শ্রমজীবীদের বিজয়ের দিন


বিশ্বের কোটি কোটি শ্রমজীবী মানুষের আত্মত্যাগের প্রতীক মে দিবস। শ্রমিক-স্বার্থরক্ষা আন্দোলনের ঐতিহাসিক দিন মহান মে দিবস। শ্রমিক-স্বার্থরক্ষা আন্দোলনের ঐতিহাসিক দিন মহান মে দিবস। শ্রমজীবী মানুষের মহান বিজয়ের দিন ঐতিহাসিক মে দিবস। এইদিন শ্রমিকেরা নির্দিষ্ট সময়ে কাজ করা এবং ন্যায্য পারিশ্রমিক আদায়ের দাবি প্রতিষ্ঠিত করেছিলো। ১৮৮৬ সাল থেকেই প্রতি বছর বিশ্বের মেহনতী মানুষসহ সকল শ্রেণির মানুষ শ্রদ্ধার সঙ্গে পালন করে আসছে দিবসটি। বিশ্বের প্রতিটি দেশের সার্বিক উন্নতি সাধিত হয়েছে শ্রমিক-শ্রেণির মাধ্যমে। ভবিষ্যতেও তাদের শ্রমে ঘামে ঘটবে উন্নয়ন-অগ্রগতি। সুতরাং দিবসটি শুধু শ্রমিক শ্রেণির জন্যই স্মরণীয় নয়, পুরো জনগোষ্ঠীর কাছেই স্মরণীয় বরণীয়। বিশ্বের বুকে যতোদিন শ্রমিক শ্রেণি থাকবে, যতোদিন তাদের ওপর জুলুম নির্যাতন চলবে, যতোদিন তারা ন্যায্য পাওনা ও সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত থাকবে, যতোদিন তারা বৈষম্যের শিকার হবে, ততোদিনই এই মহান মে দিবস তাদেরকে অফুরান শক্তি যোগাবে, প্রেরণা যোগাবে।

একটি আন্দোলনের নাম মে দিবস। একটি বিপ্লবের নাম মে দিবস। ১৮৮৬ সালের আজকের এই দিনে শ্রমজীবী মানুষ বুকের রক্ত দিয়ে আদায় করেছিলো তাদের অধিকার। সেই দিনটির পূর্বেও বিশ্বে শ্রমিক-শ্রেণি ছিলো, দিনমজুর ছিলো, ছিলো মেহনতী মানুষ। তাদের ওপর শত শত বছর ধরে চলেছে নির্যাতন, নিপীড়ন-শোষণ। তাদেরকে বঞ্চিত করা হয়েছে ন্যায্য পাওনা থেকে। কাজের নির্দিষ্ট সময়সীমা না থাকায় তাদের প্রতিদিন কাজ করতে হতো ১৪ থেকে ১৮ ঘন্টা। মালিক ইচ্ছেমতো সব সময় অমানবিক পরিশ্রম করাতো শ্রমিকদের। বিশেষ করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পুঁজিবাদের বিস্তার ঘটার পর শ্রমিক-শ্রেণি বেশি করে শোষণ নির্যাতনের শিকার হতে থাকে। উন্নত বিশ্বের দেশগুলো বিশেষ করে আমেরিকা ইউরোপের পুঁজিবাদীরা শ্রমজীবী মানুষদের নানা কৌশলে শোষণ-নিপীড়ন করে আসছিলো। তখন কোনো শ্রমআইন, শ্রমনীতি ছিলো না।

এভাবে শোষিত নিষ্পেষিত হতে হতে এক পর্যায়ে শ্রমিকরা সোচ্চার হয়ে ওঠে, সংগঠিত হয়। আর মে দিবসের রক্তাক্ত আন্দোলন থেকেই শ্রমিক শ্রেণি বিশ্বের বুকে একটি সংগঠিত শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়।
১৮৮৬ সালের পয়লা মে আমেরিকার শিকাগো শহরে শ্রমিকরা নিজেদের অধিকার আদায়ে ধর্মঘটের ডাক দেয়, মিছিল করে। তাদের দাবি ছিলো দৈনিক আট ঘন্টা কাজের সময়সীমা বেধে দেয়া, উপযুক্ত পারিশ্রমিক প্রদান ইত্যাদি। কিন্তু এই দাবি মেনে নিতে চায়নি সরকার। তাই আন্দোলন দমাতে লেলিয়ে দেয় পুলিশ বাহিনী। পুলিশের গুলিতে রাজপথে লুটিয়ে পড়ে মেহনতি-শ্রমিকের তাজা প্রাণগুলো। তারপরও থামেনি আন্দোলন, বরং তা আরও বেগবান হয়। জেগে ওঠে বিশ্বের শ্রমিক-মেহনতি জনতা। অবশেষে শাসক শ্রেণি মেনে নিতে বাধ্য হয় শ্রমিকদের দাবি। দৈনিক আট ঘন্টা কাজের সময়সীমা সারা বিশ্বে স্বীকৃতি পায়। প্রতিষ্ঠিত হয় আন্তর্জাতিক শ্রমসংস্থা। ১৮৮৯ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক কনভেনশনে শ্রমিকদের কল্যাণে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়। এর মধ্যে রয়েছে শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ আইন, নারী শ্রমিকদের মাতৃত্ব কল্যাণ আইন, শ্রমিক নিয়োগ আইন ইত্যাদি। এসব আইন বিশ্বের সবকটি দেশে স্বীকৃত হলেও সেগুলো সর্বত্র পুরোপুরি বাস্তবায়িত হচ্ছে না।

বিশ্ব আজ বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, সভ্যতা-সব দিক দিয়েই অনেক দূর এগিয়ে গেছে। কিন্তু এর পেছনে যাদের নিরন্তর শ্রম বিনিয়োগ হয়েছে-সেই শ্রমিক শ্রেণির বর্তমান অবস্থা কী? তারা কি এখনও ন্যায্য অধিকার ভোগ করছে? দুঃখজনক হলেও সত্য যে, মহান শ্রমিক আন্দোলনের একশ’ ৩৩ বছর পরও শ্রমিকরা শোষণ, নির্যাতন, নিপীড়নের শিকার হচ্ছে অহরহ। অনেক শ্রমিক এখনও তাদের কাজের ন্যায্য মজুরি পাচ্ছে না। এখনও নতুন নতুন কৌশলে শ্রমিকদের শোষণ করা হচ্ছে; পারিশ্রমিক প্রদানে নারী-পুরুষে বৈষম্য করা হচ্ছে। আমাদের দেশের শ্রমিকদের অবস্থা আরও করুণ। এখানে শোষণ-নির্যাতন ছাড়াও ভবন ধস, পাহাড় ধস আর অগ্নিকান্ডের শিকার হচ্ছে শ্রমিকরা। এখনও তাদেরকে রাজপথে নামতে হচ্ছে ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য। এখনও তাদের নির্যাতিত হতে হচ্ছে পুলিশের হাতে, শিল্পের মালিকের হাতে গৃহকর্তার হাতে। এভাবেই ভুলুণ্ঠিত হচ্ছে মে দিবসের অঙ্গীকার। যে শ্রমিকরা আমাদের সভ্যতাকে গড়ে তুলেছে তিলে তিলে, তাদেরকে অবহেলিত রেখে কোনো জাতি এগিয়ে যেতে পারেনা। আজ মহান মে দিবসে আমাদের প্রত্যাশা-দেশে দেশে শ্রমিক বৈষম্যের অবসান হোক এবং তারা তাদের ন্যায্য অধিকার ও সম্মান লাভ করুক। অমর হোক মে দিবস।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *