বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে হৃদয় অর্ঘ্য


ডেস্ক রিপোর্ট :: ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ শেখ মুজিবুর রহমানের একটি বই, একটি জীবন, একটি ইতিহাস। বইটিকে বলা যায় বাঙালির ঘরের খোলা জানালা, রৌদ্র করোজ্জ্বল বারান্দা, উন্মুক্ত প্রাণময় উঠান, বিস্তৃত শ্যামলা শস্যের মাঠ, শত শত স্রোতস্বিনী নদী, দূরের মনোমুগ্ধকর সবুজ পাহাড় আর ভালোলাগার বঙ্গোপসাগর। এ বইতে নদী মেঘলা মাটির গন্ধ আছে। মধুমতি নদীর কাদা মাখানো আছে এবং বাইগার নদীর নির্যাস আছে। টুঙ্গিপাড়া নামক
অজগ্রামের আলো-বাতাসের ম-ম গন্ধ আছে

আমেরিকা ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে একটি গল্প প্রচলিত আছে। এক বিশাল দ্বীপকে নিয়ে গল্পটি তৈরি। এ দ্বীপে প্রায় ৫ লাখ লোকের বাস। দ্বীপটির নিরাপত্তা ঝুঁকি খুব প্রকট। দ্বীপবাসী দেখল উজ্জ্বল এক আলোকবর্তিকা ধীরে ধীরে আকাশ থেকে নেমে আসছে। তারা একে অনুসরণ করল এবং একটি বড় ফাঁকা মাঠে তা এসে থামল। অর্থাৎ সেটাই ছিল একজন দেবদূত। চারদিকে হাজার হাজার মানুষ এসে জমা হলেন। তারা তার সঙ্গে কথা বলতে চাইলেন। দেবদূত বললেন, ‘তোমাদের এত লোকের সঙ্গে তো আমার কথা বলা সম্ভব নয়, বরং তোমরা তিনজন প্রতিনিধি নির্বাচন করে দাও আমি তাদের কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করব ও কথা বলব। তারা তিনজন প্রতিনিধি নির্বাচন করে দিলেন। একজন বৃদ্ধ শতায়ু, আরেকজন আধুনিক ফিটফাট কেতাদুরস্ত, অন্যজন সাদাসিধা বুদ্ধিদীপ্ত ও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বলেই মনে হয়। প্রথমে বৃদ্ধ এলে দেবদূত কুশল বিনিময়ের পর জিজ্ঞেস করলেন, ‘এখন থেকে আটচল্লিশ ঘণ্টা পর তোমাদের এ দ্বীপে জলোচ্ছ্বাস হবে এবং বাড়িঘর, সহায়-সম্পদসহ তোমাদের সবাইকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। তুমি এখন কী করবে?’ বৃদ্ধ ব্যক্তি বললেন, ‘আমি জীবনে অনেক পাপ করেছি, এখন বয়স হয়েছে আর বেশিদিন বাঁচব না, এ সময়ে কান্নাকাটি করে বিধাতার দরবারে মাফ চেয়ে নেব, যাতে পরকালে আমার ভালো হয়। দ্বিতীয় ব্যক্তি একই প্রশ্নের উত্তরে বললেন, ‘জীবনে আমি অনেক কিছুই ভোগ করেছি, এখন যতটুকু সময় অবসর আছে খাওয়া-দাওয়া ফুর্তি ইত্যাদি সেরে নেব। মৃত্যুর পর কী পাব না পাব, তা নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই।’ এবার তৃতীয় ব্যক্তি একই প্রশ্নের উত্তরে চিন্তা করে বললেন (৪৮ ঘণ্টাকে মনে মনে মিনিট ও সেকেন্ড হিসাব করে নিলেন) ‘এখনও ১ লাখ ৭২ হাজার ৮০০ সেকেন্ড সময় আছে আমি আমার দ্বীপের ৫ লাখ লোককে সংগঠিত করে তাদের ১০ লাখ হাতকে কাজে লাগাব এবং জলোচ্ছ্বাস আসার আগেই দ্বীপের চারদিকে এমন বাঁধ নির্মাণ করব, যাতে জলোচ্ছ্বাসের পানি লোকালয়ে প্রবেশ করতে না পারে এবং একটি লোকেরও যেন জান ও মালের ক্ষতি না হয়।’ দেবদূত তার কথা শুনে অত্যন্ত খুশি হলেন এবং তাকে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘আমি তোমার সঙ্গে আছি।’ ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অভাব-অনটন, রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতাবিরোধীদের যে জলোচ্ছ্বাস তা মোকাবিলার জন্য বাঁধ তৈরিতে উদ্বুদ্ধ ও কাজে লাগানো হচ্ছে নেতা বা রাজনীতিকের কাজ। আপামর জনসাধারণকে উদ্বুদ্ধ করাই নেতার সাফল্য। তেমনি এক মহান নেতা হলেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আজ ১৭ মার্চ তার ৯৮তম জন্মবার্ষিকী। এ দিনটিকে বলা যেতে পারে ব্যাটন রেস। গ্যালিলিওর মৃত্যুর বছরেই জন্ম হয়েছিল আরেক মহারথি নিউটনের। গ্যালিলিওর মৃত্যুর ঠিক ৩০০ বছর পর জন্ম নেন স্টিফেন হকিং। আইনস্টাইনের মৃত্যুর বছরে জন্ম নেন বিল গেটস এবং স্টিভ জবস। এ যেন ইতিহাসের বেটনরেস, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে সত্য ও সুন্দরের পতাকা বহন করে চলা। ভবিষ্যৎ পাকিস্তানের মৃত্যু আর বাংলাদেশের জন্মদিন ১৭ মার্চ। সহজ কথায় বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন সে তো বাংলাদেশরই জন্মদিন। শুভ জন্মদিন। ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জ জেলার বাইগার নদীর তীরঘেঁষা ছবির মতো সুন্দর হিরণময় টুঙ্গিপাড়া গ্রামে বাঙালি জাতির কোলকে আলোকিত করে বাবা শেখ লুৎফর রহমান এবং মা সায়েরা খাতুনের ঘরে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। বাংলার দুঃখী মানুষের দুঃখে মুজিব আশৈশব বিচলিত ছিলেন। বাল্যকালেই তার জীবনীতে নেতৃত্বের গুণ দেখা যায়। ১৯৩৯ সালে মুজিব যখন গোপালগঞ্জ মিশন হাইস্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র, তখন অবিভক্ত মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা একে ফজলুল হক এবং অন্যতম মন্ত্রী শহীদ সোহরাওয়ার্দী ওই হাইস্কুল পরিদর্শনে যান। সাম্প্রদায়িক প্রতিকূলতাকে পায়ে দলে কিশোর মুজিব মাননীয় মন্ত্রীদের যথাযোগ্য সংবর্ধনা জানান এবং ছাত্রদের পক্ষ থেকে স্কুল ছাত্রাবাসের নষ্ট ছাদ মেরামতের দাবি জানিয়ে অবিলম্বে তা কার্যকর করার ব্যবস্থা করিয়ে নেন। এখানেই মুজিবের নেতৃত্বের উন্মেষ ঘটে। এ সংবর্ধনাকে কেন্দ্র করে তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হয় এবং কিশোর মুজিবকে সাত দিনের কারাবাস ভোগ করতে হয়। কিশোর জীবনের কারাবাসের অভিজ্ঞতা থেকেই মুজিব যে কোনো স্বৈরশাসকের ভ্রুকুটিকে উপেক্ষা করে বাঙালি জাতীয়তাবাদী সংগ্রামকে এগিয়ে নেওয়ার সাহস ও শক্তি সঞ্চয় করেন। আসলেই মুজিব জন্মগতভাবেই সাহসী। সার্থক প্রতিবাদী, অকুতোভয় সংগ্রামী। আর প্রতিবাদী মুজিব শুধু শাব্দিক অর্থেই নয়, বাস্তবেও প্রমাণিত সত্য। কলকাতা শহরে তখন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা চলছে। বেলাশেষে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজের হোস্টেল প্রাঙ্গণে ঘটে গেল এক হৃদয়বিদারক ঘটনা। একজন অবাঙালি সাম্প্রদায়িক গু-া হোস্টেল প্রাঙ্গণে অবস্থানরত এক বাঙালি ছাত্রের পেটে ছোরা মেরে তাকে ধরাশায়ী করে। এ অবস্থা দেখে মুজিব ভীষণভাবে বিচলিত হন এবং ওই অবাঙালি গু-াকে ধরে ফেলার জন্য তার পিছে ধাওয়া করেন। অবাঙালি গু-া শহরের অন্ধকার গলির মধ্যে পালিয়ে যায়। মুজিব ফিরে এসে হোস্টেলের গেটে লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে থাকেন পরবর্তী যে কোনো প্রতিক্রিয়া মোকাবিলা করার জন্য। এমন সময় মুসলিম ছাত্রলীগের কয়েকজন সদস্য গেটে মুজিবকে ওই অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করেন, মুজিব ভাই আপনি এ অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছেন কেন? উত্তরে মুজিব বলেন, ‘এই মাত্র একজন অবাঙালি গু-া একজন বাঙালি ছাত্রের পেটে ছোরা মেরে পালিয়ে গেল। তোমরা আমার পাশে এসে দাঁড়াও অবাঙালি গু-াদের সায়েস্তা করতে হবে। বাঙালিদের বাঁচাতে হবে।’ উপরোক্ত তথ্য থেকে বোঝা যায়, বাঙালিপ্রিয় মুজিব বাংলায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন নির্যাতিত, নিপীড়িত, পরশাসিত, শোষিত, অধঃপতিত বাঙালি জাতির ত্রাণকর্তা, নেতা ও পিতার দায়িত্ব পালনের জন্য। বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশ, বাংলাদেশ এবং বঙ্গবন্ধু একে অপরের সঙ্গে এমনভাবে জড়িত, যেভাবে জড়িত গাছ এবং শিকড়, সাগর এবং ঊর্মিমালা, ফুল এবং গন্ধ, আকাশ এবং সূর্য। কারণ এগুলোকে কখনও আলাদা বা বিচ্ছিন্ন করা যায় না। ২০০৪ সালে আকস্মিকভাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের লেখা চারটি খাতা তার কন্যা বর্তমান সরকার প্রধান শেখ হাসিনার হস্তগত হয়। খাতাগুলো পাঠ করে জানা গেল এটি বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী, যা তিনি ১৯৬৭ সালের মাঝামাঝি সময়ে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে অন্তরিন অবস্থায় লেখা শুরু করেছিলেন; কিন্তু শেষ করতে পারেননি। জেল-জুলুম, নিগ্রহ-নিপীড়ন তাকে সদা তাড়া করে ফিরেছে, রাজনৈতিক কর্মকা-ে উৎসর্গীকৃত-প্রাণ, সদাব্যস্ত বঙ্গবন্ধু যে আত্মজীবনী লেখায় হাত দিয়েছিলেন এবং কিছুটা লিখেছেনও এ বইটি তার স্বাক্ষর বহন করেছে। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ শেখ মুজিবুর রহমানের একটি বই, একটি জীবন, একটি ইতিহাস। বইটিকে বলা যায় বাঙালির ঘরের খোলা জানালা, রৌদ্র করোজ্জ্বল বারান্দা, উন্মুক্ত প্রাণময় উঠান, বিস্তৃত শ্যামলা শস্যের মাঠ, শত শত স্রোতস্বিনী নদী, দূরের মনোমুগ্ধকর সবুজ পাহাড় আর ভালোলাগার বঙ্গোপসাগর। এ বইতে নদী মেঘলা মাটির গন্ধ আছে। মধুমতি নদীর কাদা মাখানো আছে এবং বাইগার নদীর নির্যাস আছে। টুঙ্গিপাড়া নামক অজগ্রামের আলো-বাতাসের ম-ম গন্ধ আছে। সেই গ্রামে মানবশিশু ছোট্ট খোকার জন্ম ও বেড়ে ওঠার