সুজানগরের ইকবাল ফেরদৌসের বিন্দু থেকে সিন্ধু জয়ের গল্প


সিলেটের বড়লেখা উপজেলার সুজানগরে ছেলে। মফস্বলে বসে স্কুলের পাঠ পেরুনোর কোনো এক বিকেলে এক বন্ধুর বাবার গাড়ি থেকে জায়গার অভাবে নেমে হেঁটে আসতে হয়েছিল। বাড়িতে এসে সে তার মাকে বলেছিল, ‘একদিন আমি নিজেই গাড়ি বানাব। আমার কোম্পানির গাড়িতে সবাই চড়বে।’

সেদিনের কিশোর ইকবাল ফেরদৌসের পরিবার হয়তো মৃদু হেসেছিলেন, কিন্তু আজ সেটিই বাস্তবতা। মোল্লার কান্দি নামের ছোট্ট একটি গ্রাম থেকে বেড়ে ওঠা ইকবাল আজ বেশ দাপটের সঙ্গে কাজ করছেন ফোর্চুন ফিফটি কোম্পানির একটিতে। পাশাপাশি নিজেকে ব্যস্ত রেখেছেন নানামুখী কর্মকাণ্ডে। চাকরির পাশাপাশি ব্যবসা করছেন অনলাইনে ।

ইকবাল ফেরদৌস। পুরো নাম ইকবাল হোসাইন ফেরদৌস। কাজ করছেন বিশ্বের নামকরা গাড়ি প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ও আমেরিকার ওয়ান অব দ্য লার্জেস্ট কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান ফোর্ড মটরসের ওয়ার্ল্ড হেড কোয়ার্টার মিশিগান অঙ্গরাজ্যের ডিয়ারবনে। পেশায় তিনি একজন সফটওয়্যার প্রকৌশলী। বর্তমানে কাজ করছেন অটোনমাস (ড্রাইভার ছাড়া) গাড়ির এইচ এম আই ফ্রেইম ওয়ার্ক ডিপার্টমেন্টে। এর আগে তিনি কাজ করেছেন আমেরিকা তথা বিশ্বের খ্যাতনামা গাড়ি প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান জেনারেল মটরস এর হেড কোয়ার্টারে সাইবার সিকিউরিটি ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে। অটোনমাস (ড্রাইভার ছাড়া) গাড়ি টেকনোলজিতে তিনি বেশ দক্ষ। এছাড়াও তিনি গাড়ির সাইবার সিকিউরিটিতে বিশেষ পারদর্শী। মূলত টেকনোলজি যত উন্নত হচ্ছে গাড়ি তৈরির প্রতিষ্ঠানগুলোও সর্বাধুনিক প্রযুক্তির দিকে তত ঝুঁকছে। এতে যেমন সুফল রয়েছে, তেমনি রয়েছে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। আজকাল নতুন মডেলের প্রতিটি গাড়িতে সবার ডাটা গাড়ির এনফোটেইনমেন্ট সিস্টেমে ডাউনলোড করা থাকে। কেউ যদি গাড়ির এনফোটেইনমেন্ট সিস্টেম হ্যাক করে ফেলে তাহলে সে সহজেই পেয়ে যাচ্ছে সেই ব্যক্তির সকল কন্টাক্টসহ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। এখন কেউ চাইলে বাংলাদেশে বসে আমেরিকার গাড়ি কন্ট্রোল করতে পারবে। ইকবাল ফেরদৌস মূলত গাড়ির সুরক্ষা বিষয়ে কাজ করেন আর সেই কাজটি হলো গাড়ির নতুন প্রযুক্তির অপব্যবহার ঠেকানো। কেউ যাতে গাড়ির এনফোটেইনমেন্ট সিস্টেম হ্যাক করতে না পারে সেটি নিশ্চিত করা।

ইংল্যান্ডের বিখ্যাত ইউনিভার্সিটি অব ব্রাডফোর্ড থেকে ইকবাল ফেরদৌস মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। লন্ডনের খ্যাতনামা কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানে কাজ করার পাশাপাশি তিনি যুক্ত ছিলেন বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে। পেশায় ইঞ্জিনিয়ার হলেও নিজেকে একজন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মী হিসেবেই পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। লন্ডন ও নিউইয়র্কের সাংস্কৃতিক মহলে খুবই পরিচিত নাম ইকবাল ফেরদৌস। দীর্ঘ এক যুগেরও বেশি সময় কাটিয়েছেন লন্ডনে। ব্যাচালর ও মাস্টার্স সম্পন্ন করেছেন লন্ডন থেকেই। অল্প বয়সে সাফল্যের শিখরে পৌঁছালেও বেশ সহজ-সরল জীবন তিনি যাপন করেন। নিজেকে সফল হিসেবে মানতে নারাজ ইকবাল ফেরদৌস।

ইকবাল ফেরদৌস বলেন, ‘কখনো নিজেকে হারাতে চাইনি। মনোবল ভাঙিনি। আসলে মানুষকে তার স্বপ্ন প্রসারিত করে রাখতে হয়। তারণ মানুষ তার স্বপ্নের ভিতর দিয়েই চলে। আর পাশাপাশি পরিশ্রমটা চালিয়ে গেলে ভাগ্য আপনাকে কোথায় নিয়ে যাবে তা আপনি জানেন না।’

অ্যামাজন এফবিএ, অ্যামাজন এমট্রাক, ড্রপ শিপিং, ই-বে প্লাটফর্মে পণ্য কেনা-বেচা করছেন। তার তত্ত্বাবধানে কাজ করছেন প্রায় অর্ধশতাধিক তরুণ। অনলাইন ব্যবসায় আয় কেমন জানতে চাইলে ইকবাল ফেরদৌস জানান, ‘আগামী দিনের অর্থনীতির চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করবে অনলাইন ব্যবসা। আলহামদুলিল্লাহ গত বছর প্রায় পঞ্চাশ হাজার ডলার শুধু অনলাইন ব্যবসা থেকেই আয় হয়েছে। এ বছর আমাদের লক্ষ্য এর দ্বিগুণ করা।’

লন্ডনে থাকাকালীন ইকবাল ফেরদৌস যুক্ত ছিলেন সাপ্তাহিক বাংলা নিউজ, ইউকে.বিডি নিউজের সঙ্গে। পরবর্তী সময়ে নিউইয়র্কে আসার পর যুক্ত হন সাপ্তাহিক ‘বাংলা পত্রিকা’ ও টাইম টেলিভিশনের সঙ্গে। সেই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে তিনি মিশিগান হতে প্রকাশ করছেন ‘বাংলা সংবাদ’ নামের একটি নতুন পত্রিকা। সম্প্রতি পত্রিকার কাগজ সংস্করণ প্রকাশনার পর থেকেই সকল মহলে বেশ প্রশংসায় সিক্ত হচ্ছেন ইকবাল ফেরদৌস। মিশিগান বাঙালি কমিউনিটিতে ‘বাংলা সংবাদ’ নিয়ে উচ্ছ্বাস লক্ষণীয়।

লন্ডনে ইকবাল ফেরদৌস সংযুক্ত ছিলেন লন্ডন মিডিয়া অ্যান্ড টেকনোলজি কলেজের পরিচালক হিসেবে। যুক্তরাষ্ট্রে তিনি গড়ে তুলেছেন ভিনটেজ অ্যাকাডেমি। এই অ্যাকাডেমির মাধ্যমে তিনি শুরু করেছেন আইটি প্রশিক্ষণ। যেখানে শিক্ষার্থীরা তথ্যপ্রযুক্তির কারিগরি দিকগুলো হাতে কলমে শিখছে। কোর্স শেষে এই অ্যাকাডেমির শিক্ষার্থীরা আশি হতে এক লক্ষ ডলার বেতনে চাকরি করছে আমেরিকার বিভিন্ন খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠানে। এছাড়াও নিজের গড়া আইটি প্রতিষ্ঠান ভিনটেজ টেকনোলজির মাধ্যমে ওয়েবসাইট ডিজাইন, আইওএস-অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপস ডিজাইন, ক্লাউড সার্ভিস, সাইবার সিকিউরিটিসহ আরো অনেক টেক সেবা প্রদান করছেন।

রেডিও ও টিভি উপস্থাপক হিসেবে ইকবাল ফেরদৌসের রয়েছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা। লন্ডনের একমাত্র রেডিও ‘বেতার বাংলায়’ কাজ করেছেন দীর্ঘদিন। বেতার বাংলার ‘সানডে স্পেশাল’ নামক অনুষ্ঠান এবং এনটিভিতে প্রতি রবিবার প্রচারিত লাইভ বাউল গানের অনুষ্ঠান ‘বসন্ত বাতাসে’ প্রচারের পর ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। বেতার বাংলায় সানডে স্পেশাল প্রতি রোববার সরাসরি ২ ঘণ্টা অনুষ্ঠানটি প্রচারিত হতো। এতে বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন মিডিয়া অঙ্গনের তারকারা টেলিফোনে অংশ নিতেন। প্রায় তিন বছর নিয়মিত প্রচারে বাংলাদেশ থেকে শতাধিক তারকা অংশগ্রহণ করেছেন ‘সানডে স্পেশাল’ অনুষ্ঠানে।

সফল ব্যবসায়ীদের নিয়ে নিউইয়র্কের টাইম টেলিভিশনে প্রচারিত ‘বিজ টক’ অনুষ্ঠানটিও বেশ পরিচিতি এনে দেয়।

এছাড়াও ইউরোপের চ্যানেল আইতে প্রচারিত ‘হ্যালো প্রাইমমিনিস্টার’, এটিএন বাংলায় প্রচারিত ‘বিজনেস টুডে’, চ্যানেল এস টেলিভিশনে প্রচারিত ‘যদি একদিন’ অনুষ্ঠানগুলো উপস্থাপনার মধ্যদিয়ে তিনি সকলের নজর কাড়তে সক্ষম হন।

সংগঠক হিসেবে ইকবাল ফেরদৌসের রয়েছে পরিচিতি। কাজ করেছেন ইরস এন্টারটেইনমেন্ট, বলিফ্লেক্সসহ বলিউডের খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠানের পিআর কন্সালটেন্ট হিসেবে।

ইকবাল ফেরদৌসের সাফল্যের পিছনের কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আত্মবিশ্বাস, পরিশ্রম, সততা আর কাজে লেগে থাকাই এনে দিতে পারে যে কাউকে সাফল্য। কোনো কাজকেই ছোট করে দেখা যাবে না। নিজের মধ্যে অহংকার ঢুকলেই শেষ, আর এগুনো যাবে না। লন্ডনে শুরুর দিকে আমি কাজ করেছি রেস্টুরেন্টের ওয়েটার হিসেবে সপ্তাহে মাত্র ৮০ পাউন্ড বেতনে। অথচ এখন আমি ঘণ্টায় এই টাকা আয় করতে পারি। আমেরিকা আসার পর শুরুতে নিউইয়র্কে এসে আমি কাজ করেছি টাইম টেলিভিশনে। যদিও আমার পদবি ছিল অনেক বড় কিন্তু মূলত আমি কাজ করেছি কখনো ক্যামেরাম্যান হিসেবে, নিউজম্যান, প্রডাকশন সহকারী, রিপোর্টার, কখনো বিল কালেক্ট করার জন্য কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বসে থেকেছি ঘণ্টার পর ঘণ্টা, কিন্তু ধৈর্যহারা হইনি। কাজ করেছি উবার, লিফট ও উবার ইটস, গ্রাবহাভে খাবার ডেলিভারি বয় হিসেবে। আমি কিন্তু এ সকল কাজগুলো না করলেও পারতাম । আমার কাছে যে সেভিংস ছিল তা দিয়ে অনায়াসে চলতে পারতাম। মূলত আমি এ কথাটি বলতে চাচ্ছি কেউ যদি সময় নষ্ট না করে প্রতিটি সুযোগ কাজে লাগায় আর নিজেকে সত্ রাখতে পারে তাহলে সে সফল হবেই।’

একসঙ্গে এতগুলো কাজ কিভাবে সমন্বয় করেন জানতে চাইলে ইকবাল ফেরদৌস বলেন, ‘আমি মূলত আমার ফুল টাইম জবকেই বেশি প্রাধান্য দিই আর অন্যান্য অবসর সময়গুলোতে বাকি কাজগুলো করি। এক্ষেত্রে আমি খুব ভালো ও দক্ষ একটি দল গড়তে সক্ষম হয়েছি যাদের কারণে আমি খুব সহজেই যেকোনো কাজ সুন্দরভাবে সম্পন্ন করতে পারি।’

মাস্টার্স শেষ করার পর ও নিজেকে সংযুক্ত রেখেছেন পড়াশোনার প্রতি। পিএইচডি করছেন আগর-আতর শিল্প বিষয় নিয়ে। তিনি বলেন, ‘যদিও কাজের চাপে আমার পিএইচডি শেষ করতে কিছুটা সময় লাগছে তবে আমি মনে করি আমি তা শেষ করতে পারবো, ইনশাআল্লাহ। আমি বিশ্বাস করি নিজেকে দক্ষ হিসেবে গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নাই।’

বাবা রফিক উদ্দিন ও মা আজিবুন নাহারের কাছে ইকবাল সম্পর্কে জানতে চাইলে উনারা বলেন, ‘ইকবাল ছোটবেলায় খুব শান্ত স্বভাবের ছিল। সমবয়সী অনেকেই তাকে বোকা ছেলে হিসেবেই ভাবত। পড়াশোনায় সে খুব মেধাবী ছিল। সব সময় ক্লাসে এক থেকে তিনের মধ্যে থাকত। মেধাবী হওয়ার কারণেই ইকবালকে মফস্বলে না পড়িয়ে আমরা ঢাকায় পাঠিয়ে দিই পড়াশোনার জন্য। সেখানে সে খুব ভালো রেজাল্টের মাধ্যমে সাফল্য দেখিয়েছে। আমাদের ছেলের বর্তমান সাফল্য দেখে আমাদের খুবই ভালো লাগে। আমরা গর্ববোধ করি। সবচেয়ে বড় কথা আমাদের অন্যান্য ছেলেমেয়ে নিয়েও আমাদের কোনো চিন্তা করতে হয় না, সেই পরিবারের খরচ থেকে শুরু করে ভাই-বোনদের পড়াশোনা ক্যারিয়ার সব কিছুই মেইনটেইন করে। এমন একটি সন্তান একটি পরিবারকে বদলে দিতে পারে বলে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস।’

ইকবাল ফেরদৌস অবসরে ভ্রমণ করতে ভালোবাসেন। এরমধ্যে বিশটিরও অধিক দেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা রয়েছে ইকবাল হোসাইন ফেরদৌসের। স্বপ্ন তার বাংলাদেশের এই পতাকা বুকে নিয়ে বিশ্বে এর খ্যাতি-যশ ছড়িয়ে দেওয়া।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *