রুম কোয়ারিনটেন থেকে বলছি


এবছরেরর জানুয়ারিতে চিনের হুয়ানে করোনার সংক্রমণের কারণে যখন মৃত্যুর সংখ্যা বাডতেছিল ,তখনই আমার অফিসের প্রথম মিটিং হয় যেটা ছিলো জানুয়ারির ১৩ তারিখে। তখনই বলা হয়েছিল করোনা ছডিয়ে পরবে সারা বিশ্বে। দেশের এই জরুরী সময়ে আমাদের কে কাজ করতে হবে। পরের দিনই ইমারজেন্সি আইডি দেয়া হল। যাতে করে পথ চলতে বাঁধা না হয়।সবই বুঁঝে নিলাম। সেদিনের মিটিংটা আমেরিকান সব কলিগরা খুবই গুরুত্ব সহকারে নিলেও আমি কেন জানি তেমন পাত্তা দিই নি। তখনো স্বাভাবিক ভাবেই কাজ করেছি। তবে ইতোমধ্যে হোম কোয়ারেনটিন, আইসোলেশন, স্যোশাল ডিসট্যান্স এসব সম্পর্ক বিস্তর জেনে গেছি বুঝেও গিয়েছি অনেককিছু। যদি ও যথেষ্ট সিকিউরড হয়ে কাজে যাই তারপরও এখন আমার অফিস করতে একটু ভয় লাগে।

দেখতে দেখতেই খুব দ্রুতই পরিস্তিতি পাল্টে গেল। চিন থেকে দ্রুত এর সংক্রমণ ছডিয়ে পড়ল। মানুষ বুঝে উঠবার আগেই অন্ধকার ঘনিভূত হতে থাকে। জ্ঞানী বিজ্ঞানীরা তাদের গবেষণার খাতা খুলছি খুলবেন করতে করতেই মানুষ অসহায় হয়ে পড়ল। মানুষের মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘতর হতে থাকল। মানবতা অসহায় হয়ে পড়ল অজানা শত্রুর কাছে।

এখন যেহেতু পরিস্তিতি ভিন্ন। আমি একজন ভীষণ রকম অনুভূতিপ্রবণ মানুষ হিসেবে, সবসময় একটি সুন্দর মানবিক পৃথিবীর স্বপ্ন দেখি, যেখানে মানুষের কোন দুঃখ-দূর্দশা, মানবিকতার সংকট থাকবে না। সেই স্বপ্নের পৃথিবী বিনির্মাণে মানুষের মাঝে থাকবে শুধু মানবিকতা আর ভালোবাসা।মানবতার বিপর্যয় দেখে হৃদয় বেদনায় আহত। আবার কেউ বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে দেখলে তাদের প্রতি শ্রদ্ধায় মাথানত হয়। এখনি সময় মানুষের পাশে মানুষের দাঁড়ানোর। আজ যদি মানুষ মানুষের পাশে না দাঁড়ায় তাহলে আর কখন দাঁড়াবে। রাতারাতি চিন হাসপাতাল বানিয়েছে নিশ্চই বাংলাদেশ ও তৈরী করবে। মনে মনে আশারাখি বাংলাদেশের কোটিপতিরা এগিয়ে আসছেন তৈরী হচ্ছে ডাক্তারসহ হাসপাতাল কর্মীদের জন্য স্পেশালাইজ পোশাক , করোনা রোগি টেস্টের কীট পর্যাপ্ত ভেনটিলেশনসহ আধুনিক ইকুইপমেন্ট।

চারদিকে সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাত নেমে এলো। আরও গভীর রাতে সকলে ঘুমিয়ে গেলে শুধু এমবিউল্যান্সের সাইরেন কানে বাজে। অন্তর আত্মা কেঁপে উঠে কার বাসার সামনে আসল। উকি দিয়ে দেখবার চেষ্টা করি। মন চায় দৌডে গিয়ে দেখে আসি। পৃথিবী আজ নীরবে দাঁড়িয়ে মানুষের এত কষ্ট কেমন করে সহ্য করছে? অন্ধকার সুনসান নীরবতায় চারিদিকে শুধু সাইরেন আর সাইরেন। দিনের আলো আর রাতের অন্ধকার যেন একই হয়ে গেছে। আজ হৃদয় পৃথিবীর কষ্টে থাকা মানুষের দুর্দশার আওয়াজ শুনতে পায়। মনে তাগাদা আসে মানুষের কষ্টে বেদনাহত হয়ে পেখম মেলে। বেড়ালের মতো চারদিক দেখতে পাই কী সংকটে ছেয়ে আছে মানুষের সংসার। তা নিয়েই হয়ত একদিন কাব্য উপন্যাস উঠে আসবে লেখকের কলমে।

আশাকরি এই করোনা মহামারীর থেকে মুক্ত হলে পর দেশে দেশে আর যুদ্ধ বাঁধবে না। উন্নত দেশগুলি আগিয়ে আসবে বিভিন্ন দেশের ক্ষুধা, দারিদ্র, মহামারী, বাস্তুচ্যুতি ও অর্থনৈতিক অধঃপতন ঠেকাতে। এক হয়ে কাজ সমগ্র বিশ্ব। বন্ধ হবে খুনেখুনির এর রাজনীতি। বন্ধ হবে ধর্ম নিয়ে রেশারেশি।বন্ধ হবে অস্ত্রের ঝনঝনানী। হয়ত দেখতে হবে না ইয়েমেনবাসীর দুর্ভোগের চিত্র। সাগরে ভাসবেনা আর কোন শিশুর লাশ।

এগুলো এমনকিছু শিরোনাম যা ইয়েমেন নামটির সাথে লেগেই থাকছে এবং নতুন বছর ২০১৯ পর্যন্ত পিছু ছাড়েনি।

দেশটির হুথি বিদ্রোহী ও সৌদি ইমারতের মাঝে চলমান যুদ্ধ পঞ্চম বছরে প্রবেশের সাথে আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমগুলোর শিরোনামও জাতিসংঘের রিপোর্টগুলোতে উঠে এসেছে।

করোনা ভাইরাস সংক্রমণজনিত বৈশ্বিক সমস্যা বাংলাদেশকেও গ্রাস করেছে। আমাদের শতবর্ষের ইতিহাসে এটি ভয়াবহতম মানবিক বিপর্যয়ের ঘটনা। প্রতিনিয়ত আমাদের দেশে করোনা সংক্রমণজনিত স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়েই চলেছে। এর আগেও বিশ্বে এ ধরনের স্বাস্থ্য বিপর্যয় নেমে এসেছে। প্লেগ-কলেরা-স্প্যানিস ফ্লুর মতো মহামারি মোকাবিলা করে মানবসভ্যতা টিকে আছে।

বিশ্বখ্যাত প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা, বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ধনী বিল গেটস যদি এখন আমেরিকার রাষ্ট্রপতি হতেন, তবে তিনি করোনাভাইরাস প্রতিরোধে লোকজনকে আইসোলেশনে রেখে রেখাটাকে চ্যাপ্টা করাকে (ফ্ল্যাটেন দ্য কার্ভ) অগ্রাধিকার দিতেন।

মঙ্গলবার টেড (টিইডি) সঞ্চালক ক্রিস অ্যান্ডারসনকে বিল গেটস বলেন, ‘(প্রেসিডেন্ট হলে) স্পষ্ট বার্তা হতো, আইসোলেশন বজায় রাখা ছাড়া আমাদের আর কোনো বিকল্প নেই; এবং এটি একটা লম্বা সময় ধরে চলবে। চীনাদের ক্ষেত্রে এটি ছিল ছয় সপ্তাহের মতো, সুতরাং আমাদেরও সেরকম করার জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে এবং তা খুব ভালোভাবে সম্পন্ন করতে হবে।’

বিল গেটসের মতে, ‘আপনারা যদি সারাদেশে ভালভাবে আইসোলেশনে থাকতে পারেন, তাহলে ২০ দিনের মধ্যে আপনি দেখতে পাবেন নতুন আক্রান্তের সংখ্যা সত্যিই পরিবর্তিত হয়েছে, কমে গেছে। আর এটা দেখেই বোঝা যাবে আপনারা সঠিক পথে আছেন।

প্রেসিডেন্ট হিসেবে গেটস আরও জোর দিতেন, ‘এটি খুব সহজ হবে না। এ বিষয়ে আমাদের স্পষ্ট বার্তা দরকার।’

যুক্তরাষ্ট্রে বর্তমানে ১৮টি অঙ্গরাজ্য, ৩১ কাউন্টি ও ১৩ শহরের প্রায় ১৮ কোটি মানুষকে ঘরে থাকার জন্য বলা হয়েছে। সংবাদমাধ্যম নিউইয়র্ক টাইমস এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে।

এরই মধ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, শিগগিরই দেশটিতে ব্যবসা-বাণিজ্য খুলে দেওয়া হবে।

তবে বিল গেটস অর্থের চেয়ে মানুষের স্বাস্থ্যকেই গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি বলেন, এটা খুবই বেদনার যে অর্থনৈতিক প্রভাব খুবই নাটকীয়। আমাদের পুরো জীবনে এমন ঘটনা এর আগে কখনও ঘটেনি। তবে অর্থ ফিরিয়ে আনা খুব সম্ভব, কিন্তু মানুষের জীবন ফেরানো অসম্ভব। তাই আমরা অর্থনৈতিক বিশাল চাপের যন্ত্রণা মেনে নিতে যাচ্ছি, যাতে রোগ আর মৃত্যুর যন্ত্রণা কমানো যায়।’

বিল গেটস এই ভাইরাসের থাবা থেকে মুক্ত থাকতে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার নীতি নিয়েছেন। বাড়ি থেকে কাজ করছেন। তিনি করোনাভাইরাস সংকটে অনেকগুলো ধনী দেশ আক্রান্ত। সন্দেহভাজনদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও সামাজিক দূরত্ব (যেটাকে আমি শাটডাউন বলছি) মেনে চলাসহ সঠিক পদক্ষেপ নিয়ে আগামী দুই থেকে তিন মাসে ধনী দেশগুলো করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে সক্ষম হবে। আমি চিন্তিত উন্নয়নশীল দেশগুলোকে নিয়ে। তারা অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ধনী দেশগুলোর মতো তাদের সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলার উপায় নেই। তাদের হাসপাতালগুলোর সক্ষমতাও অনেক কম।

বিল গেটস বলেন, সবচেয়ে বড় যে বিষয় তা হলো—শাটডাউন পদ্ধতি মেনে চলুন। মানে সামাজিক মেলামেশা বন্ধ রেখে সামাজিক দূরত্বের নীতি মেনে চলুন। এতে করে আপনার আশপাশের লোকের মধ্যে এই ভাইরাসের সংক্রমণ হবে না। আক্রান্তের হার নাটকীয়ভাবে কমে যাবে। এতে করে দ্রুততম সময়ে আমরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারব।

,

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *