হাজী মো. আব্দুস সামাদ ৩০ জুলাই ১৯৫২ সনে বাংলাদেশের সিলেট বিভাগের অন্তর্ভূক্ত মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার আদমপুর ইউনিয়নস্থ কান্দিগাঁও গ্রামে মরহুম মো. আব্দুস সহিদ এর ঔরসে জন্মগ্রহণ করেন। কমার্স গ্র্যাজুয়েট মো. আব্দুস সামাদ ১৯৭৫ সালে রাষ্ট্রায়ত্ব বানিজ্যিক ব্যাংক “সোনালী ব্যাংক লি:” এ যোগদান করেন। ২০১০ সালে সিনিয়র এক্সকিউটিভ অফিসার হিসাবে কর্মরত অবস্থায় অবসর,গ্রহণ করেন। বর্তমানে কান্দিগাঁওস্থ নিজ আলয়” পাঙাল নিবাস’এ অবসর জীবনযাপন করছেন| তিনি বাংলাদেশে বসবাসরত মণিপুরি জনগোষ্ঠীর একজন কবি ও সাহিত্যিক। সাহিত্যের বিভিন্ন শাখা তার পদচারনায় মুখরিত– সাক্ষাৎকার নিয়েছেন– রফিকুল ইসলাম জসিম
” মণিপুরি মুসলিম সমাজ ঘিরে আমার স্বপ্ন শুধু বিজ্ঞান নয়, সাহিত্য, শিল্প প্রভৃতি বিষয়ের চর্চাকেও তারা যেন জীবনে গুরুত্ব দেয়। তরুণ প্রজন্মের প্রতিও একই আহ্বান তারা বিজ্ঞান, সাহিত্য শিল্প প্রভৃতির চর্চায় যেন আরো মনোনিবেশ করে ”
রফিকুল ইসলাম জসিম: কেমন আছেন?
হাজী মো. আব্দুস সামাদ : মহান আল্লাহ রাব্বুল আ-লামিনের অশেষ মেহেরবানিতে ভালই আছি।
রফিকুল ইসলাম জসিম: লেখালেখির শুরুটা কিভাবে হলো এবং কি লিখছেন সেটা যদি বলতেন
হাজী মো.আব্দুস সামাদ: লেখালেখির শুরু বাল্যকাল থেকেই, কিন্তু তা অনিয়মিত এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক। প্রাতিষ্ঠানিক লেখার শুরু চাকুরী জীবন থেকেই। লেখার বিষয়বস্তু ছিল সামাজিক অনুভূতি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনা, কবিতা, ছোট গল্প, ডাইরী ইত্যাদি।। কিন্তু প্রকাশক বা মাধ্যমের অভাবে তার অনেকটাই হারিয়ে গেছে।
এখন আত্মজীবনী লেখার চেষ্টা করছি। পাশাপাশি আমার লেখা ইতিহাস গ্রন্থের ইংরেজী অনুবাদ। আর মন চাইলে মাঝেমধ্যে কবিতা আর ছোট ছোট অনুভূতি আর স্মৃতিকথা।
রফিকুল ইসলাম জসিম: বর্তমানে আপনার সাহিত্য চর্চা কেমন চলছে ?। বয়স তো ৬০ বছর পার হলো, এই দীর্ঘ জীবনের অনুভূতি আমাদের জানাবেন কি ?
হাজী মো.আব্দুস সামাদ : অভিধানিক অর্থে সাহিত্য চর্চা বলতে যা বুঝায়, তার চর্চা খুব একটা নেই বললেই চলে। বার্ধক্য এসেছে, তদুপরি সমাজ, সংসারকে কিছুটা সময় দিতে হয়। ধর্ম কর্মতো আছেই।
ছাত্র জীবনে ছাত্র রাজনীতি করেছি। আমি ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত আদমপুর ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলাম। তাছাড়াও জীবনের দীর্ঘ একটা সময় ব্যাংকে চাকুরী করেছি। কোথাও কোন প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়নি, সর্বক্ষেত্রেই সহযোগিতা ও মূল্যায়ন পেয়েছি। তাই জীবনের অনুভূতি বলতে যা বুঝায় তা সুখকর।
রফিকুল ইসলাম জসিম: লেখালেখিতে মণিপুরি মুসলিম বা মৈতৈ পাঙানরা কিছুটা উপেক্ষিত এবং অবজ্ঞাত থেকেই গেছে ৷ আপনার লেখা মণিপুরি মুসলমানদের ইতিবৃত্ত বই সম্পর্কে কিছু বলবেন?
হাজী মো. আব্দুস সামাদ : লেখালেখিতে মণিপুরি মুসলমানরা উপেক্ষিত নয়, পশ্চাৎপদ, কিছুটা অনীহা। কারণ ভাষাগত এবং পরিবেশগত প্রতিকুলতা। এ প্রতিকুলতা দূর করা গেলে এবং অভ্যাস গড়ে তুলা হলে অদূর ভবিষ্যতে সাহিত্যমনা স্বজনেব র সন্ধান পাওয়া যাবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
আমার লেখা “মণিপুরি মুসলমানদের ইতিবৃত্ত” একটি ইতিহাস গ্রন্থ। তবে আমি চেষ্টা করেছি এর ভাষাগত মাধুর্য বিঘ্নিত না ঘটানোর, যাতে শ্রুতিমধুর হয়। কিন্তু তা মূল্যায়নের ভারতো আমার কাছে নয়, পাঠকদের উপর।
রফিকুল ইসলাম জসিম: ভাষা সাহিত্য ও সংস্কৃতির জায়গায় মণিপুরি মুসলমানদের অবস্থান সম্পর্কে আপনার বক্তব্য কি?
হাজী মো. আব্দুস সামাদ : ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে মণিপুরি মুসলমানদের অবস্থান মূল্যায়ন করতে গেলে প্রথমেই বলতে হয়, আমাদের মাতৃভাষা মণিপুরি যা আমাদের first language, parrent language অথচ আমাদের লেখাপড়ার হাতেক্ষরি বাংলা ভাষায়। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে ইউনিভার্সিটি পর্যন্ত শিক্ষার মাধ্যম বাংলায়। অথচ বাংলা আমাদের secondary language, যার ফলশ্রুতিটে আমাদের সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যম খুব একটা মসৃন নয়।
রফিকুল ইসলাম জসিম: মণিপুরি মুসলিম সমাজকে ঘিরে আপনার কোন স্বপ্ন আছে কি? তরুন প্রজন্মের উদ্দেশ্যে কিছু বলুন?
হাজী মো. আব্দুস সামাদ : মানুষ মননশীল। অন্যান্য প্রাণীদের মত সে শুধু খেয়ে-পরে বাঁচতে পারে না। বাঁচার জন্য তার মননশীলতার চর্চারও প্রয়োজন।এই মননশীলতার চর্চা করতে গিয়েই সে সৃষ্টি করেছে সাহিত্য ,বিজ্ঞান,শিল্প প্রভৃতি বিষয়।এগুলির কোনটিকেই তার জীবন থেকে বাদ দেওয়া চলে না। তাই মণিপুরি মুসলিম সমাজ ঘিরে আমার স্বপ্ন শুধু বিজ্ঞান নয়, সাহিত্য, শিল্প প্রভৃতি বিষয়ের চর্চাকেও তারা যেন জীবনে গুরুত্ব দেয়। তরুণ প্রজন্মের প্রতিও আমার একই আহ্বান তারা বিজ্ঞান, সাহিত্য শিল্প প্রভৃতির চর্চায় যেন আরো মনোনিবেশ করে।
রফিকুল ইসলাম জসিম : ইসলামী সমাজ ব্যবস্থার দিক থেকে মণিপুরি মুসলিম সমাজের বর্তমান বাস্তবতা এবং এর চলমান প্রক্রিয়া সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কি?
হাজী মো. আব্দুস সামাদ :“দুনিয়ার সমস্ত মানুষ একই বংশোদ্ভুত”-এ মতের উপরই ইসলামী সমাজ ব্যবস্থার বুনিয়াদ স্থাপিত হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা সর্বপ্রথম একজোড়া মানুষকে সৃষ্টি করেছেন, তারপরে সেই জোড়া হতে দুনিয়ার সকল মানুষের জন্ম হয়েছে। প্রথম দিক দিয়ে একজোড়া মানুষের সন্তানগণ দীর্ঘকাল পর্যন্ত একই দল ও একই সমাজের অন্তর্ভূক্ত ছিল ; তাদের ভাষাও ছিল এক। কোন প্রকার বিরোধ-বৈষম্য তাদের মধ্যে ছিল না। কিন্তু তাদের সংখ্যা যতই বৃদ্ধি পেতে লাগল ততই তারা পৃথিবীর নানাদিকে ছড়িয়ে পড়তে লাগল এবং এ বিস্তৃতির ফলে তারা অতি স্বাভাবিকভাবেই বিভিন্ন বংশ, জাতি ও গোত্রে বিভক্ত হয়ে পড়ল। তাদের ভাষা বিভিন্ন হয়ে গেল, পোশাক-পরিচ্ছদের দিক দিয়ে অনেক বৈষম্য ও বৈচিত্র দেখা দিল।
দৈনন্দিন জীবন যাপনের রীতিনীতিও আলাদা হয়ে গেল এবং বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন আবহাওয়ায় তাদের রং, রূপ ও আকার-আকৃতি পর্যন্ত বদলিয়ে গেল। এসব পার্থক্য একেবারেই স্বাভাবিক, বাস্তব দুনিয়ায়ই এটা বর্তমান। আর মণিপুরি সমাজ ব্যবস্থার সৃষ্টিও একই প্রক্রিয়ায়। এটাই বাস্তবতা। কাজেই চলমান সমাজ যাতে আরো সুন্দর হয়, সচল হয় তার জন্য আমাদের সবার কাজ করা উচিত।
রফিকুল ইসলাম জসিম: যে কোন জাতির উন্নতির ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষ সমভাবে এগিয়ে যেতে হয়৷ মণিপুরি মুসলিম সমাজ গঠনে নারীর অংশগ্রহণ অথবা অবদান কতটুকু?
হাজী মো. আব্দুস সামাদ : বিশ্বের বর্তমান জনসখ্যার দিকে তাকালে দেখা যায় মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক নারী, একবিংশ শতাব্দীর নারীরা এগিয়ে এসেছেন সমাজ উন্নয়নের নানা ক্ষেত্রে। সামাজিক নানা বাধাবিপত্তি থাকা সত্ত্বেও ঘড়ে-বাইরে পুরুষের সংগে সমান তালে কাজ করছেন। কৃষি থেকে শিল্পখারখানা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আফিস আদালত সব জায়গায় তারা নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করছেন । আর মণিপুরি সমাজও এর ব্যতিক্রম নয়। তারা আজ গৃহস্থালী কাজের পাশাপাশি বিভিন্ন পেশার চাকুরী ও ব্যবসায় সম্পৃক্ত। বেশ কয়েকজন ডাক্তারতো রয়েছেই তদুপরি কলেজ শিক্ষক এবং পররাষ্ট্র কেডারে চাকরীর উদাহরণও তারা সৃষ্টি করেছেন। অনাদি কাল থেকে মণিপুরি নারীরা বয়ন শিল্পের সাথে সম্পৃক্ত। তাছাড়াও মণিপুরি মুসলিম নারীরা সংসারের অর্থনীতির চাকাকে সবল রাখতে কুটির শিল্প ও রবিশষ্য আবাদে বিশেষ অবদান রেখে আসছে।
রফিকুল ইসলাম জসিম: মুক্তিযুদ্ধ কালে আপনার বয়স কত ছিল? কিভাবে দেখেন মুক্তিযুদ্ধকে? মুক্তিযুদ্ধে মণিপুরি মুসলমানদের ভুমিকাকে আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করেন?
হাজী মো. আব্দুস সামাদ : মুক্তিযুদ্ধকালে আমার বয়স ২০ বছর। আমি মুক্তিযুদ্ধ সরাসরি দেখেছি। একজন ছাত্রলীগ নেতা হিসেবে আমি এলাকায় মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিতও করেছি। কিন্তু শারীরিক অসুস্থতার কারণে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারিনি। মহান মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি জাতির ইতিহাসে একটি অত্যন্ত গৌরবময় ঘটনা। অথচ আদমপুরের মত প্রায় মুক্তাঞ্চলে (এখানে কোন সেনা কেম্প ছিলনা এ অর্থে) থেকেও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে না পারা আমার জীবনের চরম ব্যর্থতা এবং কষ্টের।
বিভিন্ন সময় সংঘটিত বাংলার জনগনের প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে এ দেশের সকল মণিপুরি জনতাও ছিল তাদের সহগামী। ১৯৭১ সালেও ছিলনা তার ব্যত্যয়। আমাদের সমাজে মুক্তিযুদ্ধার যে সংখ্যা রয়েছে তা প্রতিবেশী বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর তুলনায় কোন অংশে কম নয়। সত্তরের নির্বাচনেও মণিপুরি মুসলমানরা ১০০% ভোট মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি আওয়ামী লীগকেই প্রদান করেছে। তাই এদেশের মণিপুরি মুসলমানরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি।
রফিকুল ইসলাম জসিম : আপনি বিভিন্ন সময় নানা ধরণের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছেন। সে অভিজ্ঞতার আলোকে একজন কবি, সাহিত্যিক হিসেবে মণিপুরি মুসলিম সমাজের একটা সার্বিক চিত্র তুলে ধরবেন কি ?
হাজী মো. আব্দুস সামাদ :হ্যাঁ, তুমি ঠিকই বলেছ। শুধু অংশগ্রহণই নয়, যৌবনে আমি সিলেট স্বারদা স্মৃতি ভবনে মঞ্চস্থ “অন্যন্যা” ও “পাথর বাড়ী” দুইটি নাটকেও অভিনয় করেছি। আর সেটা ছিল স্রেফ বিনোদনের জন্য। আর এখন সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করি নিজের দায়বদ্ধতা থেকে। যে সমাজে আমি জন্মগ্রহণ করেছি, বড় হয়েছি সে সমাজকে আমার কিছু দেওয়া উচিত এ অনুভূতি থেকে বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে থাকি। যেমন এস,কে সিনহার ষড়যন্ত্রকে রূখতে সংবাদ সম্মেলন, ছাত্র জনতার মানব বন্ধনে স্বারকলিপি লিখে দেওয়া ইত্যাদি।
কবি সাহিত্যিক হিসাবে মণিপুরি মুসলমানদের আমার মুল্যায়ন হচ্ছে, এরা খুবই সাহসী, চৌকস, উদ্যমী, সৎ ও ধর্মপ্রাণ জাতি।
রফিকুল ইসলাম জসিম : আপনি দীর্ঘ সময় ধরে সাহিত্য চর্চা করে আসছেন। সে আলোকে আপনার এমন কোন স্বপ্ন আছে কি ? যা বাস্তবায়নের অপেক্ষায়।
হাজী মো. আব্দুস সামাদ: আমার একটাই স্বপ্ন, মণিপুরি মুসলমান যুবকরা তাদের সামাজিক অবক্ষয় দূর করার জন্য অস্ত্র হিসাবে কলমকে যেন ব্যবহার করে।
রফিকুল ইসলাম জসিম : আপনাকে ধন্যবাদ।
হাজী মো. আব্দুস সামাদ : আপনাকে ও বাংলা সংবাদ কে ধন্যবাদ।