ধান কাটার শ্রমিক নেই; যন্ত্রই কি সমাধান?


করোনাভাইরাস কৃষকের জন্য ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। ইতোমধ্যেই দেশের আনাচে কানাচে চলতি বোরো মৌসুমের ধান পাকতে শুরু করলেও কৃষকরা এই ধান তুলতে পারবেন কিনা সেটা নিয়ে সংশয়ে রয়েছেন। কারণ ধান কাটার মতো কোন শ্রমিক নেই। কৃষকরা বলছেন, করোনাভাইরাসের আতঙ্কে অনেক কৃষক বাড়ি থেকে বের হচ্ছেন না। যে শ্রমিকরা আছেন তারাও পরিবহনের অভাবে আরেক জেলায় গিয়ে ধান কাটতে পারছেন না।

কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার কৃষক মতিন সৈকত, তার ১০ বিঘা জমি জুড়ে বোরো ধান চাষ করলেও সেই ধান তোলার মতো পর্যাপ্ত শ্রমিক পাচ্ছেন না। এমন অবস্থায় কালবৈশাখী ঝড় এবং বৃষ্টিতে ধান নষ্ট হওয়ার আশঙ্কায় আছেন এই কৃষক। কৃষকদের এমন দুশ্চিন্তা দূর করতে বিশেষ করে সম্ভাব্য খাদ্য ঘাটতি এড়াতে ধান কাটার মেশিনের ওপর নির্ভরতা বাড়ানোর ওপরে জোর দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

কৃষক মতিন সৈকত মনে করেন, কৃষিতে শ্রমিক সংকট মোকাবিলায় সরকারের উচিত হবে স্বল্প মূল্যে ধান কাটার যন্ত্র সরবরাহ করা। তিনি বলেন, ‘সরকার যদি এসব যন্ত্রের দাম অর্ধেক কমায় দেয়। আবার ওই অর্ধেক দামের উপরে ভর্তুকি দেয়, তাহলে একটা গ্রামের কয়েকজন কৃষক সমবায়ের মাধ্যমে একটা মেশিন কিনতে পারে। এতে সবার উপকার হবে।’

বাংলাদেশের কৃষিখাতে প্রয়োজন অনুপাতে ৪০% কৃষি শ্রমিকের ঘাটতি রয়েছে বলে জানিয়েছেন কৃষিযন্ত্র আমদানিকারী প্রতিষ্ঠান এসিআই অ্যাগ্রোবিজনেসের নির্বাহী পরিচালক এফ এইচ আনসারি। এই ঘাটতি পূরণে যে পরিমাণ ধান কাটার যন্ত্রের প্রয়োজন, বাংলাদেশে সেটার মাত্র ৫% রয়েছে। এফ এইচ আনসারির মতে, মৌসুমের সব ধান কাটতে সামনে পাঁচ বছরের মধ্যে অন্তত ২০ হাজার যন্ত্র কেনা প্রয়োজন। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশে হার্ভেস্টিং ও রিপিং মেশিন মিলিয়ে ৪ হাজারের মতো সচল যন্ত্র আছে।

হার্ভেস্টিং মেশিন হলো এমন যন্ত্র, যার মাধ্যমে ধান কাটা থেকে শুরু করে ঝাড়াই, মাড়াই, বস্তাবন্দী সবকাজ একবারে হয়ে যায়। এবং রিপার মেশিন দিয়ে শুধু ধান কাটা যায়। সাধারণ একটি হার্ভেস্টিং মেশিন এক একর জমির ধান এক ঘণ্টায় কাটতে পারে। এভাবে দিনে দুই শিফটে ১৬ ঘণ্টায় ৫০ বিঘা ধান কাটা সম্ভব। এতে একজন অপারেটর অন্তত ১৫০ জন শ্রমিকের কাজ করতে পারে। এসব যন্ত্রের ভাড়া বা তেল খরচ বাবদ খরচও হয় কৃষি শ্রমিকদের মজুরির তুলনায় অনেক কম।

কৃষক মতিন সৈকতের ১০ বিঘা জমির ধান কাটতে ৭০ জন শ্রমিকের প্রয়োজন। যাদের মজুরি বাবদ খরচ পড়বে প্রায় ৭০ হাজারের মতো। অথচ একটি হার্ভেস্টিং মেশিন থাকলে নামমাত্র কয়েকগুণ কম খরচে তিনি এই কাজ করিয়ে নিতে পারতেন। সম্ভাব্য খাদ্য ঘাটতি এড়াতে তাই প্রয়োজন মাফিক কৃষি যন্ত্র কেনার কথা জানিয়েছেন এফ এইচ আনসারি।

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের ১৫ লাখ হেক্টর জমির ধান কাটতে কোনো শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। এই পরিমাণ জমির ধান কাটতে সামনের তিন বছরের মধ্যে ১০ হাজার ধান কাটার মেশিনের প্রয়োজন। এর পরের দুই বছরের মধ্যে আরও ১০ হাজার মেশিন কিনতে হবে। কারণ কৃষি শ্রমিকের সংখ্যা আরও কমবে।’

বাংলাদেশে ইতোমধ্যে তিন লাখ শ্রমিক এবং ৮শটি যন্ত্রের মাধ্যমে হাওর অঞ্চলে ধান কাটা হচ্ছে। যা এই মাসের ৩০ তারিখের মধ্যে শেষ হবে বলে জানিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়। তবে সারাদেশে ধান কাটার সময় শ্রমিক সংকটের যে আশঙ্কা করা হচ্ছে, সেটা ভিত্তিহীন বলে জানিয়েছেন মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. নাসিরুজ্জামান। বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামে যথেষ্ট কৃষি শ্রমিক থাকায় যন্ত্র নির্ভরশীলতার প্রয়োজন নেই বলে জানান তিনি।

নাসিরুজ্জামানের ভাষায়, ‘বাংলাদেশের যারা কৃষি শ্রমিক, তারাই ঢাকা শহরে আসলে রিকশাচালক, দিনমজুর, নির্মাণ শ্রমিক, গার্মেন্টস শ্রমিক না হলে পরিবহন শ্রমিক হিসেবে কাজ করে। লকডাউনের কারণে এই মানুষগুলো গ্রামে অবস্থান করছেন। তাই গ্রামে ধান কাটার মানুষের অভাব হবে না। তারা মজুরিও পাবে, আবার সরকারের পক্ষ থেকে তাদের ত্রাণ দেয়া হচ্ছে।’

খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সরকার সম্প্রতি কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণের জন্য ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। যেখানে কিনা সার বাবদ দেয়া হয়েছে ৯ হাজার কোটি টাকা, এবং বীজের জন্য দেয়া হয়েছে ১৫০ কোটি টাকা। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৪৮ লাখ ৬৬ হাজার হেক্টর জমিতে ২০৪ লাখ ৩৬ হাজার মেট্রিক টন ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। কিন্তু কৃষিকাজে শ্রমিকের সংখ্যা দিন দিন যেভাবে হ্রাস পাচ্ছে ,সামনের দিনগুলোতে এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা কতোটা সম্ভব হবে সেটা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

এমন অবস্থায় খাদ্য সংকট এড়াতে কৃষি যান্ত্রিকীকরণকেই সমাধান বলছেন অর্থনীতিবিদ ফাহমিদা খাতুন। উন্নত কৃষির দেশগুলোর উদাহরণ টেনে ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘উন্নত দেশগুলোয় মজুরি অনেক বেশি হওয়ায় তারা কিন্তু কৃষিক্ষেত্রে প্রায় পুরোটাই যন্ত্রের ওপর নির্ভরশীল। এতে তাদের খরচ কম হয়, সময়ও কম লাগে। এখন বাংলাদেশের শ্রমিকরা যেহেতু অন্যান্য পেশায় সরে যাচ্ছে, তাই কৃষিতে যন্ত্রের ব্যবহার বাড়াতে হবে।’

,

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *