সৃষ্টিকুলের ভেতর মানুষকে শ্রেষ্ঠত্ব দেয়া হয়েছে তার জ্ঞানার্জনের ক্ষমতার জন্য। সমস্ত প্রাণীর ভেতর একমাত্র মানুষই জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার মাধ্যমে নিত্যনতুন বস্তু ও চিন্তা সৃজনের বা উদ্ভাবনের ক্ষমতা রাখে।
মানুষের প্রধান বৈশিষ্ট্য বলা হয় মানুষ বুদ্ধিমান প্রাণী। বুদ্ধি চর্চার এ বৈশিষ্ট্য বিনষ্ট হলে পিছিয়ে পড়া যে কোনো সমাজের জন্যই খুব স্বাভাবিক ব্যাপার।
ইসলাম প্রকৃতির ধর্ম। প্রকৃতিবিরোধী কোনো কিছুই এ ধর্মে থাকতে পারে না। কাজেই জ্ঞান-বিজ্ঞানে পিছিয়ে পড়তে ইসলাম কখনও মানুষকে উৎসাহিত করতে পারে না।
কে না জানে ইসলামের ওহির সূচনাই হয়েছে ইকরা শব্দ দিয়ে। বালাযারির ভাষ্যমতে তৎকালীন মক্কায় মাত্র ১৭ জন নারী-পুরুষ লিখতে পড়তে জানতেন। এমন এক পরিবেশে উম্মি আরাবি নবী প্রথম যে ওহি উচ্চারণ করেন তাতে ছিল পড়াশোনার তাগিদ।
পরবর্তীকালে প্রতিটি মুসলমান নারী-পুরুষের জন্য বিদ্যার্জনকে আবশ্যকীয় করে দেয়া হয়েছিল। বদরযুদ্ধে বন্দি কাফিরদের ভেতর অনেকের কাছ থেকে মুক্তিপণ হিসেবে মদীনার শিশুদের লেখা-পড়া শিখিয়ে দেয়া ধার্য করা হয়েছিল।
আম্মাজান হজরত হাফসা নবীজীর উৎসাহে শিফা বিনতে আব্দুল্লাহর কাছ থেকে হস্তাক্ষর শিখেন বেশ বয়স হওয়ার পর। এ সব তথ্য স্বতসিদ্ধ।
কুরআনে জ্ঞান চর্চার উৎসাহ দিতে গিয়ে বলা হচ্ছে, যারা জানে আর যারা জানে না তারা কি সমান হতে পারে। আরও ইরশাদ হচ্ছে, কেবল জ্ঞানীরাই খোদা তায়ালাকে ভয় করে।
এর অর্থ কী? মূর্খের খোদাভীতিকেও স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। কেউ আল্লাহকে ভয় করতে চাইলেও তাকে জ্ঞানার্জন করতে হবে। স্রষ্টার সৃষ্টিকুশলতা ও অনন্য উদ্ভাবনসমূহের কারুকার্যে যে বিস্ময়কর সৌন্দর্য রয়েছে তার যথাযথ উপলব্ধির জন্য জ্ঞানী হওয়ার বিকল্প নেই।
আমাদের মুসলিম চিন্তাবিদরা এ বিষয়ে লিখতে গিয়ে বর্তমান সময়ে উম্মতে মুসলিমার শিক্ষার ক্ষেত্রে পশ্চাৎপদতার নিন্দামন্দ করে থাকেন।
ফরাসি বিপ্লবোত্তর কাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত সময়ক্ষণকে যদি আমরা বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখা যায়, সত্যি আমরা মুসলমানরা শিক্ষা ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে আছি। কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে শুধু মুসলমানরা নয় বরং এশিয়া ও আফ্রিকার অন্যান্য অধিকাংশ জাতিই অশিক্ষায় আক্রান্ত এবং এ ক্ষেত্রে অনেকটাই পিছিয়ে পড়া।
আমাদের ভারতবর্ষে মুসলমানদের মতোই সংখ্যাগুরু হিন্দু বৌদ্ধ জৈন ও অন্য ধর্মাবলম্বী সবাই ঔপনিবেশিক আমল থেকে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা থেকে অনেক পিছিয়ে পড়েছে। ইউরোপের ধারে-কাছে পৌঁছার কথা এখন যেন ভাবাই যায় না।
ম্যাক্স মুলারের ভাষ্যমতে, ইংরেজ শাসনামলের পূর্বে বাংলাদেশে ৮০ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল। বাংলাদেশের সমগ্র ভূমির এক-চতুর্থাংশই বরাদ্দ ছিল শিক্ষাখাত হিসেবে।
হিসাব করে দেখা যায়, প্রতি চারশ’জনের জন্য একটি প্রতিষ্ঠান ছিল। এ সব তথ্য থেকে অনুমান করা যায় শিক্ষার প্রতি বাংলাদেশের মতো একটি বহির্বিশ্বে অজানা দেশে কতটা অনুরাগ ছিল। অন্যান্য অঞ্চলে এর চেয়ে কম হওয়ার কথা নয়।
জ্ঞান-বিজ্ঞানে মুসলিম সমাজে কয়েকশ’ বছর ধরে পিছিয়ে আছে। বিশেষত ইউরোপ ও আমেরিকা অগ্রসর হয়েছে প্রাচ্যের তুলনায় অনেক বেশি। এর ফলে এ কথা ধরে নেয়া ঠিক নয় যে, যারা দুশ’ বছর অনগ্রসর রয়েছে তারা আর কখনও নিজেদের অবস্থা শোধরাতে পারবে না।
এ আলোচনায় ইসলামকে দোষারোপ করা এক মূর্খতা ছাড়া কিছু নয়। ইসলাম কখনও জ্ঞান চর্চায় কোনো ধরনের বাধা দেয়নি। হজরত আদম সৃষ্টির ইতিহাস কুরআন থেকে পড়ুন।
মানুষকে শ্রেষ্ঠত্ব দেয়ার কারণ হিসেবে সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, আদমকে পৃথিবীতে আগমণের আগেই সব নাম শিক্ষা দেয়া হয়েছে। তার সেই জ্ঞানের কারণেই ফেরেশতাদেরকে আদেশ করা হয়েছিল তাকে সেজদা করতে।
অসংখ্য আয়াতে সমস্ত বস্তুকে মানুষের অনুগত করে দেয়ার কথা এসেছে। সূরা লোকমানের একটি আয়াত উদহারণ হিসেবে আনা যায়।
আল্লাহ তায়ালা বলেন, তোমরা কি দেখ না আল্লাহ আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সমস্তই তোমাদের কল্যাণে নিয়োজিত করেছেন এবং তোমাদের প্রতি তার প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করেছেন? মানুষের মধ্যে কেউ কেউ আল্লাহ সম্বন্ধে বিতণ্ডা করে, তাদের না আছে কোনো জ্ঞান, না আছে কোনো পথনির্দেশক আর না আছে কোনো দীপ্তিমান কিতাব। (লুকমান, ২০)
এমন বহু আয়াতেই এ বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। এ থেকে বোঝা যায়, সৌরজগৎ থেকে নিয়ে ক্ষুদ্র বালুকণা পর্যন্ত সবকিছুকেই মানুষের অধীন করে দেয়া হয়েছে এবং এ সব বস্তু সংক্রান্ত জ্ঞানের চর্চা করে মানুষ উদ্ভাবন করতে পারে নতুন নতুন জিনিস। জ্ঞানের জগৎকে করতে পারে সমৃদ্ধতর।
পশুর মতো দাসত্বের শৃংখলে আবদ্ধ থাকতে তেমন কোনো জ্ঞান লাগে না। যুগে যুগে সবল উৎপীড়ক শাসকগোষ্ঠী নিজেদের প্রভুত্ব বজিয়ে রাখতে জনশিক্ষার প্রতি ইচ্ছাকৃতভাবেই অবহেলা করেছে। এর উৎকৃষ্ট উদহারণ আমাদের ভারতবর্ষ।
ইউরোপের ঔপনিবেশবাদিরা আফ্রিকা ও এশিয়ার অঞ্চলসমূহের মানুষকে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করার কারণ এটিই। শিক্ষার আলোয় আলোকিত হলে তাদের আর দাস বানিয়ে রাখা যাবে না। ভারতের রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল ইংরেজ। তারা অন্যান্য স্থানের মতো ভারতেও শিক্ষার প্রসারে বাধা সৃষ্টি করতে থাকল।
ইংরেজদের এ শঙ্কা হল যে, শিক্ষিতের হার যদি ভারতবর্ষে পূর্ববৎ থাকে তাহলে তাদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত হবে না। এ জন্য তারা শিক্ষাকেন্দ্রগুলো মিটিয়ে ফেলল এবং জ্ঞান চর্চার সমস্ত পথ রুদ্ধ করে দিল। শিক্ষাখাতে ব্যয় হওয়ার জন্য বরাদ্দ জমিগুলো সরকারি কবজায় নিয়ে নেয়া হয়।
ঔপনিবেশিক শক্তিকে দায়ী করার অর্থ এ নয় যে, আমাদের কোনো দায় নেই। তা ছাড়া বর্তমান সময়ে সেই পুরনো দাসত্ব যেহেতু নেই কাজেই জ্ঞান চর্চার পরিমাণ যথাযথ না বাড়া হতাশাব্যঞ্জক।
তবু একটি বিষয় ভেবে দেখার মতো। সেটি হচ্ছে শিক্ষার প্রসারে ও গভীরতা সৃষ্টিতে অনেক বিষয়ের মতো পরিবেশ ও বিভিন্ন পরিস্থিতির প্রভাবও থাকে। বর্তমান সময়ের পরিবর্তন অবশ্যই হবে।
কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে, এই দিনগুলো আমি মানবসমাজে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে আনি। অর্থাৎ একেক সময় একেকটি জাতির উত্থান ঘটানো হয়। যখন তাদের মেধা বিভিন্ন কারণেই বিকশিত হয়।
পাশ্চাত্যের যে উদ্ভাবন ক্ষমতা বিগত কয়েক শতকে দেখা গেছে তা যেন ঐ আয়াতেরই তাফসির। এতে হীনম্মন্যতার কিছু নেই।
সর্বশেষ একটি বিষয়ে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করব। হিজরি সপ্তম শতক মুসলমানদের জন্য বিরাট সংকটকাল ছিল। যখন তাতারিদের দ্বারা পুরো মুসলিম বিশ্ব আক্রান্ত হয়।
৬৫৬ হিজরিতে বাগদাদের খেলাফত ধ্বংস হয়ে যায়। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, এর পর মাত্র একশ’ বছর সময়ের ভেতরই সে যুগের মুসলমানরা এমনভাবে চেষ্টা চালায় যে, পুরো তাতার জাতি ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করে।
উক্ত ঘটনার সাতশ’ বছর পর বিংশ শতকের শুরুর দিকে রাজনৈতিকভাবে আরেক সংকটকাল উপস্থিত হয়। এ একশ’ বছর পৃথিবীর ক্ষমতায় রয়েছে প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের অমুসলিম কয়েকটি জাতি।
সত্য বলতে বর্তমান সময়ের আমরা সপ্তম শতকের উম্মতে মুসলিমার মতো আমাদের দায়িত্ব ঠিক আঞ্জাম দিতে পারিনি। আমাদের জাগতিক জ্ঞানে পশ্চাৎপদতা থাকলেও নৈতিক ও ধর্মীয় জ্ঞানের সম্ভার রয়েছে বিপুল।
পবিত্র কুরআন ও নবীজীর আদর্শ পৃথিবীবাসীর কাছে পৌঁছে দেয়ার যে দায়িত্ব রয়েছে সেটিই এখন মুখ্য হওয়া উচিত। তবে এ প্রচারের জন্যও রয়েছে সমসাময়িক জ্ঞান-বিজ্ঞানের ন্যূনতম চর্চা।
সামগ্রিকতা ও ভারসাম্যপূর্ণ পন্থায় ধর্মীয় ও জাগতিক জ্ঞানের সমন্বয় সাধন ও সার্বজনীন সহজ শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়নে মুসলিম চিন্তাবিদদের অনেক কিছুই আবিষ্কার করার রয়েছে।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে শিক্ষাক্ষেত্রে আমাদের তিনটি বিষয়ের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন।
১. শিক্ষার মানোন্নয়ন। এবং এ জন্য বিশেষায়িত শিক্ষাব্যবস্থার প্রবর্তন। বিভিন্ন বিভাগ গঠন এবং সেখানে নির্দিষ্ট বিষয়ে পারদর্শীতা সৃষ্টির চেষ্টা করে যেতে হবে।
পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের ভেতর যেন সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি না হতে পারে সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। নিজের বিষয়ের পাশাপাশি অন্যান্য বিষয় সংক্রান্ত জ্ঞানের চর্চাও সীমিত পরিসরে হলেও আবশ্যক। সর্বোপরি প্রতিটি ছাত্র-ছাত্রীকে বিশ্বদৃষ্টির অধিকারী হতে হবে।
আমাদের শিক্ষা কারিকুলাম তৈরি করতে হবে সেভাবে। নবীজী সম্পর্কে কুরআনুল কারিমে উল্লেখ করা হয়েছে, আমি তো আপনাকে সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য রহমতস্বরূপ প্রেরণ করেছি।
আমাদেরকে সম্বোধন করে বলা হয়েছে, তোমাদেরকে মানব জাতির কল্যাণের জন্য প্রেরণ করা হয়েছে। কাজেই সমগ্র বিশ্ব সম্পর্কে ধারণা নিয়ে বড় হওয়া উচিত মুসলিম শিক্ষার্থীদের।
২. এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে শিক্ষাকে সার্বজনীন করা। আল কুরআনে সমস্ত মানুষকে জ্ঞনার্জনের জন্য সমানভাবে তাগিদ দেয়া হয়েছে। শিক্ষা গ্রহণ কর হে চক্ষুষমানরা। জ্ঞানীদের জন্য এর মাঝে রয়েছে প্রভূত নিদর্শন।
এ ধরনের বহু আয়াতে জ্ঞানের প্রতি যে প্রণোদনা দেয়া হয়েছে তা কোনো বিশেষ শ্রেণিকে নয় সমগ্র মানব জাতির জন্যই এ সব আহ্বান জানানো হয়েছে। তা ছাড়া কোনো একটি শ্রেণির শিক্ষায় উন্নতির দ্বারা সমাজের সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব নয়।
কোনো বিশেষ বিষয়ে সর্বোচ্চ পারদর্শীতা সৃষ্টির চেয়ে এ জন্য আমার ক্ষুদ্র খেয়ালে ন্যূনতম শিক্ষার আলোয় যে কোনো দেশের সব নাগরিকের আলোকিত হওয়া অধিক গুরুত্বপূর্ণ।
সূরা আর রহমানের শুরুতে ইরশাদ হয়েছে, দয়াময় কুরআন শিক্ষা দিয়েছেন। তারপর ইরশাদ হচ্ছে, মানুষ সৃষ্টি করেছেন। এতে এ দিকে ইঙ্গিত রয়েছে যে, জ্ঞানার্জন ছাড়া মানুষ প্রকৃত মানুষ হতে পারে না। সুতরাং প্রতিটি মানুষ মানুষ হতে হলে তাকে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হতে হবে।
৩. তৃতীয় বিষয় হচ্ছে বর্তমান সময়ের গুরুত্ব বুঝতে হবে। সময়কে জানা একান্ত অপরিহার্য। সময়ের যে চাহিদা তা উপলব্ধি করতে হবে।
ঊনবিংশ শতক ছিল শিল্প বিপ্লবের যুগ। হাজার হাজার বছরের ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল শিল্প বিপ্লব। শিল্প বিপ্লবের দুশ’ বছরের মাথায় এখন নতুন এক যুগের সূচনা হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ ব্যবহারের সুযোগ তৈরি হয়েছে।
বিশ্বায়নের এ যুগে পুরো পৃথিবী এসে গেছে সত্যিকার অর্থেই হাতের মুঠোয়। আমাদের স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসাসমূহে এর সর্বোৎকৃষ্ট ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
সঙ্গে সঙ্গে এর ক্ষতিকর দিকগুলো থেকে কীভাবে বেঁচে থাকা যায় সে সম্পর্কে আমাদেরকে ভাবতে হবে। বিশেষত ইন্টারনেট ও মোবাইল ব্যবহারের ক্ষতিকর দিকগুলো থেকে ছাত্র-ছাত্রীদের রক্ষা করতে শিক্ষক-শিক্ষিকা ও সংশ্লিষ্ট সবার সচেতনতার গুরুত্ব অপরিসীম।