‘নক্ষত্রশূন্য’ হচ্ছে সিলেট


আলেম-উলামা অধ্যুষিত বৃহত্তর সিলেট অঞ্চল একসময় ছিলো উপমহাদেশের বিখ্যাত হাদিস-তাফসির বিশারদ ও পির, মাশায়েখ এবং ইসলামি মনিষীদের আবাদ ও বিচরণভূমি। এই সিলেটের মাটি তাদের বুকে ধরে হয়েছিলো ধন্য। কিন্তু বড় বড় আলেমদের ইন্তেকালে সিলেট হচ্ছে ‘নক্ষত্রশূন্য’। সর্বশেষ এই তালিকায় যোগ দিলেন প্রখ্যাত আলেম আল্লামা আযহার আলী আনোয়ার শাহ কিশোরগঞ্জি।

তিনি গত ২৯ জানুয়ারি ভক্তকুল ও ধর্মপ্রাণ জনতাকে কাঁদিয়ে চলে গেলেন না ফেরার দেশে। এভাবে গত এক বছরে সিলেট হারিয়েছে একে একে ১১ জন আধ্যাত্মিক রাহবারকে।
হারিয়ে যাওয়া একেক জন আলেম ছিলেন সিলেটে ইসলামিক শিক্ষার বাতিঘর। কেউ কেউ গড়ে তুলেছিলেন দ্বিনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানগুলো এখন সিলেটে ইসলামিক শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছে। তাদের হারিয়ে শোক বিরাজ করছে সিলেটের আলেম সমাজসহ ধর্মপ্রাণ মানুষের মাঝে। শোকাহতদের বক্তব্য- চিরতরে চলে যাওয়া বড় বড় আলেমরা ছিলেন সিলেটের স্তম্ভ। তাদের নেতৃত্বে সিলেট অঞ্চলে ইসলামিক শিক্ষার ব্যাপক প্রসার লাভ করেছিলো। পাশাপাশি ইসলামবিরোধী কোনো ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রামে তারাই দিতেন নেতৃত্ব, পালন করতেন অগ্রণী ভূমিকা। একেকজন ছিলেন ইসলামবিরোধী অপশক্তির বিরুদ্ধে বজ্রকণ্ঠ।

আল্লামা আযহার আলী আনোয়ার শাহ কিশোরগঞ্জী : আল্লামা আযহার আলী আনোয়ার শাহ কিশোরগঞ্জী ছিলেন ক্বওমি মাদরাসার সম্মিলিত শিক্ষাবোর্ড হাইয়াতুল উলইয়া লিল জামিয়াতিল কওমিয়া বাংলাদেশের সদস্য, বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া (বেফাক)-এর সহসভাপতি।  এছাড়াও তিনি ছিলেন আল-জামিয়াতুল ইমদাদিয়া কিশোরগঞ্জ-এর মুহতামিম ও কিশোরগঞ্জের ঐতিহাসিক শহিদি মসজিদের খতিব।  তিনি গত ২৯ জানুয়ারি (বুধবার) রাজধানীর ধানমণ্ডির ইবনে সিনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তিনি ইন্তেকাল করেন।

পরদিন বৃহস্পতিবার বাদ জোহর ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠে জানাজা নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। ইমামতি করেন আনোয়ার শাহ’র ছেলে। এতে অংশ নেন তিন লক্ষাধিক মুসল্লি।  জানাজা শেষে শহরের ঈশাখান রোডে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয় আনোয়ার শাহ কিশোরগঞ্জিকে।

আনোয়ার শাহ’র নামের সঙ্গে ‘কিশোরগঞ্জি’ শব্দ জুড়া থাকলেও তিনি মূলত সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার গুঙ্গাদিয়া গ্রামের আল্লামা শাহ আতহার আলী (র.)-এর এর ছেলে। তাঁর পিতা শাহ আতহার আলী ছিলেন নেজামে ইসলামের সভাপতি। এছাড়াও আনোয়ার শাহ ছিলেন কানাইঘাট গাছবাড়ি কামিল মাদরাসার সাবেক প্রিন্সিপাল বর্তমান আমেরিকা প্রবাসী মাওলানা আব্দুর রহিম এর ভাই।

আল্লামা তাফাজ্জুল হক হবিগঞ্জি : গত ৫ জানুয়ারি সিলেটবাসী হারিয়েছে প্রখ্যাত আলেম আল্লামা তাফাজ্জুল হক হবিগঞ্জীকে। তার জানাজায় লাখো মানুষের ঢল নেমেছিল হবিগঞ্জে। আল্লামা তাফাজ্জুল হক হবিগঞ্জি ছিলেন উপমহাদেশের শীর্ষ হাদিস বিশারদ। তিনি জামেয়া আরাবিয়া উমেদনগর টাইটেল মাদ্রাসা হবিগঞ্জের প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল ও শায়খুল হাদিস। এছাড়াও হবিগঞ্জে মাদানীনগর মহিলা মাদ্রাসাও প্রতিষ্ঠা করেন তিনি।

মুহাদ্দিস খলীলুর রহমান : সিলেটের খ্যাতনামা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জামিয়া কাসিমুল উলুম দরগাহ মাদ্রাসার প্রবীণ মুহাদ্দিস মাওলানা খলীলুর রহমান গত বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি সিলেটের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। তিনি দরগাহ মাদ্রাসায় হাদিসের খেদমতের পাশাপাশি হযরত শাহ পরান (রহ.) মাজার মসজিদের খতিবও ছিলেন।

মুফতি আবুল কালাম যাকারিয়া : হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে গত বছরের ১১ই মার্চ ইন্তেকাল করেন দেশের অন্যতম ফিকাহ বিশারদ আলেম ও সিলেটের জামিয়া দরগাহে হযরত শাহজালালের মোহতামিম মুফতি আবুল কালাম যাকারিয়া। মুফতি যাকারিয়া ছিলেন ইসলামি  আইন শাস্ত্রে সমকালীন সিলেটের তুলনাহীন ব্যক্তিত্ব। যে কেউ যেকোনো সময় তার কাছ থেকে যেকোনো ধরনের মাসআলা, সরাসরি হোক কিংবা মোবাইলফোনে জেনে নিতে পারতেন। দরগাহ মাদ্রাসার মুহতামিমের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি বেশ কিছু বছর ধরে দরগাহ মসজিদের ইমাম ও খতিবও ছিলেন তিনি। ছিলেন দাওয়াতুল হক বাংলাদেশের সিলেট জেলার আমির।

মাওলানা শফিকুল হক আমকুনী : জামিয়া মাহমুদিয়া ইসলামিয়া সোবহানীঘাট সিলেটের প্রতিষ্ঠাতা মুহতামিম মাওলানা শফিকুল হক আমকুনী ২০১৯ সালের ২০ এপ্রিল ইন্তেকাল করেছেন। বরেণ্য এ আলেম সিলেট নগরীর সোবাহানীঘাট জামিয়া মাহমুদিয়া মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা মুহতামিম, সোবহানীঘাট মসজিদের মুতওয়ালি ও খতিব হিসেবে আজীবন দায়িত্ব পালন করে গেছেন। সিলেট নগরের আলীম সমাজের একজন অভিভাবক ছিলেন।

শায়খুল হাদিস মাওলানা শিহাবুদ্দীন : সিলেটের প্রাচীনতম দ্বিনি বিদ্যাপীঠ জামিয়া তাওয়াক্কুলিয়া রেঙ্গার শায়খুল হাদিস মাওলানা শিহাবুদ্দীন গত বছরের ১ জুন ইন্তেকাল করেন। আল্লামা শিহাব উদ্দীন সিলেটের শীর্ষস্থানীয় অন্যতম হাদিস বিশারদ ছিলেন। জামেয়া রেঙ্গায় একাধারে দীর্ঘ ৫০ বছরেরও অধিক কাল তিনি শায়খুল হাদিস হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। এ ছাড়াও তিনি দীর্ঘদিন ধরে সিলেটের আঞ্চলিক শিক্ষাবোর্ড আযাদ-দ্বীনি এদারার নাজিমে ইমতেহান হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন।

শায়খুল হাদিস মাওলানা ফখরুদ্দীন : সিলেট সদর উপজেলার জামেয়া আরাবিয়া ইসলামিয়া দনুকান্দি মাদ্রাসার শায়খুল হাদিস বরেণ্য আলেম মাওলানা ফখরুদ্দীন সাদিক সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে হার্ট অ্যাটাক করে ২০১৯ সালের ২০ জুন মৃত্যুবরণ করেন। তিনি জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বিয়ানীবাজার উপজেলার সহসভাপতির দায়িত্বে ছিলেন। সিলেট বিভাগের ঐতিহ্যবাহী ইসলামী বিদ্যাপীট জামেয়া মাদানিয়া আঙ্‌গুরা মোহাম্মদপুর থেকে প্রথম দাওরায়ে হাদিস কৃতিত্বের সঙ্গে পাস করেন। তিনি ঢাকা উত্তর রানাপিং আরাবিয়া হোসাইনিয়া জামেয়া কাসিমূল উলুম মেওয়া মাদ্রাসাসহ সিলেটের বিভিন্ন মাদ্রাসার শায়খুল হাদিস ও মুহাদ্দিস হিসেবে শিক্ষকতা করেছেন।

আল্লামা শুয়াইবুর রহমান বালাউটি : আল্লামা ফুলতলি (রহ.)-এর সুযোগ্য খলিফা আল্লামা শুয়াইবুর রহমান বালাউটি গত বছরের ৩ অক্টোবর ইন্তেকাল করেন। কর্মজীবনে তিনি ১৯৬২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত বাদেদেওরাইল ফুলতলি দাখিল মাদ্রাসার শিক্ষাসচিব ছিলেন। আট গ্রামের আমজাদিয়া দাখিল মাদ্রাসায়ও তিনি সুপার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এরপর তিনি জালালপুর মাদ্রাসার অধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দেন।

মাওলানা নুরুল ইসলাম বিশ্বনাথী : গত ডিসেম্বরের ১৫ তারিখ (শনিবার) মাওলানা নুরুল ইসলাম বিশ্বনাথী নগরীর একটি হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন। নুরুল ইসলাম বিশ্বনাথী আতাপুর মাদ্রাসা, কালিগঞ্জ মহিলা মাদ্রাসা, বাগিচা বাজার মাদ্রাসা বিশ্বনাথ-এর মোহতামিম এবং উপমহাদেশের বিখ্যাত শায়খুল হাদিস আল্লামা নুর উদ্দিন গহরপুরী (রহ.)-এর খলিফা ছিলেন।  এ ছাড়াও তিনি খেলাফত মজলিস বিশ্বনাথ উপজেলার সাবেক সভাপতি ছিলেন।

মাওলানা আবদুল খালিক কিয়ামপুরী : একই দিন (গত ডিসেম্বরের ১৫ তারিখ) সিলেটের ওসমানীনগর থানাধীন জামেয়া দারুসসুন্নাহ গলমুকাপন মাদ্রাসার সাবেক শিক্ষা সচিব মাওলানা আবদুল খালিক কিয়ামপুরী ইন্তেকাল করেন।

মাওলানা শেখ মুজিবুর রহমান : ২৫শে ডিসেম্বর সিলেটের প্রখ্যাত আলেম ও সিলেট নগরীর রেলগেইট জামে মসজিদের প্রধান খতিব মাওলানা শেখ মুজিবুর রহমান ইন্তেকাল করেন। তিনি আল্লামা ফুলতলী (রহ.) অন্যতম খলিফা ছিলেন। তিনি জালালপুর আলীয়া মাদ্রাসার শিক্ষক, ওসমানীনগর গোয়ালাবাজার খাদিমপুর কাঠালখাইড় হাফিজিয়া দাখিল মাদ্রাসার সুপারিনটেনডেন্টসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করেছিলেন।