হাকালুকিতে বেড়েছে অতিথি পাখি, ফিরেছে প্রাণচাঞ্চল্য


গত বছরের তুলনায় এবছর অতিথি পাখির সংখ্যা বেড়েছে এশিয়ার অন্যতম এবং দেশের বৃহত্তম হাওর হাকালুকিতে। শীত মৌসুমে পাখিদের অভয়াশ্রম খ্যাত এই হাওরে বিগত বছর উদ্বেগজনক হারে পাখি কম ছিলো। যদিও এর আগের পাঁচ বছর পাখির সংখ্যা ক্রমান্ময়ে বেড়েছিলো। এ বছর পাখির সংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে দেখা মিলেছে হুমকির মুখে থাকা কিছু প্রজাতির পাখি।

পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় দেশের বারো মাসই এই হাওরের গুরুত্ব অসীম। বর্ষাকালে হাওরে যেমন পানির আধিক্যতা মাছের অবাধ বিচরণে সাহায্য করে। শীত মৌসুমে খোলা আকাশের নিচে অতিথি পাখিদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে এই হাওরের খ্যাতি আছে। বর্ষা মৌসুমে ৪৮ হাজার হেক্টর জুড়ে বিশাল এ হাওরের আয়তন শুকনা মৌসুমে ২৫ হাজার হেক্টরে নেমে আসে।

শীত মৌসুমে প্রতি বছর নানান প্রজাতির অতিথি পাখির কলকাকলিতে হাকালুকি হাওরে প্রাণচ লতা ফিরে আসে। শুষ্ক এই মৌসুমে হাকালুকির চারিদিকে শূন্যতা গুচিয়ে পাখির কিচিরমিচির শব্দে ভরপুর হয় চারপাশ। আর তাদের মন মাতানো উতাল-পাতাল উড়ন্ত ঢেউয়ের সৌন্দর্য দেখতে ভীড় করেন দেশ-বিদেশের পর্যটক ও প্রকৃতি প্রেমীরা। বিশ্বের শীতপ্রধান দেশগুলোতে শীতের তীব্রতায় ওখানকার পাখিগুলো আতিথ্য নিতে ছুটে আসে বাংলাদেশসহ বিশ্বের কয়েকটি দেশে। মূলত বরফ শীতের কাতরতা থেকে বাঁচতে পাখিগুলো নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে বের হয়। শীত কমে আসলে তারা আবার ছুটে যায় নিজ ভূমিতে।

হাকালুকি হাওরের মৌলভীবাজার অংশে গত বছরের চেয়ে এবছর পাখির সংখ্যা বেড়েছে। হুমকির মুখে আছে এমন কিছু প্রজাতির পাখিরও সন্ধান পাওয়া গেছে এবছর। তার মধ্যে মহাবিপন্ন বেয়ারের ভুতিহাঁস, সংকটাপন্ন পাতি ভুতিহাঁস এবং প্রায়-সংকটাপন্ন মরচেরং ভুতিহাঁস, ফুলুরি হাঁস, কালামাথা কাস্তেচরা, উত্তুরে টিটি, উদয়ী গয়ার অন্যতম।

বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব ও ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব ন্যাচার (আইইউসিএন) বাংলাদেশের উদ্যোগে দুই দিনের পাখিশুমারি শেষে এ তথ্য জানানো হয়েছে। ২৮ ও ২৯ জানুয়ারির (মঙ্গলবার ও বুধবার) পাখি শুমারিতে মৌলভীবাজারের হাকালুকি হাওরে ৫৩ প্রজাতির ৪০ হাজার ১২৬টি জলচর পাখি পাওয়া গেছে। এ দুই দিন হাওরের ৪০টি বিলে জলচর পাখিশুমারি করা হয়। বুধবার রাতে শুমারির ফল প্রকাশ করা হয়।

শুমারিতে অংশ নেন পাখি বিশেষজ্ঞ ড. পল থমসন, ইনাম আল হক এবং পাখি শুমারি নিয়ে কাজ করা ওমর শাহাদাত, শাহেদ ফেরদৌস, শফিকুর রহমান ও তারেক অণু।

বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর পাখির সংখ্যা ২০১৯ সালের চেয়ে সামান্য বেশি। তবে ২০১৮ ও ২০১৭ সালের চেয়ে কম। ২০১৯ সালে হাকালুকিতে ৩৭ হাজার ৯৩১টি পাখির দেখা মেলে। এর আগে ২০১৮ সালে ৪৫ হাজার ১০০টি এবং ২০১৭ সালে ৫৮ হাজার ২৮১টি পাখির দেখা মেলে পাখি শুমারিতে।

হাকালুকির ৪০টি বিলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পাঁচ হাজার ৪৩০টি পাখি পাওয়া গেছে চৌকিয়া বিলে। এরপর পাঁচ হাজার ১৪৭টি পাখি পাওয়া গেছে চ্যাতলা বিলে। এ ছাড়া ফুটবিলে চার হাজার ৯৮৩টি পাখি ও বালিয়াজুরি বিলে তিন হাজার ৩০৫টি পাখি পাওয়া গেছে।

এদিকে হাওড়খালে বিষটোপ দিয়ে মারা পাখিও পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের সহ-সভাপতি তারেক অণু। তিনি জানান, দুই দিনব্যাপী হাকালুকি হাওরের ৪০টি বিলে পাখিশুমারি চলে। বিলগুলো হলো- হাওয়াবন্যা, কালাপানি, রি , দুধাই, গড়কুড়ি, চৌকিয়া, উজান-তরুল, ফুট, হিংগাউজুড়ি, নাগাঁও, লরিবাঈ, তল্লার বিল, কাংলি, কুড়ি, চেনাউড়া, পিংলা, পরোটি, আগদের বিল, চেতলা, নামা-তরুল, নাগাঁও-ধুলিয়া, মাইছলা-ডাক, চন্দর, মালাম, ফুয়ালা, পলোভাঙা, হাওড় খাল, কইরকণা, মোয়াইজুড়ি, জল্লা, কুকুরডুবি, বালিজুড়ি, বালিকুড়ি, মাইছলা, গড়শিকোণা, চোলা, পদ্মা, কাটুয়া, তেকোণা, মেদা, বায়া, গজুয়া, হারামডিঙা ও গোয়ালজুড়।

সরেজমিনে হাকালুকি হাওরের চৌকিয়া বিল, গৌড়কুরী বিল, নাগুয়া বিল, ফুটবিল ও চাতলা বিলে গিয়ে দেখা যায়, পরিযায়ি পাখিগুলো মনের রঙ মিশিয়ে এলোপাতারি উড়ছে। প্রাণ চ লতায় ভরপুর যেন আশেপাশের জলাশয়গুলো। চারিদিকে পাখিদের ওড়াওড়িতে ও কলকাকলিতে পরিবেশ ছিলো মনোরম। কোথাও পাখিরা দলবেধে ডুব সাঁতার খেলা করছে।

বাংলাদেশ জলচর পাখি জরিপের জাতীয় সমন্বয়ক ও পাখি বিশেষজ্ঞ ইনাম আল হক বলেন, প্রতি বছরই প্রচুর অতিথি পাখি হাকালুকি হাওরে বিচরণ করে। আশাজাগানিয়া তথ্য হচ্ছে এবছর কিছু বিপন্ন পাখির সন্ধান পাওয়া গেছে।