নিবিড় বর্ণনা আছে। যে খোকা নিজেই তার কথা বলেছেন। বলেছেন নিজের ভাষায়, নিজের ভালোবাসায়। স্মৃতি থেকে তুলে এনে জাদুকরি বর্ণনায় সত্যকে সুন্দর করে বলার এক অসম্ভব, অসাধারণ শব্দ গাথা এটি। কারাগারের বন্দি জীবনের নির্জন, বন্ধ, প্রকৃতির মায়াহীন, ছায়াহীন ঘরে বসে বেদনার্ত মনে কী করে এমন রূপময় বর্ণনায় বাঙালির মন, রূপ, রস, গন্ধ, আনন্দ, বেদনা আর এ স্নিগ্ধ জননী-জন্মভূমির কথা সহজ-সরল ও প্রবহমান ভাষায় নিজের আত্মকথনের মাধ্যমে তুলে ধরলেন, কিছুতেই ভেবে পাই না। এতদিন যাকে জানতাম বাঙালির কান্ডারি, তাকে এখন বইটির মাধ্যমে আবিষ্কার করলাম ইতিহাসের এক রাখাল রাজা, এক অসাধারণ কথক হিসেবে। বঙ্গবন্ধুর ৫৫ বছরের জীবনে ১২ বছরের অধিক কেটেছে কারাগারে, জীবনের অর্ধেক কেটেছে রাষ্ট্রীয় নিপীড়নে, পুরো জীবন গেছে স্বাধীনতা নির্মাণে। আজ একটি কথা না লিখে পারছি না, আমরা কি জানি ওহপষঁংরাব ফবসড়পৎধপু-এর কথা। ৭ মার্চের ভাষণে তিনি বলেন, ‘যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও, একজন যদিও হয় তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেব।’ গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় সমালোচনা হলো সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের নামে অনেক ভালো চিন্তা ও উদ্যোগ বাতিল হয়ে যায়। শুভ কাজ সংখ্যাগরিষ্ঠের চাপে পিষ্ঠ হয়। ওহপষঁংরাব ফবসড়পৎধপু হলো ভালো পরামর্শ ও প্রস্তাব যদি একজনও হয় তাকে মূল্যায়ন করা উচিত। যে মহান মানুষটি কমপক্ষে একজন লোকের মতামত এবং সর্বোচ্চ লোকের মতামতকে গুরুত্ব দিতেন অর্থাৎ আপামর জনগণকে জীবন দিয়ে কী রকম ভালোবাসতেন তার একটি কথা না লিখে পারছি না। বিশ্ববিখ্যাত সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্ট হয়তো বেকায়দায় ফেলতে বা বিব্রত করতে কিংবা সরলভাবে বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞেস করেছিলেনÑ গৎ. চৎরসব সরহরংঃবৎ যিধঃ রং ুড়ঁৎ য়ঁধষরভরপধঃরড়হ? উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘ও ষড়াব সু ঢ়বড়ঢ়ষব.’ এরপর তিনি প্রশ্ন করেনÑ ডযধঃ রং ুড়ঁৎ ফরংয়ঁধষরভরপধঃরড়হ? চোখ মুছতে মুছতে প্রতিভাদীপ্ত কণ্ঠে বলেন, ‘ও ষড়াব ঃযবস ঃড়ড় সঁপয’. পরিশেষে সর্বদা উপকারী, নিজে না খেয়ে অন্যকে খাওয়ানো, অসহায় মানুষের অধিকার আদায়ে সচেষ্ট, খোকা থেকে মুজিব, মুজিব থেকে বঙ্গবন্ধু, বঙ্গবন্ধু থেকে বাঙালি জাতির জনককে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ এনে দেওয়ার জন্য শুধু জন্মদিবসেই নয়, তাকে মনে পড়ে পাখি ডাকা ভোরে, রোদেলা দুপুরে, সূর্যের সামনে, জ্বলন্ত মোমের আড়ালে, হেলে যাওয়া বিকালে, শান্ত গোধূলিতে, কনকনে শীতে, মুষলধারে বৃষ্টিতে, চাঁদের সুষমা ভরা রাতে, আর চেতন-অবচেতন মনে। হ

মো. কায়ছার আলী
শিক্ষক, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *