রোহিঙ্গা নেতাকে গুলি চালিয়ে হত্যা, আটক ১, স্বচ্ছ তদন্ত ও বিচার চায় বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা


মিয়ানমার থেকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশের কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠির নেতা মোহাম্মদ মুহিবুল্লাহকে গত বুধবার রাতে গুলি চালিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা।

বুধবার রাত সাড়ে ৮টায় উখিয়া উপজেলার ১-ইস্ট নম্বর লম্বাশিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ডি-৭ ব্লকে তার উপর গুলিবর্ষণ হয়। সঙ্গে সঙ্গে তাকে উখিয়ার কুতুপালংস্থ এমএসএফ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।

সেখানে রাত সোয়া ১০টার দিকে মুহিবুল্লাহ মারা যান বলে জানিয়েছেন রোহিঙ্গা শিবিরের নিরাপত্তায় থাকা ১৪ আমর্ড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) অধিনায়ক পুলিশ সুপার মো. নাঈম-উল হক।

৪৮ বছর বয়সী মুহিবুল্লাহ আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি পিস ফর হিউম্যান রাইটস নামে একটি সংগঠনের চেয়ারম্যান ছিলেন। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডুর এলাকার স্কুলশিক্ষক মুহিবুল্লাহ পশ্চিমা সংবাদ মাধ্যমে ‘রোহিঙ্গাদের কণ্ঠস্বর’ হিসেবে বিবেচিত ছিলেন।

এদিকে শুক্রবার বেলা ১১টার দিকে উখিয়া উপজেলার কুতুপালংয়ের লম্বাশিয়া ক্যাম্পের এপিবিএন সদস্যরা এ হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত সন্দেহে এক রোহিঙ্গাকে আটক করেছে।

তাৎক্ষণিকভাবে আটক ব্যক্তির নাম পরিচয় জানায়নি পুলিশ। আটক রোহিঙ্গাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে বলে নইমুল হক জানিয়েছেন।

মোহাম্মদ মুহিবুল্লাহকে রোহিঙ্গাদের আরেকটি সংগঠন আরসার সদস্যরা হত্যা করেছে বলে সন্দেহ করছে তার পরিবার।

বৃহস্পতিবার বিকালে কক্সবাজার সদর হাসপাতাল মর্গের সামনে মুহিবুল্লাহর ছোট ভাই মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহ সাংবাদিকদের বলেন, বুধবার রাতে উখিয়ার ১-ইস্ট নম্বর লম্বাশিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের স্থানীয় মসজিদে দুই ভাই মিলে নামাজ আদায় করেন। এরপর মুহিবুল্লাহসহ তিনি আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি পিস ফর হিউম্যান রাইটস অফিসে যান। সেখানে তিনি (মুহিবুল্লাহ) কয়েকজন রোহিঙ্গা নেতাদের সঙ্গে আলাপ করছিলেন। পরে তিনি (হাবিবুল্লাহ) ঘরে খাবার খেতে যান।

“খাবার খাওয়ার এক পর্যায়ে গুলির শব্দ শুনে বের হয়ে আমি এআরএসপিএইচআর অফিসে যাই। এসময় আমার ভাই মুহিবুল্লাহকে রক্তাক্ত অবস্থায় মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখি। তাকে ঘিরে ছিল ১৫/২০ জন অস্ত্রধারী লোকজন।”

তিনি বলেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনার এক পর্যায়ে মুখে মাস্ক ও গামছা পরিহিত ওই অস্ত্রধারীরা হামলা চালায়। তবে সেখানে আরও কয়েকজন থাকলেও শুধু মুহিবুল্লাহকে লক্ষ্য করেই গুলি ছুড়েছিল।

মুখঢাকা হলেও হামলাকারী কয়েকজনকে চিনতে পারার দাবি করে হাবিবুল্লাহ বলেন, “আরসার নেতা মাস্টার আব্দুর রহিম, লালু ও মুর্শিদসহ ৩/৪ জনকে চিনতে পেরেছি। এরা বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বসবাস করে আসছে। অন্যদের চিনতে পারিনি।”

হামলার কারণ কী- জানতে চাইলে তিনি বলেন, “সম্প্রতি রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য আমেরিকা ও জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মহলের সাথে বাংলাদেশের ইতিবাচক আলালোচনা হয়েছে।

“আমার ভাই মুহিবুল্লাহ দ্রুত প্রত্যাবাসন নিয়ে খুবই আশাবাদী ছিলেন। কাল রাতে এ নিয়েই এআরএসপিএইচআর অফিসে বসে অন্য রোহিঙ্গা নেতাদের সঙ্গে আলাপ করছিলেন তিনি।”

পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, খুনিরা রোহিঙ্গা বলেই তাদের ধারণা।

এ হত্যাকাণ্ডকে জঘন্য ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করে স্বচ্ছ তদন্ত করে দায়ীদের বিচারের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন।

যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, “আমরা এই জঘন্য অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে তার মৃত্যুর পূর্ণ ও স্বচ্ছ তদন্তের দাবি জানাই।”

মুহিবুল্লাহকে বিশ্বব্যাপী রোহিঙ্গাদের অধিকারের পক্ষে ‘সাহসী ও জোরালো বক্তা’ হিসাবে বর্ণনা করে ব্লিনকেন বলেছেন, হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তিনি ‘গভীরভাবে শোকাহত ও বেদনাহত’।

জেনেভাতে জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলে এবং যুক্তরাষ্ট্র সফরে গিয়ে স্বজাতির অধিকারের পক্ষে তার জোরালো অবস্থানের কথাও বিবৃতিতে স্মরণ করেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

তিনি বলেন, “সফরে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্টের কাছে তার অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছিলেন এবং ধর্মীয় কারণে নির্যাতনের শিকার অন্যদের সঙ্গে মিলে বক্তব্য দিয়েছিলেন।”

এ হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানিয়ে দ্রুত তদন্ত করে দোষীদের বিচারের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর।

বৃহস্পতিবার সংস্থার এক বিবৃতিতে এ দাবি জানিয়ে বলা হয়, “ঘটনার দ্রুত তদন্ত করতে এবং দায়ীদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে আমরা বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছি।”

মুহিবুল্লাহকে গুলি করে হত্যার ঘটনা তদন্ত করে দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনার আহ্বান জানিয়েছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনটি এক বিবৃতিতে বলেছে, মুহিবুল্লাহকে হত্যার ঘটনা পুরো রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়েছে।

“এই হত্যার ঘটনা তদন্ত করে দোষীদের সবাইকে তাদের অপরাধের জন্য ন্যায়বিচারের মুখোমুখি করা এখন বাংলাদেশ সরকারের দায়িত্ব।”

কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর বাসিন্দাদের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সরকার এবং জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থাকে একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।

রোহিঙ্গা শিবিরে কাজ করা বিভিন্ন এনজিও ও বিদেশি সংস্থার সঙ্গে মুহিবুল্লাহর সম্পর্ক ছিল । ইংরেজি জানার সুবাদে তিনি রোহিঙ্গাদের প্রতিনিধি হিসেবে বিদেশিদের সঙ্গে আলোচনা চালাতেন।

মুহিবুল্লাহকে হত্যার ঘটনায় শোক জানিয়ে অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন বাংলাদেশে কর্মরত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিরা।

ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত আর্ল আর মিলার এক টুইটে বলেছেন, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মানবাধিকার রক্ষায় অগ্রণী ভূমিকায় থাকা মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডে তিনি ‘দুঃখিত ও বেদনাহত’।

“আমি তার পরিবারের প্রতি শোক জানাচ্ছি এবং আশা করি, অপরাধীদেরকে বিচারের আওতায় আনা হবে।”

এক বিবৃতিতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ঢাকা কার্যালয় বলেছে, রোহিঙ্গা নেতা ও মানবাধিকার কর্মী মুহিবুল্লাহর হত্যাকাণ্ড মর্মান্তিক ঘটনা।

“আমরা তার পরিবারের প্রতি শোক জানাচ্ছি। আমরা আশা করি, কর্তৃপক্ষ তার হত্যাকারীদের বিচারের আওতায় আনতে সফল হবে।”

ঢাকায় যুক্তরাজ্যের হাই কমিশনার রবার্ট ডিকসন বলেন, “আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের নেতা মুহিবুল্লাহর হত্যাকাণ্ডে মর্মাহত ও শোকাহত। তার পরিবার ও রোহিঙ্গাদের জন্য বড় ধরনের ক্ষতি। আমার আন্তরিক শোক।”

ঢাকায় জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক মিয়া সেপ্পো বলেন, “মুহিবুল্লাহর প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছি, যিনি ছিলেন রোহিঙ্গাদের কণ্ঠস্বর। মিয়ানমারে যেই রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছিল এবং তারা বসবাস করছে অনিশ্চয়তা ও অনিরাপত্তার মধ্যে।

“এই সংঘাতের শান্তিপূর্ণ সমাধানের পক্ষে থাকা অ্যাক্টিভিস্টরা কেমন ঝুঁকির মধ্যে আছেন, তার এই হত্যাকাণ্ড তা মনে করিয়ে দিচ্ছে।”

ইউরোপীয় ইউনিয়নের এশিয়া-প্যাসিফিক বিভাগের পরিচালক পাওলি পাম্পালনি বলেন, রোহিঙ্গাদের নেতা ও মানবাধিকারের পক্ষে থাকা কাজ করা মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডে তিনি মর্মাহত। অপরাধীদের অবশ্যই বিচারের আওতায় আনতে হবে।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *