দুই বাংলার অর্থাৎ বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গের রাজবংশী সমাজের মাসান শিল্পকলাকে বাঁচিয়ে রাখার প্রচেষ্টায় এবং বিশ্ব দরবারে তুলে ধরার জন্য নিরলস ভাবে কাজ করে যাচ্ছেন শিল্পী শ্রী মধুসূদন দাস।
বাংলা ভাষায় মাসান শব্দের আক্ষরিক অর্থ যাইহোক উত্তরবঙ্গের রাজবংশী সমাজে এক ধরনের অপদেবতার নাম। এই সমাজে বিশ্বাস করা হয় শ্মশানচারী এই অপদেবতা বাড়ীর নিকটবর্তী বনে জঙ্গলে শ্মশানে জলে এবং বাড়ির আশপাশের এলাকায় বাস করেI এই অপদেবতা দুপুরবেলা বা সন্ধ্যার সময় কাওকে একা পেলে তাদের উপর ভর করে এবং তার অমঙ্গল সাধন করে থাকে ধারণা করা হয়।
শ্মশান শব্দ থেকেই কালক্রমে মাসান শব্দের উৎপত্তি ঘটেছেI কারণ উত্তরবঙ্গে কথ্য ভাষায় উত্তরবঙ্গে যুগ্ন শব্দ হিসাবে কথ্যভাষায় শ্মশান-মাসান শব্দটির প্রচলিতI অর্থাৎ শ্মশানে যে বিরাজ করে সেই মাসান হিসেবে বিবেচিত হয়।
আবার মাসান কথার অর্থ হল মৃত্যু। উত্তরবঙ্গের রাজবংশী সম্প্রদায়ের মধ্যে মাসান পূজার পাশাপাশি ব্যাপকভাবে ভিন্ন রীতি-পদ্ধতি পালন লক্ষ্য করা যায়। গল্পে আছে একবার কালি একাকিনী নদীতে স্নান করছিলেন। এমন সময় সেখানে আকস্মিকভাবে ধর্ম ঠাকুর উপস্থিত হন । ঘটনার স্বাভাবিক পরিণতি হিসেবে দুজনের মিলন ঘটে। অতঃপর এই মিলনে মাসানের জন্ম হয়।
যাইহোক সাধারণভাবে ১৮ প্রকারের মাসান আছে বলে বিশ্বাস করা হয়I এরা প্রত্যেকেই মানব সমাজে নানা ক্ষতিকারক কাজেও অনিষ্ট কাজে মগ্ন থাকে। এই অপদেবতার সন্তুষ্টির জন্য আজও তার উদ্দেশ্যে নানা প্রকার পূজা-পার্বণ অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। সাধারণত মাসানের বাহন ঘোড়া। রাজবংশী সম্প্রদায়ের এই মাসান পূজায় এক বিশেষ ধরনের চিত্র চর্চার প্রকাশ দেখতে পাওয়া যায় যা বিশেষভাবে উল্লেখের দাবি রাখে।
শিল্পী শ্রী মধুসূদন দাস বলেন, দীর্ঘ পরম্পরায় এই পূজা কেন্দ্রিক চর্চিত চিত্রকলা নানা কারণে কৌতূহল উদ্দীপক। মাসান পূজা কেন্দ্রিক ছোট বিগ্রহ নির্মাণ অংকনরীতি ও রঙ আকার-আকৃতি গ্রামীণ সহজিয়া দৃষ্টিভঙ্গি আমার প্রধান আলোচ্য বিষয় হিসাবে উপস্থিত করার প্রয়াস ঘটিয়েছি। পর্যায়ক্রমিকভাবে সম্পর্কে জানতে গিয়ে এক বিশেষ জাতি গোষ্ঠী, তথা অঞ্চলের সৃষ্টি সম্বন্ধে অবহিত হই ।মাসান এর প্রভাব রাজবংশী সম্প্রদায়ের মধ্যে অত্যন্ত প্রকট। এই সম্প্রদায়ের বা গোষ্ঠীর আচার কৃষ্টি ঐতিহ্য বিশ্বাস কুসংস্কার সংস্কার ইত্যাদির সংমিশ্রণে পূজিত হচ্ছে এই মাসান শিল্পকলা।
তিনি আরো জানান, নর্থ বেঙ্গলের এই অমূল্য সম্পদ মাসান শিল্পকে সিসিআরটি মিনিস্ট্রি অফ কালচার গভমেন্ট অফ ইন্ডিয়া তে তুলে ধরেছিলাম। তারপর সিসিআরটিতে এই শিল্পকর্ম খুবই গুরুত্বপূর্ণ হিসাবে খ্যাতি অর্জন করার জন্য আমাকে এই বিষয়টা নিয়ে গবেষণা ও চর্চা করে আরো বড়ো আকারে করার জন্য এবং শিল্পকর্মকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য সিনিয়ার ফেলোশিপ দেওয়া হয় । বর্তমানে আমি অনেকগুলো কাজ মালাকারদের নিয়ে শুরু করে দিয়েছি এবং ভবিষ্যতে আরো অনেক কাজ করার চেষ্টা করছি। বটতলাহাট বেলাকোবা জলপাইগুড়ি সেখানে গিয়ে তাদের শিল্পকর্ম কিনেছি।

রাজগঞ্জ তেলিপাড়াতে অনেক মাসান শিল্পীদের নিয়ে আট ওয়াকসপ করেছি। তাদের উৎসাহ দেওয়ার জন্য ব্রাশ এবং কালারের সেট সকলকে দিয়েছি। ক্যানভাসে কি করে এক্রেলিক কালার দিয়ে কাজ করতে হয় সেটা শিখিয়েছি এই মালাকারদের যাদের নাম সুশান্ত মালাকার মালাকার এবং বিকাশ মালাকার । এই মাসান শিল্পীদের শিল্পকর্ম গুলোকে সরকারি মিউজিয়ামে রাখার ব্যবস্থা করছি। যাতে করে দেশ-বিদেশের জনসাধারণ ও শিল্পীরা দেখতে পারেন।
পরবর্তী প্রকল্পে এই মালাকারদের নিয়ে বিভিন্ন আর্ট কলেজে আর্ট ওয়ার্কশপ করার সিদ্ধান্ত রয়েছে। তাতে কলেজের ছেলে মেয়েদের নানা রকম ফোক আর্ট এর মধ্যে এটাও যে একটা নতুন ধরনের ফোক আর্ট সে বিষয়ে তারা জানতে পারবে এবং এটা নিয়ে অনেক বেশি কাজও করতে পারে।

শিল্পী শ্রী মধুসূদন দাস কলাভবন শান্তিনিকেতনে চিত্রকলা বিভাগের ছাত্র ছিলেন। তিনি দেশে ও বিদেশের নানা জায়গায় সমবেত ও একক প্রদর্শনী করেছেন এবং এখনো সরকারি স্পন্সর নিয়েও বাংলাদেশ-মালয়েশিয়া লন্ডনেও তার শিল্পকলা প্রদর্শিত হয়। ছাত্রাবস্থা থেকেই ১৯৯৮ সাল থেকেই তার মনের চেতনা জাগে যে দুই বাংলার এই পিছিয়ে থাকা মাসান শিল্পকলাকে বিশ্ব দরবারে পরিচিত হয় ও প্রচার-প্রসার ঘটে। তার জন্য গ্রামে হাটে বাজারে গিয়ে গিয়ে মালাকার শিল্পীদের নিয়ে ওয়াকসপ করা ও নানাভাবে তাদেরকে উৎসাহিত করে চলেছেন।