সিন্ডিকেট চক্র বেপরোয়া! কুলাউড়ায় পাঁচ শিক্ষার্থীর উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা অনিশ্চিত


মাহফুজ শাকিল: কুলাউড়ার প্রাচীনতম বিদ্যপীঠ কুলাউড়া সরকারি কলেজ। এই কলেজের অনেক ইতিহাস ও ঐতিহ্য রয়েছে। অনেক সুনাম ও খ্যাতির মধ্যে দিয়ে এই কলেজ পরিচালিত হয়ে আসছে কিন্তুু বর্তমানে একটি সিন্ডিকেট চক্রের কারণে কলেজের সেই সুনাম ভেস্তে যেতে বসেছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের কাছে আসন্ন এইচএসসি পরীক্ষার ফরম পূরণের টাকা দিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীরা পড়েছেন নানান বিপাকে। তাদের পরীক্ষা দেয়া এখন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ছাত্র-সংগঠনের নেতাকর্মীদের মাধ্যমে ফরম পূরণের নির্দিষ্ট টাকার চেয়ে অর্ধেক পরিমাণ টাকা দিয়ে ফরম পূরণ করা যায় এই মর্মে কুলাউড়া সরকারি কলেজের পাঁচজন শিক্ষার্থী এইচএসসি পরীক্ষার ফরম পূরণের জন্য ছাত্রনেতা সাইফুর রহমানের কাছে টাকা জমা দেয়। কিন্তুু ওই নেতা কলেজ কর্তৃপক্ষের সাথে কোন প্রকার যোগাযোগ করেননি। ফলে পাঁচ শিক্ষার্থীর ফরম পূরণ করা হয়নি। শিক্ষাবোর্ড থেকে প্রবেশপত্রও আসেনি। এদিকে ১ এপ্রিল থেকে পরীক্ষা শুরু হচ্ছে। এ অবস্থায় ওই পাঁচ শিক্ষার্থীরা অনেক বিপাকে পড়েছেন।
কলেজের কয়েকজন শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের সাথে আলাপ করে জানা যায়, কুলাউড়া সরকারি কলেজে দীর্ঘদিন থেকে বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের নাম করে কতিপয় নেতারা ভর্তি ও ফরম পূরণে বাণিজ্য করে আসছেন। কলেজের শিক্ষকদের সঙ্গে খারাপ আচরণ/ দেনদরবার করে তাঁরা কম টাকায় এসব কাজ করিয়ে দিতে পারেন।

সিলেটের মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড গত বছরের (২০১৮) ১৩ ডিসেম্বর থেকে ২০ ডিসেম্বরের মধ্যে এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের অনলাইনে ফরম পূরণের নির্দেশনা দেয়। বিজ্ঞান বিভাগের জন্য ২ হাজার ৪৬০ টাকা এবং মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগের জন্য ২ হাজার ২৩০ টাকা ফি নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। কলেজের মাসিক বেতন ২০০ টাকা। ফরম পূরণের সময় বোর্ড নির্ধারিত ফি’র সঙ্গে বকেয়া বেতন ও ভর্তি ফি (একাদশ থেকে দ্বাদশ শ্রেণীতে ভর্তি) পরিশোধ করতে কলেজ কর্তৃপক্ষ থেকে বলা হয়।
এ কারণে অনেক শিক্ষার্থীর ফি ৬ হাজার থেকে ৮ হাজার টাকা হয়ে যায়। এ অবস্থায় কলেজের মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থী জামিল হাসান, দেলোয়ার হোসেন, প্রিয়াংকা চন্দ, সুইটি আক্তার এবং ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগের মো. আবু বকরকে কুলাউড়া সরকারি কলেজ ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক সাইফুর রহমান কম টাকায় তাঁদের এ কাজ করে দেবেন বলে প্রতিশ্রতি দেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে সাইফুরের দাবি অনুযায়ী, জামিল ৩ হাজার টাকা, দেলোয়ার হোসেন ৬ হাজার টাকা, প্রিয়াংকা চন্দ ৪ হাজার টাকা, সুইটি আক্তার ৪ হাজার টাকা এবং আবু বকর ৪ হাজার টাকা তাকে প্রদান করে ফরম পূরণ করেন। ২০ মার্চ বুধবার কলেজে বোর্ড থেকে পাঠানো পরীক্ষার্থীদের প্রবেশ পত্র বিতরণ করা হয়। কিন্তু, ওই পাঁচ পরীক্ষার্থীর প্রবেশ পত্র আসেনি। পরে কলেজের শিক্ষকদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে তাঁরা জানতে পারেন, ফরম পূরণ না হওয়ায় প্রবেশপত্র আসেনি।

শিক্ষার্থী জামিল হাসান, দেলোয়ার হোসেন ও আবু বকর বলেন, প্রবেশপত্র না পৌঁছানোয় তাঁরা সাথে সাথে সাইফুরের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেন। কিন্তু, তা বন্ধ পাওয়া যায়। পরে কুলাউড়া উপজেলার সদর ইউনিয়নের হাসনপুর গ্রামের বাড়িতে গিয়ে খোঁজ করেও তাঁকে পাওয়া যায়নি।
শিক্ষার্থীরা বলেন, তাঁদের অনেক সহপাঠী ছাত্রলীগ, ছাত্রদল, তালামীযসহ বিভিন্ন ছাত্র-সংগঠনের নেতাদের মাধ্যমে কম টাকায় ফরম পূরণ করেছেন এবং তাদের প্রবেশপত্রও এসেছে।

কলেজের সাধারণ শিক্ষার্থীদের সাথে আলাপকালে জানা যায়, দীর্ঘদিন থেকে কলেজে একটি সিন্ডিকেট চক্র বিভিন্ন ছাত্র রাজনৈতিক দলের প্রভাব খাঁটিয়ে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ফরম পূরণ, কলেজ ও শিক্ষা বোর্ডের বিভিন্ন ফি কম করে দেওয়ার নাম করে সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে যায়। কলেজ প্রশাসনের চোখের সামনে এই চক্র এমন কাজ করলেও কর্তৃপক্ষ কেন নীরব ভূমিকা পালন করেন এমন প্রশ্ন তুলেছেন শিক্ষার্থীরা।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে অভিযুক্ত ছাত্রদল নেতা সাইফুর রহমান বলেন, বেতন সহ ফরম পূরণে অনেক শিক্ষার্থীর নয় থেকে দশ হাজার টাকা আসে কিন্তুু স্যারদের কাছে গেলে তারা এক হাজার থেকে পনের শত টাকার বেশি কমান না। গরীব ছাত্র-ছাত্রীদের এতো টাকা দেবার সামর্থ্য না থাকায় তারা আমাদের সাথে যোগাযোগ করলে আমরা স্যারদের সাথে কথা বলে নির্দিষ্ট টাকার চেয়ে অনেক কম টাকায় ফরম পূরণ করে থাকি। এই বছর আমি কলেজের ৮২জন শিক্ষার্থীর ফরম পূরণ করে জমা দেই। কিন্তুু কলেজের শিক্ষক জাহিদুর রহমান ও আব্দুল বাকী স্যারের চরম গাফিলতির কারণে এই শিক্ষার্থীদের প্রবেশপত্র আসেনি।

কুলাউড়া সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ সৌম্য প্রদীপ ভট্টাচার্য সজল বলেন, ‘কলেজে দীর্ঘদিন থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের ছাত্রনেতারা এ কাজ করে আসছে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে কলেজের ফরম ফি ও অন্যান্য ফিসহ নির্দিষ্ট টাকার চেয়ে কম টাকা এনে তাতেও নেতারা ভাগ বসায়। শিক্ষার্থীরা সরাসরি আমার যোগাযোগ করতে পারতো। এই পাঁচ শিক্ষার্থীর কথা জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, এই মুহুর্তে কোন সুযোগ নেই। তারপরও ফরম পূরণের ব্যাপারে দুই-এক জনের জন্য বোর্ডে সুপারিশ করেছি। বোর্ড কি সিদ্ধান্ত দেয় জানি না। বাকিদের বিষয়ে কিছু বলতে পারব না।’