ভারতের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন এবং জাতীয় নাগরিক পঞ্জিকা নিয়ে বিতর্কের জেরে দেশটির রাজনৈতিক আবহ যখন সরগরম, ঠিক তখনই কলকাতার মাটিতে দাঁড়িয়ে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় এক কোটি শরণার্থীকে আশ্রয় দেয়ার জন্য ভারতের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শুক্রবার কলকাতার আলিপুরের একটি পাঁচতারা হোটেলে একান্ত বৈঠকে বসেন দুই নেত্রী। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হলেও ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বহুল আলোচিত তিস্তা পানি বণ্টন চুক্তির বিষয়টি বৈঠকে তোলাই হয়নি।
বৈঠকের পর শেখ হাসিনা সাংবাদিকদের বলেন, ‘আশা করি, সেই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক চিরদিন বজায় থাকবে।’ অন্য দিকে মমতা বলেন, ‘দুই বাংলা ও দুই দেশের নানা বিষয়ে কথা হয়েছে। আমাদের সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ ও সৌহার্দ্যপূর্ণ থাকবে, সেই আশা করি।’
প্রাথমিকভাবে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কোনও আলাদা বৈঠকের সূচি ছিল না প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। কিন্তু নবান্ন থেকে বৃহস্পতিবারই একান্ত বৈঠক চেয়ে বার্তা পাঠানো হয়। সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যায় ঢাকাও। সেই সূত্রেই ঠিক হয়, শুক্রবার সন্ধ্যায় ২০ মিনিট একান্তে কথা বলবেন দুই নেত্রী। বাস্তবে অবশ্য বৈঠক গড়ায় প্রায় ৫০ মিনিট।
ওইদিন সন্ধ্যা সোয়া ৬টার দিকে মুখ্যমন্ত্রী পৌঁছে যান আলিপুরের হোটেলে। সেখানে প্রথমে উভয় পক্ষের কূটনীতিক এবং কর্মকর্তাদের সঙ্গে দুই নেত্রীর কথা হয়। সেই বৈঠকে মমতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বলেন, শিল্প, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে দুই বাংলার মধ্যে আরও আদানপ্রদানের সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশে সাইকেল শিল্পে বাড়বাড়ন্তের কথা মুখ্যমন্ত্রীকে জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তা শুনে মমতা বলেন, বাংলাদেশের সাইকেল নির্মাতারা এ রাজ্যে বিনিয়োগ করতে চাইলে তাদের জমি দেয়া হবে।
পরে একান্তে কথা বলেন শেখ হাসিনা ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বৈঠকের পর মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘দুই বাংলা এবং দুই দেশের সম্পর্ক বরাবরই ভাল। দু’দেশের বিভিন্ন বিষয়ে কথা হয়েছে। আলোচনা ছিল সৌজন্যমূলক।’ তবে বহুল আলোচিত তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি এবং দেশটির এনআরসি নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্ন এড়িয়ে যান মমতা।
সূত্রের বরাত দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের বাংলা দৈনিক আনন্দবাজার বলছে, বৈঠকে দুই নেত্রীর কেউই তিস্তা প্রসঙ্গ তোলেননি। তবে এনআরসি নিয়ে ভারতে যা ঘটছে; সে ব্যাপারে বাংলাদেশ যে অবহিত, আলোচনায় সেই ইঙ্গিত দিয়েছেন শেখ হাসিনা। বস্তুত, মমতার সঙ্গে বৈঠকের পরই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী যেভাবে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে এক কোটি শরণার্থীর ভারতে আশ্রয় নেয়ার প্রসঙ্গ তুলেছেন, তাকে তাৎপর্যপূর্ণ বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের অনেকে।
তাদের মতে, কলকাতায় এসে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারত তথা পশ্চিমবঙ্গের অবদানের কথা এর আগে বহুবার বলেছেন বাংলাদেশের শাসক দল আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা। সেটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। শেখ হাসিনা তার বাবা শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতের সাহায্য-সমর্থনের কথা স্মরণ করেন।
আনন্দবাজার বলছে, কিন্তু এখন এনআরসি-র আবহে যখন বাংলাদেশ থেকে আসা মানুষদের ভবিষ্যৎ কী হবে, তাদের চিহ্নিত করে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হবে কি-না, তা নিয়ে ভারতে জল্পনা শুরু হয়েছে, তখন মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোর কথা মনে করিয়ে দেয়ার পেছনে কূটনৈতিক কৌশল রয়েছে।
শেষ বেলায় এই রাজনীতি-কূটনীতির ছোঁয়াটুকু বাদ দিলে শেখ হাসিনার এগারো ঘণ্টার সফরজুড়ে ছিল শুধুই ক্রিকেট। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের প্রধান সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের আমন্ত্রণে তিনি কলকাতা এসেছেন। গোলাপি বলে টেস্টের প্রথম দিনে বাংলাদেশ ভালো খেলতে না পারলেও, ভবিষ্যতে তারা ভালো করবে বলে আশাপ্রকাশ করেছেন তিনি।