বাংলাদেশের প্রখ্যাত নৃবিজ্ঞানী এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. এ কে এম মাজহারুল ইসলাম। সম্প্রতি জাগো নিউজের সাথে একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নৃবিজ্ঞানের সমসাময়িক চাহিদা ও গুরুত্বের কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন সজীব বণিক–
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নৃবিজ্ঞানকে কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?
অধ্যাপক মাজহারুল ইসলাম: আশির দশক থেকে বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে নৃবিজ্ঞান চর্চা শুরু হয়েছে। যদিও এ দেশে নৃবৈজ্ঞানিক গবেষণার ঐতিহ্য আরও পুরোনো। সমাজ যেহেতু মানুষকে নিয়ে অতএব নৃবৈজ্ঞানিক গবেষণা খুব গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়া বাংলাদেশ একটি জনবহুল ও সমস্যাসঙ্কুল দেশ। এখানে প্রচুর সমস্যা রয়েছে, যা নৃবিজ্ঞানীরা তাদের অর্জিত জ্ঞানের মাধ্যমে সমাধানে সচেষ্ট হতে পারে। নৃবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা মাঠপর্যায়ে গবেষণা করে প্রাপ্ত সমস্যা ও সমাধানের চিত্র তুলে আনতে সক্ষম। কেননা নৃবৈজ্ঞানিক গবেষণা পদ্ধতি ও মানুষ সম্পর্কিত পঠন পাঠন নৃবিজ্ঞানের একাডেমিক শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত। বাংলাদেশে নৃবিজ্ঞান বিষয়ে বেশ গুরুত্বপূর্ণ কিছু গবেষণা হয়েছে। বছরে গড়ে প্রায় ৪০০ স্নাতক ও স্নাতকোত্তর জনবল তৈরি হচ্ছে। তারা সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন জায়গায় কৃতিত্বের সাথে কাজ করছে। তবে নৃবিজ্ঞানীর জন্য নির্দিষ্ট করে আরও কাজের ক্ষেত্র প্রস্তুত করা খুবই জরুরি। কলেজসহ বিভাগীয় ও জেলা পর্যায়ে স্টাফ নৃবিজ্ঞানীর পদ সৃষ্টি করা প্রয়োজন। বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানে নৃবিজ্ঞানীদের জন্য সুনির্দিষ্ট পদ তৈরি করা জরুরি।
বলা হয়ে থাকে, বিদেশে নৃবিজ্ঞানের গুরুত্ব থাকলেও বাংলাদেশে তেমন নেই। এ সীমাবদ্ধতার কারণ কী?
অধ্যাপক মাজহারুল ইসলাম: দেশের বাইরে গুরুত্ব বেশি কিংবা আমাদের দেশে কম ব্যাপারটা এমন নয়। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো নৃবিজ্ঞান হচ্ছে এক অন্তর্দৃষ্টি। এই দৃষ্টি বিকশিত হলে মানুষকে এবং মানুষের সমস্যাকে বোঝা সম্ভব। বাংলাদেশ জনবহুল দেশ। এখানে অনেক সমস্যা ও সীমাবদ্ধতা আছে। ফলে এসব সমাধানকল্পে নৃবিজ্ঞানীরা নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করতে পারে। এ দেশে রাষ্ট্রীয় পরিসরে ও বেসরকারিভাবে নৃবিজ্ঞানীদের কাজের আরও সুযোগ দরকার।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিকৃত শিক্ষার্থীদের মাঝে বিষয় বিভ্রাট দেখা যায়। এ সমস্যা দূরীকরণে কী করা যেতে পারে?
অধ্যাপক মাজহারুল ইসলাম: পৃথিবী নিয়ত পরিবর্তনশীল। তাই আমরা নতুন নতুন বিষয়ের সাথে যেমন পরিচিত হচ্ছি; তেমনি কিছু কিছু বিষয় হারিয়েও যাচ্ছে। পৃথিবীর বহু দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ভর্তি করানোর পর বিষয়ভিত্তিক কাউন্সিলিং করানো হয়। যারা সেই বিষয়ে পড়ে ভালো কাজ করেছে, তাদেরকে দিয়ে অনুপ্রেরণামূলক আলোচনা-পর্যালোচনার ব্যবস্থা করা হয়। আমাদের দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখনো এ ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয় না। ফলে শিক্ষার্থীরা অল্পতেই হতাশ হয়ে পড়ে। অনুপ্রেরণার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের প্রথম থেকেই উৎসাহী করে তোলাটা জরুরি।
রোহিঙ্গা সঙ্কট নিরসনে নৃবিজ্ঞানীরা কিভাবে ভূমিকা রাখতে পারে?
অধ্যাপক মাজহারুল ইসলাম: এটা মূলত রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক বিষয়। তবে নৃবিজ্ঞানীরা স্থানীয় জনগোষ্ঠী ও রোহিঙ্গাদের মিথস্ক্রিয়া ও তাদের সমস্যা এবং মনোভাব সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা দিয়ে সাহায্য করতে পারে। নীতি নির্ধারকরা নৃবিজ্ঞানীদের প্রাপ্ত গবেষণালব্ধ ফলাফলকে কাজে লাগাতে পারে। এ বিষয়ে নৃবিজ্ঞানীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
একজন নৃবিজ্ঞানী হিসেবে বাংলাদেশকে কিভাবে দেখতে চাইছেন?
অধ্যাপক মাজহারুল ইসলাম: কোনো সমাজ বা রাষ্ট্রে একেবারে বৈষম্য নির্মূল সম্ভব নয়। তবে সহনীয় বৈষম্যের এক জ্ঞানভিত্তিক সমাজের প্রত্যাশা করি। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ সমৃদ্ধ, পরমতসহিষ্ণু এক উদারনৈতিক সমাজের প্রত্যাশা করি। মানুষ তার স্বাধীনতা ও আত্মমর্যাদা নিয়ে বাঁচতে পারবে এবং বিকশিত হতে পারবে এমন এক সমাজ প্রত্যাশা করি।
সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
অধ্যাপক মাজহারুল ইসলাম:আপনাকেও ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা।