রোহিঙ্গাদের এনআইডি কার্ড ও পাসপোর্ট পাওয়া নিয়ে আলোচনা সমালোচনায় হচ্ছে। বিশেষত ডাকাত নূর আলম নিহত হওয়ার পর তার ডিজিটাল আইডি কার্ড পাওয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ইসি সার্ভারে ৪৬ থেকে ৭৩ জন রোহিঙ্গার নাম অন্তর্ভুক্তির কথা খবরে জানা গেছে। প্রকৃতপক্ষে এ সংখ্যা বহুগুণ বেশি। তাই রোহিঙ্গারা কীভাবে স্মার্ট কার্ড ও পাসপোর্ট পেল তা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। এ সংশ্লিষ্ট বিষয়াবলী অনুসন্ধানে যে ফলাফল পাওয়া যায় তা তুলে ধরছি।
যেভাবে পাসপোর্ট পেয়েছে:
এযাবত রোহিঙ্গাদের যতগুলো পাসপোর্ট মিডিয়ায় এসেছে তার প্রায় সবগুলোই লেমিনেটেড এনআইডি কার্ডের সূত্রে ইস্যু করা হয়েছে। পাসপোর্টে ব্যক্তিগত নম্বরের যে ঘরটি রয়েছে সেখানে জন্ম নিবন্ধন বা জাতীয় পরিচয় পত্রের নম্বর দিতে হয়। স্মার্ট কার্ড ১০ ডিজিটের হয়ে থাকে, অন্যদিকে ১৩ ডিজিটের লেমিনেটেড জাতীয় পরিচয়পত্রে জন্মসাল যুক্ত করতে হয়।
রোহিঙ্গাদের থেকে উদ্ধার করা সবগুলো পাসপোর্টেই ১৭ ডিজিটের ব্যক্তিগত নম্বর উল্লেখ রয়েছে যা গত কয়েক বছরের মধ্যে ইস্যু হওয়ার সুযোগ নেই। ২০১২ সালের আগে যারা ভোটার তালিকার মাধ্যমে এনআইডি কার্ড পেয়েছিলেন, তাদের জন্য পাসপোর্ট পাওয়া তুলনামূলকভাবে সহজ ছিল। তবে কিছু পাসপোর্ট ইস্যু হয়েছে ভুয়া এনআইডি কার্ডের বিপরীতে যা যোগসাজশ ছাড়া যা সম্ভব নয়।
যেভাবে জাতীয় পরিচয়পত্র পেয়েছে:
সম্প্রতি নিহত ডাকাত নূর আলমের উদাহরণ দেয়া যায়। সে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয় ১৯৯২ সালে রাখাইন থেকে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে টেকনাফের জাদিমুরা এলাকায় আশ্রয় নেয়। তারপর থেকে ইয়াবা ব্যবসাসহ সন্ত্রাসী গোষ্ঠী তৈরি করে কোটিপতি বনে যায়। বিয়ে করে টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের জাদিমুরা ওয়ার্ড বিএনপির প্রভাবশালী নেতা মোসতাক আহমদের কন্যাকে।
তার চারটি বাড়ি থাকার কথা জানা গেছে। সুতরাং তার পক্ষে ভোটার লিস্টে যুক্ত হওয়া খুব বেশি কঠিন ছিল না। নূর আলম স্মার্ট কার্ড ও পাসপোর্ট পেয়েছে লেমিনেটেড জাতীয় পরিচয়পত্রের সূত্রে। তার পাসপোর্টের ব্যক্তিগত নম্বরের ঘরে সেই কার্ডের নম্বর দেয়া আছে, যা ইস্যু হয় ২০০৮ সালে অর্থাৎ ২০০৫-০৬ এর আগে ভোটার তালিকায় নাম থাকার ফলশ্রুতিতে।
রোহিঙ্গাদের থেকে উদ্ধারকৃত এনআইডি কার্ডের কিছু সংখ্যক ভুয়া, বাকিগুলোর প্রায় সবই বিএনপি জামায়াতের শাসনামলে ভোটার তালিকায় যুক্ত হওয়ার সুবাদে পাওয়া।
রোহিঙ্গাদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তি:
বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটছে ১৯৭৮ সাল থেকে। তখন থেকে প্রতিনিয়ত ১০ থেকে ৫০০ জন রোহিঙ্গা পুশইনের চেষ্টা চালিয়েছে মায়ানমার, যা কখনোই আলোচনায় আসেনি। ২০১০ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত বিজিবির পুশব্যাকের তথ্যে দেখা যায় প্রতি বছর কয়েক হাজার।
রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ প্রতিরোধ করে পুশব্যাক করা হয়েছে। তবে ১৯৯২ ও ২০১৭ সালে মায়ানমার যেভাবে রোহিঙ্গা দমন করেছে তাতে আশ্রয় দেয়া ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে ১৯৯২ সালে আগত রিফুজিদের একজনকেও মায়ানমার ফেরত নেয় নি, উপরন্তু ভোটের আশায় বিএনপি-জামায়াতের পৃষ্ঠপোষকতায় রোহিঙ্গাদের বড় একটি অংশ ভোটার হওয়ার সুযোগ পায়।
রোহিঙ্গাদের ভোটার হওয়া, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত করা ও বাংলাদেশি হিসেবে বিদেশ চাকুরি নিয়ে যেতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন আহমেদ। তিনি গ্রেফতারও হয়েছিলেন রোহিঙ্গাদের মাধ্যমে অরাজকতা সৃষ্টির অভিযোগে। ২০০৩ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত যেকোনো আন্তর্জাতিক কান্ট্রি রিপোর্টে রোহিঙ্গাদের রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা ও তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে তার প্রতিবাদ করার উল্লেখ রয়েছে। বর্তমানে আমরা রোহিঙ্গাদের কাছে যেসব জাতীয় পরিচয় পত্র দেখছি তার সম্ভবত সবই এর ফলাফল।
জাতীয় পরিচয়পত্র সরবরাহের টাইমলাইন:
জাতীয় পরিচয়পত্র পেতে দীর্ঘসূত্রিতা সম্পর্কে সকলেই অবগত। এ কারণে রোহিঙ্গাদের অনেকে ভুয়া আইডি কার্ড তৈরি করেছেন। যেমন: রোহিঙ্গাদের একটি কার্ডে দেখা যায় ইস্যুর তারিখ ২৩ জানুয়ারি, ২০১৮। অথচ এই সময়ে আইডি কার্ড ইস্যুই হয় নি। ২০১২ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত কোনো জাতীয় পরিচয় পত্র দেয়া হয় নি। স্মার্ট কার্ডও সকলকে জন্য দেয়া হয় নি। এ সংশ্লিষ্ট কয়েকটি সংবাদ উল্লেখ করছি:
তিন বছর আগে ভোটার হওয়া ব্যক্তিদের স্মার্ট কার্ড নয়, লেমিনেটিং করা জাতীয় পরিচয়পত্র দেয়া হবে।
২০১৮ সালের জানুয়ারিতে বাদ পড়া ৯৩ লাখ ভোটারকে লেমিনেটেড এনআইডি দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
২০১৮ জুলাই মাসে লেমিনেটেড এনআইডি পাওয়া ঝুলে যায়।
২০১৮ এর সেপ্টেম্বরে এনআইডি কার্ড দেয়ার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়।
এক্ষেত্রেও শর্ত আছে। যে ৯৩ লাখ ভোটারকে কার্ড দেয়ার সিদ্ধান্ত হয় তারা ২০১২ সালের পর ভোটার হওয়া নাগরিক। গত দুই বছরে অনুপ্রবেশকারী ১১ লাখ রোহিঙ্গাদের মধ্যে একজনও এনআইডি কার্ড পেয়েছেন বলে জানা যায় না। তাই তাদের জন্য একটি পথ খোলা ছিল, তা হচ্ছে ভুয়া আইডি কার্ড।
সংবাদ: ভুয়া আইডি কার্ড তৈরির সরঞ্জামসহ ৮ রোহিঙ্গা আটক
বিএনপি জামায়াতের শাসনামলে রোহিঙ্গাদের এনআইডি কার্ড পাওয়ার দৃষ্টান্ত দিয়েছি যেন সরকার সচেতন হয় এবং বিরোধী পক্ষও যেন রোহিঙ্গা ইস্যুতে রাজনীতি না করে জাতীয় স্বার্থে ঐক্যের মনোভাব পোষণ করেন। সমালোচনা করার আগে আয়নায় চেহারা দেখা জরুরি। তবে এ কথা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে ১৯৭৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত রোহিঙ্গা সংকটে আমরা কোনো সাফল্য পাইনি।
উপরন্তু ১৯৯২ সালে বাংলাদেশ-মায়ানমার চুক্তিতে আন্তর্জাতিক মহলের পরামর্শ আমলে নিয়ে রোহিঙ্গাদের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দেয়ার মাধ্যমে আত্মঘাতী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। তাই এ সংকট উত্তরণে জাতীয় ঐক্য প্রয়োজন। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে কাশ্মীর ইস্যুতে মতভেদ থাকলেও পাকিস্তান ইস্যুতে সকল রাজনৈতিক দলই একট্টা। আমাদের মাঝে যদি এ ইস্যুতে ঐক্য না থাকে তাহলে সংকট উত্তরণ বোধহয় কঠিন হবে।