কমলগঞ্জের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের ভেতরের সড়ক ও রেলপথে যানবাহনের নিচে পিষ্ট হয়ে প্রতিদিন গড়ে অন্তত দুই থেকে তিনটি প্রাণী মরে যাচ্ছে । প্রাণবৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ এই বনের ভেতর দিয়ে চলে গেছে ৬ দশমিক ৫ কিলোমিটার উপজেলা সংযোগ সড়ক এবং ঢাকা-সিলেট রেলপথে প্রায় ৮ কিলোমিটার। যার ফলে সড়ক ও রেলপথে দুর্ঘটনায় বন্যপ্রাণীর মৃত্যুর মিছিল কোনোভাবে থামছে না।
এ নিয়ে দীর্ঘদিন থেকে আন্দোলন করে আসছেন প্রাণীপ্রেমীরা। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয়নি। প্রস্তাব আর পরিদর্শনেই সীমাবদ্ধ লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান রক্ষার বিভিন্ন উদ্যোগ।
লাউয়াছড়া বনের ভিতর দিয়ে যাওয়া সড়ক পথে প্রতিদিন প্রায় ৪ থেকে ৫শ ছোট-বড় গাড়ি চলাচল করে দ্রুত গতিতে। রাস্তা পারাপারের সময় বন্যপ্রাণীরা এসব গাড়ির চাকায় পিষ্ট হয়ে মারা যায় বলে জানান সংশ্লিষ্টরা ।
বন বিভাগের সূত্রে জানা যায়, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্য ১২ শ ৫০ হেক্টরের লাউয়াছড়াকে জাতীয় উদ্যান ঘোষণা করা হয় ১৯৯৬ সালে। বিশ্বব্যাপী বিরল এবং বিপন্ন অনেক বৃক্ষ, উদ্ভিদ এবং প্রাণীর বসবাস মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে। বাংলাদেশের একমাত্র আফ্রিকান টিকওক গাছ রয়েছে লাউয়াছড়ায়। সম্প্রতি আইইউসিএন বিশ্বব্যাপী মহাবিপন্ন ঘোষণা করেছে চীনা বনরুইকে। সে বনরুই বাংলাদেশের মধ্যে একমাত্র লাউয়াছড়াতেই একটু ভালো অবস্থানে আছে।
স্থানীয়দের সঙ্গে আলাপে জানা যায়, বনের ভেতর রাস্তা দিয়ে বন্যপ্রাণীরা সড়কের এ পাশ থেকে ও পাশে নিয়মিত আসা-যাওয়া করে। এক সময় যানবাহনের সংখ্যা কম থাকলেও বর্তমানে তা বেড়েছে। যান বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে বৃদ্ধি পেয়েছে মৃত্যুর হার। দিনের চেয়ে রাতের বেলায় বন্যপ্রাণীর বিচরণ বেশি। রাস্তা পারাপারের সময় হঠাৎ সামনে চলে আসা দ্রুতগামী যানবাহন। যানবাহনের আলোতে প্রাণীরা হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। তখন দ্রুতগামী গাড়ির আঘাতে অনেক প্রাণী মারা যায়।
সম্প্রতি মধ্যরাতে নিজের গাড়ি দিয়ে লাউয়াছড়ার সড়ক দিয়ে কমলগঞ্জ থেকে শ্রীমঙ্গল ফিরছিলেন শ্রীমঙ্গল পর্যটন সেবা সংস্থার সাংগঠনিক সম্পাদক এস কে দাস সুমন। তিনি জানান, লাউয়াছড়া ভেতরে প্রবেশ করার পর একটি খরগোশ গাড়ির সামনে দিয়ে দৌড়াতে থাকে। প্রায় ৩ কি.মি রাস্তা খরগোশটি গাড়ির আলোয় দৌড়ানোর পর বনের ভেতর ঢোকে। আমি গাড়ির গতি কমিয়ে দিই যার কারণে সে বেঁচে যায়। কিন্তু বেশির ভাগ চালক তা করেন না। বরং ইচ্ছাকৃত দ্রুতগতিতে চলেন।
এ সড়ক দিয়ে চলাচলকারীরা জানান, প্রায়ই সড়কের ওপর, সড়কের পাশে বন্যপ্রাণীর মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখছেন। গত বছর উল্লুক নিয়ে গবেষণার কাজে লাউয়াছড়া ছয়বার এসেছেন তানভীর আহমেদ সৈকত। এই ছয়বারে তাদের গবেষণা কাজ চলার সময় ২৮টি মৃতদেহ পেয়েছেন তিনি।
বেসরকারি পর্যায়ে লাউয়াছড়ার ভেতর সড়ক পথে দুর্ঘটনায় বন্যপ্রাণীর মৃত্যু নিয়ে টানা ১৪ মাস গবেষণা করে ক্রিয়েটিভ কনজারভেশন অ্যালায়েন্স। গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয় ২০১৩ সালে। ১৪ মাসের গবেষণায় তারা লাউয়াছড়ার সড়কে ৫০৩টি সাপের মৃতদেহ পেয়েছেন। সবগুলো সাপেরই সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে।
ক্রিয়েটিভ কনজারভেশন অ্যালায়েন্সের গবেষক শাহরিয়ার সিজার জানান, ১৪ মাসে ২৯৪ দিন আমরা ফিল্ডে কাজ করেছি। আমরা আমাদের গবেষণায় শুধু সাপের মৃত্যু হিসেব করেছি। মৃত প্রাণীর উল্লেখযোগ্য একটি অংশের দেহ পাওয়া যায় না। কারণ শিয়ালসহ কিছু প্রাণী আছে যারা মৃতদেহ খেয়ে ফেলে। অনেক প্রাণী আবার সড়কে গুরুতর আহত হয়ে বনের ভেতরে গিয়ে মারা যায়। লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে যায় এই মৃত প্রাণীদের বিরাট একটি অংশ। তাই সঠিক হিসেব বলা সম্ভব নয়। তবে সাধারণ দৃষ্টিতে এবং পরিসংখ্যানে ধারণা, প্রতিদিন গড়ে তিন থেকে চারটি প্রাণী মারা যাচ্ছে। সাপের মৃত্যুর হার বর্ষায় বেশি। কারণ সাপ শীতে কম চলাচল করে। সাত বছর আগে আমরা কাজ করলেও বর্তমানেও এই অবস্থা অব্যাহত আছে।
২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবির) প্রাণীবিদ্যা বিভাগের ছাত্র মো. রাসেল মিয়া, মো. সালাহউদ্দীন, মো. জায়েদুল ইসলাম ও মো. জামান মিয়া মিলে পাঁচ মাস লাউয়াছড়া বনের ভেতরে সড়ক দুর্ঘটনায় উভচর ও সরীসৃপ প্রাণীর মৃত্যু নিয়ে গবেষণা করেছেন।
প্রতি মাসে তারা একবার করে লাউয়াছড়ার রেললাইনের প্রায় ৬ দশমিক ৫ কিলোমিটার ও সড়ক পথের প্রায় ৮ কিলোমিটার পথে দুর্ঘটনায় মৃত প্রাণীর দেহ খুঁজেছেন। তাদের দেওয়া তথ্য মতে, তারা মোট ২২১ মৃত প্রাণী পেয়েছেন। যার মধ্যে ৪৭ শতাংশ ছিল গাড়ির চাকায় পিষ্ট হয়ে আর ৪৩ শতাংশ রেলের চাকায় পিষ্ট হয়ে মারা গেছে।
এই দলের একজন মো. সালাহউদ্দীন জানান, বর্ষাকালে উভচর ও সরীসৃপ প্রাণীদের মৃত্যুর মিছিল কতটা ভয়াবহ হতে পারে তা একটি পরিসংখ্যান দেখলেই বুঝতে পারবেন। আমাদের গবেষণা শীতকালের হলেও কৌতূহলে বর্ষার একটা দিন আমরা সার্ভে করেছিলাম। সেই সার্ভেতে একদিনে উভচর ও সরীসৃপের ১৬৫টি মৃত দেহ পেয়েছি।
বন বিভাগের শ্রীমঙ্গল রেঞ্জ কর্মকর্তা (বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ) মোনায়েম হোসেন জানান, ২০১৯ সালে ৩২টি প্রাণী মারা গেছে তার মধ্যে ২০টি সাপ এবং ১২টি বিভিন্ন প্রজাটির স্তন্যপায়ী প্রাণী।
এদিকে প্রাণী মারা যাচ্ছে বিদ্যুতের তারেও। কমলগঞ্জ জীববৈচিত্র্য রক্ষা কমিটির সাধারণ সম্পাদক মো. আহাদ মিয়া জানান, শুধু সড়ক ও রেলপথে নয় বন্যপ্রাণী মারা যাচ্ছে বৈদ্যুতিক খোলা লাইনে। লাউয়াছড়া ভেতরে দিয়ে টানা বিদ্যুৎ লাইনে বিরল প্রজাতির বিশেষ করে বাদুড়, বানর মারা যায়।
শ্রীমঙ্গল লাউয়াছড়া বন ও জীব বৈচিত্র্য রক্ষা আন্দোলনের আহ্বায়ক প্রভাষক জলিপাল জানান, আমরা অনেক দিন থেকেই সড়ক পথ সরানোর ব্যাপারে আন্দোলন করে যাচ্ছি। কিছু দিন আগে বন পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী মো. শাহাবউদ্দিন বলেছিলেন লাউয়াছড়ার সড়ক পথ সরানো হবে প্রয়োজনে নেট দিয়ে প্রাণীর নিরাপত্তা দেওয়া হবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে সবকিছুই শুধু প্রস্তাব আর আশ্বাসেই আছে।
কিছুদিন আগে বন, পরিবেশ ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী লাউয়াছড়া পরিদর্শনে আসেন। তখন বিকল্প সড়কের ব্যাপারে প্রস্তাবের আলোচনা হয়।
এ বিষয়ে বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও, বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ) আব্দুল ওয়াদুদ জানান, রাস্তাটি সরবে কি না সে ব্যাপারে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি তবে আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। সম্প্রতি সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন সরেজমিনে দেখে গেছেন। তিনি আমাদের বলে গেছেন আগামী সংসদীয় কমিটির সভায় বিষয়টি নিয়ে গুরুত্ব সহকারে আলোচনা করা হবে। আমরা সেই অপেক্ষা করছে। আমরা প্রস্তাব দিয়েছি যে, শ্রীমঙ্গলের রাধানগর হয়ে কমলগঞ্জের বটতলায় গিয়ে রাস্তাটি উঠবে। এতে ৫ কিলোমিটার পথ বাড়বে কিন্তু লাউয়াছড়া পুরোপুরি আলাদা হয়ে যাবে।