আন্তর্জাতিক ডেস্ক :: শ্রীলংকায় ভয়াবহ সিরিজ বোমা হামলার পর বার বার উচ্চারিত হচ্ছে মোহাম্মদ হাশিম মোহাম্মদ জাহরান নামে এক উগ্রবাদীর নাম। এরইমধ্যে এ হামলার মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবেও তাকে শনাক্ত করা হয়েছে। কিন্তু কে এই জঙ্গি জাহরান, কী তার পরিচয়? এই প্রতিবেদনে জাহরানের আদ্যোপান্ত তুলে ধরা হলো-
বার বার স্কুল, মাদরাসা, কর্মস্থল থেকে বহিষ্কার হওয়া এক ব্যক্তিই হলেন জাহরান। ভারত মহাসাগরের তীরে গড়ে ওঠা একটি ছোট্ট শহর শ্রীলংকার কাত্তানকুড়িতে দুই কক্ষের একটি ছোট্ট বাড়িতে বাবা-মা ও পাঁচ ভাইবোনের সঙ্গে বসবাস করতেন তিনি।
জাহরানের বাবা কাত্তানকুড়ির রাস্তায় রাস্তায় খাবার বিক্রি করতেন। ছোটবেলা থেকেই জাহরান ছিলেন খুবই মেধাবী, একরোখা স্বভাবের। ১২ বছর বয়সে জাহরানকে ‘জামিয়াতুল ফালাহ অ্যারাবিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়ার জন্য ভর্তি করে দেয় তার পরিবার।
জাহরানের বোন মাদানিয়া সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, তারা পাঁচ ভাইবোন। ভাইবোনদের মধ্যে ৩৩ বছর বয়সী জাহরান সবার বড়। তার স্ত্রী মোহামেদ হাদিয়ার বয়স ২৩। তাদের আট বছর বয়সী এক ছেলে ও চার বছরের একটি মেয়ে রয়েছে।
প্রতিষ্ঠানটির ভাইস প্রিন্সিপাল এস. এম. আলিয়ার রয়টার্সকে বলেন, জাহরানের বাবা জাহরানের পড়াশোনার জন্য তেমন কিছু করতেন না। জাহরান তার অসাধারণ স্মরণশক্তি দিয়ে শিক্ষকদের চমকে দিয়েছিলেন। ছোট্ট জাহরান সেখানেই মাত্র তিন বছরে পবিত্র কোরআন মুখস্ত করে হাফেজ হন। তারপর তিনি এ প্রতিষ্ঠানেই ইসলামী আইন নিয়ে লেখাপড়া শুরু করেন। কিন্তু যতই দিন যাচ্ছিল শিক্ষকদের সঙ্গে জাহরানের মতবিরোধ বাড়ছিল।
প্রিন্সিপাল এস. এম. আলিয়ার আরো বলেন, শিক্ষকরা কোরআনের উদার ব্যাখ্যা করলেও জাহরানের মধ্যে তা পছন্দ হতো না। জাহরানের ব্যাখ্যায় ফুটে উঠতো কঠোরতা। সে দিনে দিনে চরমপন্থী ইসলামের দিকে বেশি আগ্রহী হয়ে ওঠে, শিক্ষকদের সঙ্গে তর্ক করা শুরু করে। সে এতটাই অবাধ্য হয়ে উঠছিল যে আমরা জাহরানকে স্কুল থেকে বের করে দিতে বাধ্য হই।
জাহারানের সেই স্কুলের শিক্ষক আলিয়ারের বয়স এখন ৭৩ বছর। তার মতে এখনো তিনি ২০০৫ সালে জাহরানকে স্কুল থেকে বের করে দেয়ার ঘটনা স্পষ্ট মনে করতে পারেন।
শ্রীলংকার সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তারা ধারণা করছে ভয়ংকর ওই হামলার মূল পরিকল্পনাকারী জাহরান। যে নিজেও হামলায় অংশ নিয়েছে এবং আত্মঘাতী হয়েছে।
শ্রীলংকার শাংরি লা হোটেলে যে আত্মঘাতী হামলার ঘটনা ঘটেছে সেটা জাহরানই চালিয়েছে বলে জানান দেশটির প্রেসিডেন্ট মাইথ্রিপালা সিরিসেনা।
এদিকে দেশটির প্রশাসন বলছে, মোট নয়জন আত্মঘাতী হামলাকারী ওই দিন আট জায়গায় হামলা চালায়। তদন্ত কর্মকর্তারা জানান, হামলাকারীরা সবাই উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসা এবং তারা সবাই উচ্চশিক্ষিত। তাদের কেউ কেউ বিদেশেও লেখাপড়া করেছেন। এদের মধ্যে শুধু ব্যতিক্রম জাহরান।
জাহরান ২০০৫ সালে স্কুল থেকে বহিষ্কার হওয়ার পর নিজ শহর কাত্তানকুড়িতে ফিরে যান। সেখানে বাবা-মায়ের সঙ্গে বসবাস শুরু করেন। এ শহর থেকে দেশটির রাজধানী কলম্বো সড়ক পথে সাত ঘণ্টা সময় লাগে। শহরটিতে মাত্র ৪০ হাজার মানুষ বসবাস করে।
জাহরান ২০০৬ সালে ‘দারুল আথার’ নামে একটি মসজিদে যোগ দেন এবং সেটির ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য হন। কিন্তু তিন বছর পর সেখান থেকেও তাকে বের করে দেয়া হয়।
যে মসজিদটি থেকে জাহরান বহিষ্কার হয়েছিলেন, সেখানে ইমাম হিসেবে যোগ দিয়েছেন এম. টি. এম. ফাওয়াজ। তিনি বলেন, জাহরান স্বেচ্ছাচারী ছিলেন, বয়োজ্যেষ্ঠদের পরামর্শ না নিয়ে তিনি নিজের ইচ্ছামত বয়ান করতে চাইতেন। জাহরান কট্টর রক্ষণশীল ছিলেন বলেও জানান তিনি।
তিনি বলেন, আমাদের সবাই সমাজের নেতা হিসেবে সবার জন্য কথা বললেও জাহরান শুধু নিজের বিশ্বাস নিয়ে কথা বলতে চাইতো।
এছাড়া ২০০৯ সালে মসজিদ কমিটি জাহরানের বয়ান দেয়ার ওপর তিন মাসের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল।
মসজিদ কমিটির প্রধান মোহাম্মদ ইসমাইল মোহাম্মদ নওশাদ বলেন, আমরা তাকে বিগড়ে যাওয়া যুবা হিসেবে বিবেচনা করতাম, যে খুব সংকীর্ণ মনের ছিল এবং সবসময় সমস্যার কারণ হত।
মসজিদ থেকে জাহরানকে বের করে দেয়ার পর তিনি একদল অনুসারী জোগাড় করেন, যারা একটি কুঁড়েঘরে বৈঠক করত বলেও জানান ইমাম ফাওয়াজ।
জাহরানের বোন মাথানিয়া বলেন, ২৩ বছর বয়সে জাহরান কলম্বো উপকণ্ঠের একটি ছোট্ট শহরে ১৪ বছর বয়সী এক মেয়েকে বিয়ে করেন। স্ত্রীকে নিয়ে কাত্তানকুড়িতেই বসবাস করতেন তিনি।
জাহরান ছোট ছোট শহরে ঘুরে ঘুরে তার কট্টর মতের প্রচার শুরু করেন। ওই অঞ্চলে জনপ্রিয় সুফিবাদের সঙ্গে তার মতের সংঘর্ষ হয় এবং সুফি নেতারা জাহরানের বিরুদ্ধে প্রাশসনে অভিযোগ দেয়া শুরু করেন।
জাহরান বিভিন্ন সময়ে র্যালি ও সমাবেশ করতেন। যেখানে তিনি উচ্চকণ্ঠে বিদ্বেষ উগড়ে দিতে থাকেন।
২০১২ সালে তিনি নিজের একটি মসজিদ প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করেন। সুফিবাদের অনুসারীরা স্থানীয় প্রশাসন এবং সন্ত্রাস দমন কর্মকর্তাদের কাছে তার বিরুদ্ধে জোরাল অভিযোগ করতে থাকে। কিন্তু প্রশাসন তখন কোনো ব্যবস্থাই গ্রহণ করেননি।
নিজের মতের প্রচারে ইন্টারনেটকে হাতিয়ার বানান জাহরান। ফেসবুকে নিজের অ্যাকাউন্ট খুলে তিনি সেখানে নানা ভিডিও পোস্ট করা শুরু করেন।
কট্টর জাহরানকে নিজের প্রতিষ্ঠিত মসজিদ থেকেও বের করে দেওয়া হয়।
তাউফিক নামে জাহারানের এক স্কুল বন্ধু রয়টার্সকে বলেন, ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে জাহরানের প্রতিষ্ঠা করা মসজিদের দেয়ালে তাকে বহিষ্কারের নোটিস ঝুলিয়ে দেয়া হয়।
ইস্টার সানডের ঠিক তিনদিন আগে বৃহস্পতিবার জাহরানের ভাইয়ের স্ত্রী প্রতিবেশী এক নারী দর্জির কাছে গিয়ে কাপড় দিয়ে ওই দিনের মধ্যে একটি কুর্তা বানিয়ে দিতে বলেন। এ সময় কথা প্রসঙ্গে তিনি ওই নারীদর্জিকে বলেন, জাহরান পরিবারের সঙ্গে কোথাও বেড়াতে যাবেন।
এদিকে জাহরানের বোন জানান, শুক্রবার সারাদিন বাবা-মার মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়ায় তিনি শনিবার তাদের বাড়িতে গিয়ে দেখেন তারা কোথাও চলে গেছে।
দেশটির মুসলিম কাউন্সিল নামের একটি সংগঠন দাবি করেছেন, দেশটির চরমপন্থী দল ন্যাশনাল তৌহিদ জামায়াত এ হামলার সঙ্গে জড়িত রয়েছে।
কারণ হিসেবে সংগঠনটি তিন বছর আগে এক ভিডিও বার্তায় তৌহিদ জামায়াতের নেতা মোহাম্মদ জাহরান বা জাহরান হাশমির উগ্রপন্থী বক্তৃতার কথা সামনে এনেছে। যেখানে তিনি অমুসলিমদের মুছে ফেলার আহ্বান জানিয়েছিলেন।
তবে বোমা হামলার আগে জাহরানের বিরুদ্ধে কোনো গোয়েন্দা সতর্কতা ছিল না বলে জানিয়েছে শ্রীলংকান নিরাপত্তা বাহিনী। তবে স্বল্পপরিচিত উগ্রপন্থী এ দলটি কীভাবে একযোগে এত বড় হামলা চালিয়েছে সেটা নিয়ে প্রশ্ন রয়েই গেছে। যদিও এ দ্বীপরাষ্ট্রটিতে ক্রমবর্ধমানেউগ্রবাদ সম্পর্কে ২০০৭ সাল থেকেই সতর্ক করছিল দেশটির মুসলিম নেতারা।
হামলার মাস্টারমাইন্ড হিসেবে উগ্রপন্থী নেতা জাহরান হাশিমের ছবি প্রকাশ করা হয়েছে। তবে তার পাশে থাকা অন্য সাতজনের মুখ কাপড়ে ঢেকে দেয়া রয়েছে।
তাদের নাম হলো- আবু ওবায়দা, আবু আল মুক্তার, আবু খলিল, আবু আল বাররা, আবু মুহাম্মদ এবং আবু আবদুল্লাহ।
হামলার আগে ভিডিও ফুটেজে দেখানো হয়েছে, হামলাকারীরা দলের নেতা আবু বকর আল-বাগদাদীর কাছে আনুগত্যের শপথ নিচ্ছে।
ডেইলি মেইলের খবরে বলা হয়, ভিডিওতে দেখানো হয়েছে ৮ জন হামলাকারী দাঁড়িয়ে রয়েছে। এরপর তারা একে অন্যের হাত ধরে আনুগত্যের শপথ নেয়।
শ্রীলংকায় ভয়াবহ সিরিজ বোমা হামলায় এখন পর্যন্ত ৩৫৯ জন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এতে আহত হন পাঁচ শতাধিক মানুষ। এ হামলার দায় স্বীকার করেছে জঙ্গিগোষ্ঠী আইএস।