মিশিগানে আবরার হত্যার প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত

Banglashangbad

বুয়েটের ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ (মুজাহিদ) হত্যার কারনে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীবৃন্দ, নানান শ্রেণী পেশার মানুষ বিচারের দাবিতে সেচ্চার। এরই ধারাবাহিকতায় গত ৯ অক্টোবর মিশিগানের সচেতন বাংলাদেশী সমাজ আবরারের হত্যার বিচারের দাবিতে বিশেষ আলোচনা এবং শোকসভা আয়োজন করে। এই সভা অনুষ্ঠিত হয় মিশিগানের বাংলাদেশী অধ্যুষিত এলাকা হ্যামট্রামাকের আলাদীন রেস্টুরেন্টে। বিভিন্ন পেশায় নিয়জিত এবং ওয়েন স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসহ শতাধিক মানুষ এতে অংশগ্রহণ করেন।

সভায় বক্তা আমিন শরফুজ্জামান বলেন,  “বিশ্ববিদ্যালয় মননশীলতা, ভিন্নমতের সুচিকাগার। শুধু গৎবাঁধা সিলেবাস, পাঠ্যবই নয়, এখানে নানান বিষয়ে সবার ভিন্নমত থাকবে, এ নিয়ে তর্ক বিতর্ক থাকবে যা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু এই ভিন্নমত প্রকাশের দায়ে একটি স্বাধীন দেশে কাউকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হবে তা কোনভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। ফেসবুকে সামান্য একটি স্ট্যাটাসের জের ধরে আবরার কে শেরে বাংলা হলের ২০১১ নাম্বার রুমে, পরবর্তীতে ২০০৫ নাম্বার রুমে নিয়ে দফায় দফায় বেধড়ক পেটানো হয়। আবরার মাঝে দুই দফা বমি করে এবং যারা তাকে মারছিল অনেকবার তাদের কাছে ক্ষমা চায়, কিন্তু এতেও ঘাতকদের মন গলে নি। তারা ক্রিকেট খেলার স্ট্যাম্প দিয়ে পেটানো অব্যাহত রাখে, যার করুন পরিণতি আবরারের মৃত্যু।“

তিনি আরও বলেন , “বুয়েটের বিভিন্ন হলে এই ঘটনা অনেক আগে থেকেই হয়ে আসছে। এর আগেও অত্যন্ত সামান্য কারণে ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হয়েছে আরও অনেক ছাত্র। পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী গত কয়েক বছরে অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে বুয়েট ছেড়েছে অন্তত ৫০ জন শিক্ষার্থী। র‍্যাগিং, নির্যাতন এখন হলসমূহে একদম সাধারণ ঘটনা। ব্যাপারটা এমন যে, আবরার যদি একটু কম মার খেয়ে বেঁচে যেত, তাহলে এবিষয়য়ে আর কোন উচ্চ্যবাচ্চ্য হত না, আর দশটা র‍্যাগিং এর মতই সবাই ভুলে যেত। জাতি হিসাবে আমরা তখনই হেরে যাই যখন আমাদের বিবেক জাগ্রত হবার জন্য একটি মৃত্যুর প্রয়োজন হয়। বুয়েট বাংলাদেশের শ্রেষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়, যেখানে সারা দেশ থেকে সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীরা এসে ভর্তি হয়, সেখানে এই ধরনের আচরণ কোনভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। আমরা শুধু বুয়েট নয়, সব বিশ্ববিদ্যালয়ে এই ধরনের ভয়ংকর পরিস্থিতির অবসান চাই।“

সভায় উপস্থিত রাজিউর রহমান বলেন, “আবরার হত্যাকান্ডের জন্য প্রশাসনের নিষ্কৃয়তা সরাসরিভাবে দায়ী। বুয়েটের বিভিন্ন হলে হলে ছাত্রদের টর্চার সেল মোটামুটি ওপেন সিক্রেট। সেখানে নিয়মিত ভাবে র‍্যাগিং এর নামে করে, সামান্য তুচ্ছ কারণে এর আগেও অনেকে নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এই বিষয়ে সম্যক অবগত থাকা সত্ত্বেও হল প্রশাসন, ছাত্র কল্যাণ পরিদপ্তর (DSW), উপাচার্য কেউই কার্যকরী ভূমিকা নিতে পারে নি। উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ জানিয়েও মেলেনি কোন সুফল। আবরারের মর্মান্তিক মৃত্যুর পর থেকে ফেসবুকে অনেকে বিগত বছরগুলোতে ঘটে যাওয়া নির্যাতনের ঘটনা জানিয়েছেন। বেশ কয়েকজন বলেছেন নির্যাতনের মাত্রা এতই ভয়াবহ যে আবরারের স্থানে তাদের মৃত্যু হতে পারত, বিশেষ ভাগ্যগুনে বেঁচে গিয়েছেন। এই বিশেষ বড় ভাই গ্রুপের যাকে পছন্দ হতো না, তাকেই টর্চার সেলে ডেকে নিয়ে এসে পেটানো হত। সালাম না দেওয়া, ক্যাম্পাসে মেয়ে বন্ধু নিয়ে ঘোরা, মিছিলে যোগদান না করা,  ফেসবুকে ভিন্নমত প্রকাশ ইত্যাদি, এই ধরনের তুচ্ছ কারণে অত্যন্ত নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েছে অনেকে।  মেরে একাধিক জনের হাত পা ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছে। এমনই নির্যাতনের শিকার একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন সে হল প্রভোস্টের কাছে তার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা বিষয়ে লিখিত অভিযোগ করেছিল। প্রভোস্ট স্যার থাকে সিনিয়র ভাইদের সাথে “মানিয়ে চলার” পরামর্শ দেন। ছাত্রলীগের মার খেয়ে গুরুতর আহত একজনের বাবা DSW স্যারের সাথে দেখা করতে গিয়েছিল, তাকে বলা হয় তার ছেলেকে হল থেকে নিয়ে গিয়ে অন্য কোথাও রাখতে। মাত্র কিছুদিন আগে র‍্যাগিং এর সময় চড় মেরে একজনের কানের পর্দা ফাটিয়ে ফেলা হয়। এমন জঘন্য ঘটনায় প্রশাসন লোক দেখানো সামান্য শাস্তি দিয়েই ক্ষান্ত হয়েছে। এমন আরও অনেক উদাহরণ দেওয়া যায় যেখানে প্রশাসন অত্যন্ত বিশ্রীভাবে নির্যাতনকারীর পক্ষ অবলম্বন করেছে। যা পরবর্তিকালে ছাত্র নামধারী সন্ত্রাসীদের  নির্যাতনে পরোক্ষভাবে উৎসাহ যুগিয়েছে। বছরের পর বছর ধরে চলে আসা এইসবেরই চূড়ান্ত ফল ভোগ করেছে আবরার ফাহাদ।“

“যারা আবরার কে পশুর মত পিটিয়েছে, তাদের যদি কৃতকর্মের জন্য সামান্য শাস্তির ভয় থাকত, তাহলে কি তারা এমনভাবে আবরারকে মারতে পারত? এই সন্ত্রাসীদের এমন ভয়হীন, নিশ্চিত পরিবেশ কে দিয়েছে? প্রশাসনের সকল পর্যায়ের কর্তাব্যক্তিরা এদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলেন। মাননীয় উপাচার্য, ছাত্র কল্যাণ পরিচালক নিয়মিত রাজনৈতিক সংগঠন আয়োজিত বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতেন। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা ত্রাসের রাজত্ব কায়েমে তারা সরাসরি মদদ দিয়েছে। গ্রেফতারকৃত ছাত্রদের নাহয় বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হতে পারে, কিন্তু এই অথর্ব, অকর্মন্য, কর্তব্যে অবহেলাকারী, সন্ত্রাসের উৎসাহপ্রদানকারী, আবরার হত্যার পরোক্ষ সহায়তাকারী প্রশাসনের বিচার কে করবে?”

সভায় শরীফ হাসান বলেন,  আবরার হত্যার ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার লক্ষে দেশে বিদেশে ছড়িয়ে থাকা বুয়েটিয়ানদের ঐক্যবদ্ধ ভাবে কাজ করতে হবে। তিনি বলেন এই বিষয়ে ইতিমধ্যে একটি ফেসবুক গ্রুপ খোলা হয়েছে একই সাথে তিনি কিছু সুনিদৃষ্ট প্রস্তাবনা তুলে ধরেন।

  • আবরার হত্যার বিচারিক প্রক্রিয়ার নিয়মিত খোজ খবর রাখা। যেহেতু এই মামলা সরকার বাদীপক্ষ এবং সরকারি পাবলিক প্রসিকিউটর গন কাজ করবে, তাদের কার্যকলাপ, এবং পুরো মামলার গতিবিধি সম্পর্কে সজাগ দৃষ্টি রাখা। আমরা চাই না নির্দোষ কেউ শাস্তি ভোগ করুক, এবং দোষীরা কেউ আইনের ফাঁক গলে বের হয়ে যাক।
  • আবরার হত্যাকাণ্ড ছাড়াও সাম্প্রতিককালে যেসব র‍্যাগিং/নির্যাতনের ঘটনা হয়েছে, তার সঠিক তদন্ত, বিচার এবং দোষীদের উপযুক্ত শাস্তি প্রদান করার জন্য বুয়েট কর্তৃপক্ষকে বাধ্য করা।
  • ভবিষ্যতে বুয়েটে সকল প্রকারের র‍্যাগিং বন্ধে প্রশাসনের সক্রিয় ভূমিকা পালন।
  • র‍্যাগিং বন্ধে হটলাইন চালু করা যাতে কেউ র‍্যাগিং এর শিকার হলে দ্রুততার সাথে এ সম্পর্কে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে সহিত অবহিত করতে পারে।
  • ন্যায় বিচার নিশ্চিত করার লক্ষে দেশে বিদেশে সকলের নিজ নিজ অবস্থান থেকে সরকার এবং বিচারিক কার্যক্রমে জড়িত সংস্থা সমুহের উপর চাপ প্রয়োগ করা।
  • নির্যাতনকারী ছাত্রদের একটি সেন্ট্রাল ডেটাবেজ তৈরি করা যেখানে ঘটনার বিস্তারিত লিপিবদ্ধ রাখা।

এই সভায় সকলে আবরারের মর্মান্তিক মৃত্যুতে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন এবং দ্রুততম সময়ে এর বিচার নিশ্চিত করার দাবি জানান। আবরারের রুহের মাগফিরাত কামনার মাধ্যমে শোকসভা সমাপ্ত হয়।