সরকারের সামনে এখন কার্যত রাজনৈতিক কোনো চ্যালেঞ্জ নেই। কিন্তু একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে সরকারকে। করোনাভাইরাস মহামারি, ঘূর্ণিঝড় আম্ফান ও দীর্ঘমেয়াদি বন্যা সরকারের সামনে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। কারণ দুর্যোগ মোকাবেলা করতে গিয়ে সরকার বড় ধরনের আর্থিক সংকটে পড়েছে।
এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতি কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণের বিকল্প নেই। আছে ঘূর্ণিঝড় ও বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের বিষয়টি। এরপর রয়েছে দুর্যোগকালে দেওয়া বাজেট বাস্তবায়ন। কেননা করোনায় রাজস্ব ঘাটতি বেড়েই যাচ্ছে। এর মধ্যে যারা বেকার হয়েছে, তাদের কাজের ব্যবস্থা করার পাশাপাশি নতুন শ্রমশক্তির কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও করতে হবে সরকারকে। বিদেশে সংকুচিত হয়ে আসা চাকরির বাজার সম্প্রসারণের দিকেও মনোযোগ দিতে হবে, তা না হলে প্রবাসী কর্মীদের দেশে ফিরে আসতে হবে, যা অভ্যন্তরীণ শ্রমবাজারে চাপ আরো বাড়াবে। কর্মসংস্থানের সংকট কাটাতে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ জরুরি। কিন্তু বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে পরিবেশ তৈরি করতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অর্থনীতিতে প্রাণচাঞ্চল্য ফেরাতে হলে, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আনতে হলে সবার আগে জরুরি করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আনা। তা না হলে কেউই বিনিয়োগে আস্থা পাবে না। তাঁরা বলছেন, নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হলে অবশ্যই সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের টাকা দ্রুত ছাড় করতে হবে। বন্যা ও ঘূর্ণিঝড় আম্ফানে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের সহায়তা করতে হবে।
জানতে চাইলে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রাকৃতিক দুর্যোগ আমরা দুইভাবে মোকাবেলা করছি। যারা ক্ষতিগ্রস্ত প্রাথমিকভাবে তাদের ত্রাণ দিয়ে, টিন দিয়ে, ওষুধ দিয়ে সহযোগিতা করছি। করোনা মোকাবেলায়ও সরকার বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।’
মন্ত্রী বলেন, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বন্যা মোকাবেলায় আমরা ৫০-৬০ বছর আগের বাঁধগুলো সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছি। তবে বাঁধ সংস্কারে কিছু সময় লাগবে। আমাদের আরো বনভূমি দরকার। সরকারের যে শতবর্ষী পরিকল্পনা ‘ডেল্টা প্ল্যান’ অনুমোদন করেছে সেখানে বাঁধ নির্মাণ, বাঁধ সংস্কার ও বনভূমি বাড়ানোর কথা বলা আছে। তবে এটাও মনে রাখতে হবে যে আমাদের আর্থিক সীমাবদ্ধতা আছে।’
গত বছর ডিসেম্বরে চীনের উহানে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাস বৈশ্বিক মহামারিতে পরিণত হয়েছে। গত ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম সংক্রমণ শনাক্তের ঘোষণা দেয় সরকার। তার ১০ দিন পর আসে মৃত্যুর ঘোষণা। পাঁচ মাস পার করে দেশের সংক্রমণ পরিস্থিতির গতি-প্রকৃতি নিয়েও বিশেষজ্ঞদের মধ্যে ভিন্ন মত রয়েছে। তবে বৈশ্বিকভাবে বাংলাদেশ ১৫তম স্থানে রয়েছে। মৃত্যুর দিক থেকে আছে ৭২তম স্থানে।
করোনা মোকাবেলায় সরকার ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে। টানা ৬৬ দিন সাধারণ ছুটি ছিল। এ সময় জরুরি সেবা ছাড়া সবই বন্ধ ছিল। বিপর্যস্ত অর্থনীতিতে প্রাণচাঞ্চল্য ফেরাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক লাখ তিন হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। কিন্তু এ প্যাকেজ বাস্তবায়ন হচ্ছে কচ্ছপগতিতে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে এখন পর্যন্ত মাত্র ২০০ কোটি টাকা প্রণোদনা প্যাকেজের টাকা ছাড় হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, দেশে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা আড়াই লাখ ছাড়িয়েছে। গতকাল শনিবার পর্যন্ত মারা গেছে তিন হাজার ৩৬৫ জন। পরিস্থিতি কবে নাগাদ নিয়ন্ত্রণে আসবে সেটা কেউ বলতে পারছে না।
করোনার আঘাতে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের চিত্রও উঠে আসছে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) তথ্য মতে, করোনাকালে নতুন করে এক কোটি ৬৪ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) তথ্য বলছে, করোনার আগে দেশে যেখানে দারিদ্র্যের হার ছিল ২০ শতাংশ, করোনা সংক্রমণের পর দারিদ্র্যের হার বেড়ে ৩৫ শতাংশ হয়েছে। অর্থাৎ পৌনে ছয় কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছে। এ সময় পোশাকশিল্পসহ বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে চাকরি হারিয়ে অনেকে গ্রামে চলে গেছেন। পাশাপাশি বিদেশ থেকে দেশে ফিরে এসেছেন। ফলে গ্রামীণ অর্থনীতিও বড় ধরনের চাপে পড়েছে।
করোনাকালে রাজস্ব আদায়ে স্থবিরতার কারণে বাজেট বাস্তবায়নে গতি নেই। উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ স্থগিত করে, সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ বন্ধ করে, নতুন যানবাহন কেনা বন্ধ করে কৃচ্ছ সাধন করতে হচ্ছে। করোনার নমুনা পরীক্ষা একসময় বিনা মূল্যে করলেও আর্থিক সংকটের বিষয়টি মাথায় রেখে ফি নির্ধারণ করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য মতে, সদ্যোবিদায়ি ২০১৯-২০ অর্থবছরে রেকর্ড পরিমাণ রাজস্ব ঘাটতিতে পড়েছে সরকার। করোনার কারণে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৮২ হাজার কোটি টাকা কম রাজস্ব আদায় হয়েছে। চলতি অর্থবছরেও বড় ধরনের রাজস্ব ঘাটতির আশঙ্কা করা হচ্ছে।
সদ্যোবিদায়ি অর্থবছরে সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বা এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছে গত ২৭ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন ৮০ শতাংশ। করোনার কারণে চলতি অর্থবছরেও এডিপি বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হতে পারে।
ঢাকায় বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কেউ যদি মনে করে কভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণ না করে অর্থনীতিতে প্রাণচাঞ্চল্য ফেরাবেন, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আনবেন, তাহলে তিনি বোকার স্বর্গে বাস করছেন। কোনো উদ্যোক্তা পুরোপুরি আস্থাশীল না হয়ে নতুন বিনিয়োগ করবেন না। সরকারের সবার আগে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে আনা। এ জন্য যা কিছু দরকার তাই করতে হবে।’ তিনি বলেন, এখন চ্যালেঞ্জ হলো টিকে থাকার, প্রবৃদ্ধির নয়।
করোনা সংক্রমণের মধ্যেই গত ২০ মে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় আম্ফান। উপকূলীয় কয়েকটি জেলাসহ লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় ২৬ জেলা। প্রাণ গেছে অন্তত ১০ জনের। তছনছ হয়েছে হাজারো বাড়িঘর। ভেসে গেছে মাছের ঘের। নষ্ট হয়েছে আমবাগান।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, আম্ফানে প্রাথমিক ক্ষতি হয়েছিল এক হাজার ১০০ কোটি টাকা। আম্ফানে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দক্ষিণের জেলা সাতক্ষীরা। গতকাল জেলার আশাশুনি, শ্যামনগরে খবর নিয়ে জানা গেছে, আম্ফানে যাদের বাড়ি পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে, তারা এখনো সরকারের পক্ষ থেকে সহযোগিতা পায়নি। অনেকের সঞ্চয় নেই। গবাদি পশু বিক্রি করে কোনো মতে সংসার চলছে অনেকের। স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁধ নির্মাণ হলেও এখনো অনেক ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তাঘাট ও বাঁধের নির্মাণকাজ শেষ হয়নি। ফলে সাতক্ষীরাসহ আম্ফানে ক্ষতিগ্রস্ত ২৬ জেলার মানুষের সহযোগিতা করাও বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে সরকারের সামনে।
সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক এস এম মোস্তফা কামাল কালের কণ্ঠকে বলেন, জেলায় যাদের ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাদের দেড় হাজার বান্ডেল টিন ও তিন হাজার টাকা করে দেওয়া হয়েছে। আর যারা গৃহহীন তাদের নামের তালিকা জুন মাসে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। দুই মাস পেরিয়ে গেলেও এখনো গৃহহীনদের বরাদ্দ মেলেনি বলে জানান জেলা প্রশাসক।
গত ২৭ জুন থেকে দেশের উত্তরাঞ্চল, উত্তর-মধ্যাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চল এমনকি রাজধানীতেও দেখা দিয়েছে বন্যা। ১৯৯৮ সালের পর এবারের বন্যাকে বলা হচ্ছে সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি। ফলে ক্ষতির পরিমাণও বেশি। চলমান বন্যায় দেশের ৩৬ শতাংশ প্লাবিত হয়েছে। বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে ৫৫ লাখ মানুষ। মারা গেছে দেড় শতাধিক। যোগাযোগ ব্যবস্থাও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ৩১ জেলা বন্যায় আক্রান্ত। আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে প্রায় ৭০ হাজার মানুষ। বন্যায় বিশাল জনগোষ্ঠীকে পর্যাপ্ত ত্রাণ সহযোগিতা ও আর্থিক সহায়তা দেওয়া সরকারের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বন্যার কারণে কৃষিতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের প্রাথমিক তথ্য বলছে, বন্যায় এখন পর্যন্ত ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৪০০ কোটি টাকার। বন্যার কারণে শাকসবজি ও নিত্যপণ্যের দামও চড়া। আমন ও আউশের আবাদও বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়বে।
কৃষিসচিব নাসিরুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা মনে করেছিলাম বন্যা বেশি দিন স্থায়ী হবে না। কিন্তু পরে দেখা গেল, বন্যা দীর্ঘমেয়াদি হচ্ছে।’ বন্যার কারণে আমন ও আউশের উৎপাদন কমে আসবে বলে স্বীকার করেন কৃষিসচিব। এ ছাড়া সবজির দামও বেড়ে যাবে বলে জানান তিনি।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. নাজনীন আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, সরকার অর্থনীতিতে গতি ফেরাতে এক লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করলেও বাস্তবায়ন চলছে ধীরগতিতে। এখানে গতি আনতে হবে। পণ্যের উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। তিনি বলেন, ‘সরকারের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বড় বাধা স্বাস্থ্য খাতের দুর্বল কাঠামো। এসব চ্যালেঞ্জ শক্তহাতে মোকাবেলা করতে হবে।’