সিলেটে মানিক লাল রায় স্মরণ


বিনে পয়সায় ছাত্রছাত্রী পড়িয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থার ভুলগুলো ধরিয়ে দিতেন। হাওরে সাধারণ জেলে-কৃষকদের অধিকার আদায়ে রাজনীতি করতেন। জীবনভর এই দুই কর্মযজ্ঞে তাঁর পরিচিতি ছিল তৃণমূলে গণমুখী শিক্ষার প্রবর্তক ও গণরাজনীতির একজন সংগঠক। তিনি সদ্য প্রয়াত সুনামগঞ্জের মানিক লাল রায়। গণমুখী শিক্ষা ও জন-গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সমাজ বদলের স্বপ্ন দেখতেন তিনি। এ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে ‘বুলেটিন’ প্রকাশ করতেন। এ রকম একটি প্রকাশনা ছিল ‘বিদ্রোহী ভৃগু’।

গত ২৬ জুলাই তাঁর মৃত্যুর পর বিদ্রোহী ভৃগু নিয়ে সিলেটে স্মরণ অনুষ্ঠান হয়েছে বুধবার সন্ধ্যায়। সিলেট নগরের পূর্ব জিন্দাবাজার এলাকায় বাতিঘরে ‘বিদ্রোহী ভৃগু’ শীর্ষক স্মরণ অনুষ্ঠান আয়োজন করেন তাঁর ছাত্রছাত্রী ও অনুরাগীরা।

অনাড়ম্বর এই অনুষ্ঠানে জানানো হয়, সুনামগঞ্জ শহরের রায়পাড়ার বাসিন্দা মানিক লাল রায়ের জন্ম ১৯৪৯ সালের ২৮ ডিসেম্বর। ১৯৭০ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ৩০ বছর ছিল তাঁর ‘গণমুখী শিক্ষা’ আর ‘গণরাজনীতিকাল’। ১৯৮৮ সালে ‘চাষী’ নামের একটি প্রকাশনা (বুলেটিন) সম্পাদনা করে হাওরে ভাসান পানির আন্দোলন সংগঠিত করেন। ১৯৯১ সালে ‘নাগরিক অধিকার’ প্রকাশ করে সরকারের ভ্যাট প্রথার বিরোধিতা করেন। এরপর ১৯৯৭ সালে বের করেন ‘বিদ্রোহী ভৃগু’। তিনটি প্রকাশনায় তিনি ‘কদম আলী চাষী’ ও ‘আ: সালাম ভদ্র’ নামে লেখালেখি করেছেন। ব্যক্তিগত জীবনে প্রচারবিমূখ, নির্মোহ ও নির্লোভ স্বভাবের ছিলেন তিনি। ১৯৭১ সালে ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টির বিশেষ গেরিলা বাহিনীর মাধ্যমে ভারতে প্রশিক্ষণ শিবির থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন। তাঁর কাছে সংরক্ষিত ছিল ‘১৯৭২ মূল ওসমানী মুক্তিযোদ্ধা সনদ’। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত মুক্তি এবং অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্বপ্ন পূরণ না হওয়ায় কখনও কোনো সুযোগ-সুবিধা নেওয়া বা মুক্তিযোদ্ধা সনদের জন্য আবেদন করেননি।

মানিক লাল রায় সর্বশেষ বিদ্রোহী ভৃগু প্রকাশ করে শারীরিকভাবে অসুস্থ হওয়ায় অনেকটা অবসর জীবনযাপন করছিলেন। বিদ্রোহী ভৃগুসহ তাঁর জীবন নিয়ে মানিক লাল রায়ের ছেলে অপূর্ব অনির্বাণের একটি লেখা নিয়ে নতুন করে প্রকাশ করা হয়েছে বিদ্রোহী ভৃগু। প্রচ্ছদ করেছেন অরূপ বাউল। প্রকাশ করেছে সিলেটের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ‘চৈতন্য’। অপূর্ব অনির্বাণ ঢাকার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক।বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি গবেষণারত।

অনুষ্ঠানে ‘বিদ্রোহী ভৃগু’ উন্মোচন করেন একুশ পদকপ্রাপ্ত লোকসংগীত শিল্পী সুষমা দাশ। বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের সভাপতি মন্ডলির সদস্য মোকাদ্দেস বাবুলের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে মানিক লাল রায়ের গণরাজনীতি ও গণমুখী শিক্ষা নিয়ে আলোচনা করেন মুক্তিযোদ্ধা-কবি তুষার কর, সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি এমাদ উল্লাহ শহিদুল ইসলাম, জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শহীদুজ্জামান চৌধুরী, অপূর্ব অনির্বাণ, মানিক লাল রায়ের ছাত্র মো. আজিজুর রহমান, রাজেশ কান্তি দাশ প্রমুখ। শুরুতেই স্বাগত বক্তব্য দেন মানিক লাল রায়ের ছাত্র এবং প্রথম আলো সিলেটের নিজস্ব প্রতিবেদক উজ্জ্বল মেহেদী।

বক্তারা বলেন, হাওরে যখন ভাসান জল, তখন সাধারণ জেলে-কৃষকদের মাছ ধরতে বাধা দিত ইজারাদারগোষ্ঠী। অথচ ইজারা নীতিমালায় ছিল ভাসান পানির সময় অবাধে মাছ ধরা যাবে। সাধারণ জেলে-কৃষকদের এই অধিকার নিয়ে আশির দশকে সুনামগঞ্জে একটি আঞ্চলিক আন্দোলন হয়েছিল প্রয়াত কমরেড বরুণ রায়ের নেতৃত্বে। সেই আন্দোলন একসময় রাজনৈতিক কারণে স্থবির হয়ে পড়ে। স্থবির পর্যায় থেকে জেলে-কৃষকদের সংগঠিত করে ১৯৮৯ সালে ভাসান পানির আন্দোলন আবার দাঁনা বাধে। ওই সময় সংগঠক ছিলেন মানিক লাল রায়। এরপর ভাসান পানিতে মাছ ধরা সাধারণ জেলে ও কৃষকদের একটি বড় অধিকার হিসেবে আজও প্রতিষ্ঠিত সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চলে।

তাঁর গণমুখী শিক্ষা ও গণরাজনীতি সংগঠিত করার প্রচেষ্টা নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থী ও রাজনৈতিক কর্মীদের জন্য অনুকরণীয় এক আদর্শ উল্লেখ করে বক্তারা আরও বলেন, মুক্তিযুদ্ধের পর সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজ থেকে প্রথম বিএ পাস ছাত্র ছিলেন মানিক লাল রায়। এরপর একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক ছিলেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রতিবাদ জানাতে শিক্ষকতার চাকরি ছেড়ে দেন। গণমুখী শিক্ষায় প্রায় চার দশক বিনে পয়সায় ছাত্রছাত্রী পড়িয়েছেন। তাঁর বিনে পয়সার ছাত্র পড়ানোর পেছনে ছিল নীরবে আরও এক প্রতিবাদ। এর একটি হচ্ছে প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা ভেঙে পড়া আর ‘কোচিং’-এর নামে শিক্ষার বাণিজ্যিক তৎপরতার প্রতিবাদ। তাঁর গণমুখী শিক্ষা ও গণরাজনীতি নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থী ও রাজনৈতিক কর্মীদের জন্য অনুকরণীয় এক আদর্শ হয়ে থাকবে।