইলে ওই দম্পতি গ্রামবাসী ও পরিবারের লোকজনকে জানান, তারা স্বামী-স্ত্রী দুজনই রাতভর উপোষ ছিলেন। স্ব-স্ত্রী বৈকন্ঠে (স্বর্গে) যাওয়ার মোহে তারা সাত সকালে সন্তানদের ঘুমে রেখে পায়েস রান্না করেন। তারপর পায়েসের সঙ্গে অতিমাত্রার ইঁদুর মারার কয়েকটি ট্যাবলেট মেশান।

যথারীতি ভোরবেলা স্বামী-স্ত্রী দুজন স্নান (গোসল) শেষে নতুন কাপড় পরিধান করে মন্ত্রপাঠে বসেন। এরপর প্রথমে স্ত্রী তৃপ্তি ও পরে স্বামী অমৃকা দুজনই পর্যায়ক্রমে বিষ মেশানো পায়েসকে প্রসাদ মনে করে খেয়ে নেন।

এরপর ভীমরতির বিষয়টি টের পেয়ে দ্রুত ওই দম্পতিকে জামালগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান পরিবার ও গ্রামবাসী। সেখানে দুপুরের দিকে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়ার পর শংকামুক্ত না হওয়ায় ফের দুজনকেই দুপুরের পরপরই জেলা সদর হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়।

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ভেতর থেকে স্বামী-স্ত্রী দুজনকে সুনামগঞ্জ নেয়ার জন্য বের করা হলে তাৎক্ষণিকভাবে অমৃকা তালুকদার মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। অপরদিকে তৃপ্তি রাণীকে জেলা সদর হাসপাতালে নেয়ার পথে তিনিও মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।

রাত ৮টার দিকে থানা পুলিশ ওই দম্পতির লাশ ময়নাতদন্তের জন্য জেলা সদর হাসপাতালে প্রেরণ করে।

উপজেলার ভাটি দৌলতপুর গ্রামের নিহত অমৃকার সহোদর ছোট ভাই নিশিকান্ত তালুকদার ও ভাইয়ের স্ত্রী শুক্লা রানী তালুকদার জানান, গত কয়েক বছর ধরেই অমৃকা ও তার স্ত্রী তৃপ্তি দুজনই তান্ত্রিক সাধনায় মগ্ন থাকতেন। খুব একটা বেশি তারা পরিবার বা প্রতিবেশীর সঙ্গে মিশতো না। তাদের মানসিক চিকিৎসা করানোর চেষ্টা করলেও তারা উল্টো আমাদের সনাতন ধর্মের বিভিন্ন মন্ত্রপাঠ করে বলে বেড়াতেন তাদের কোন রোগবালাই আজীবন হবে না। এমনকি মৃত্যুর পর তারা স্বামী-স্ত্রী স্বর্গেই চলে যাবেন।

অমৃকার চাচাতো বোন মুন্না তালুকদার ও আরেক ভাই রঞ্জু তালুকদার শনিবার দুপুরে অমৃতা-তৃপ্তি দম্পতির বসতঘরের আশপাশ দেখাতে গিয়ে এ প্রতিবেদকে বলেন, দেখুন বাড়ির গাছপালা ও ডালে, বসত ঘরের বেড়ার চারপাশজুড়ে অমৃকা ও তার স্ত্রী বসতবাড়ি বন্ধন করে রাখার জন্য জামা কাপড়, তাবিজ-কবজ, সুতা, জুতা জোড়া ঝুলিয়ে রাখতেন।

জামালগঞ্জ গার্লস স্কুলের সহকারী শিক্ষক গোপিকা রঞ্জন চৌধুরীর সঙ্গে শনিবার কথা হয় ভাটি দৌলতপুর গ্রামে। তিনি বলেন, প্রায় ৯ বছর আগে আমার আপন চাচাতো ছোট বোন তৃপ্তি রানীর বিয়ে হয় অমৃকার সঙ্গে। বিয়ের কয়েকবছর ভালোভাবেই কেটেছে তাদের। কিন্তু বছর তিনেক হয় ধীরে ধীরে তারা স্বামী-স্ত্রী বদলে যেতে থাকেন। সব সময় ওরা আধ্যাত্মিক নানা বিষয়ে মন্ত্রপাঠে ব্যস্ত থাকতেন। তাদের মানসিক সমস্যা ছিল। একাধিকবার তাদেরকে পরিবারের লোকজন চিকিৎসার জন্য বাইরে নিয়ে যেতে চাইলেও উল্টো তাদেরকে আরও ক্ষিপ্ত হতে দেখেছি।

জামালগঞ্জর থানার ওসি মো. সাইফুল আলম শনিবার (২৯ জুন) রাতে বলেন, এ ব্যাপারে শুক্রবার রাতেই থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা দায়ের করা হয়।

তিনি আরও বলেন, এরপরও ঘটনার অধিকতর তদন্তে শনিবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত নিহতের পরিবার লোকজন প্রতিবেশী ও আশেপাশের গ্রামের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে মূলত মানসিক রোগের ধকলে থাকা এ দম্পতি একসঙ্গে স্বর্গে যাবেন এ কাল্পনিক সূত্রে বিশ্বাসী হয়ে বিষপানে আত্মহত্যা করেন।

আলামত হিসাবে বসত ঘরের বাহিরে ভেতরে ঝুলিয়ে রাখা তাবিজ-কবজ, সুতাসহ নানা জিনিসপত্র এমনকি পাত্রসহ বিষ মেশানো পায়েস জব্দ করা হয়েছে বলে জানান ওসি।

সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মানসিক রোগ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. আহমদ রিয়াদের সঙ্গে ওই দম্পতির আত্মহত্যার বিষয়টি অবহিত করে শনিবার (২৯ জুন) রাতে মতামত জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটি মূলত এক প্রকার মানসিক রোগ। মানসিক রোগের লক্ষণ শুরুর পরপরই এ দম্পতিকে চিকিৎসা করানো গেলে তারা ক্রমশ সুস্থ হয়ে উঠতেন। হয়ত তাদের এমন অপরিণামদর্শী মৃত্যু রোধ করা যেতে পারত।