প্রথম নির্বাচনেই শেখ হাসিনাকে পরাজিত করে এমপি হয়েছিলেন খোকা


সাদেক হোসেন খোকা- তৃণমূল থেকে উঠে আসা একজন প্রবীণ রাজনীতিবিদ। ডান ও বামদের সমন্বয় ঘটিয়ে উদার মানসিকতা নিয়ে রাজনীতি করতেন খোকা।সোমবার (৪ নভেম্বর) বাংলাদেশ সময় দুপুর ২ টার দিকে নিউ ইয়র্কে চিকিৎসাধিন অবস্থায় মহান এ নেতা মৃত্যুকূলে ঢলে পড়েন। মৃত্যুর আগে দেশে আসার আকুতি করেছিলেন এ রাজনীতিবিদ। কিন্তু আসতে পারেননি।

খোকা ছিলেন পুরান ঢাকার নেতা। তিনিই পুরান ঢাকায় বিএনপির দুর্গও গড়ে তুলেছিলেন। এর সুবাধে ১৯৯১ সালে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পরাজিত করে প্রথমবারের মতো এমপি হয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন সাদেক হোসেন খোকা।তাঁর মৃত্যুতে অভাব অনুভব করছেন পুরান ঢাকার তৃণমূল বিএনপির নেতাকর্মীরা। এভাবে তাঁর চলে যাওয়াটা বিএনপির রাজনীতিতে বিরাজ করছে বিশাল শূন্যতা। একই সঙ্গে ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছে পুরান ঢাকায় দলটির রাজনীতিও।

একদা পুরান ঢাকা ছিল রাজনৈতিক নেতাদের আড্ডার জায়গা। দক্ষিণপন্থি-বামপন্থি নেতাদের মধ্যে ব্যক্তিগত সম্পর্কে কোনো টানাপড়েন ছিল না। পুরান ঢাকা থেকেই এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল। বর্তমানে মহল্লাভিত্তিক সেই রাজনীতির বিশিষ্টতা নেই, নেতৃত্ব ও দলীয় ঐক্যও নেই। এ এলাকায় বিএনপির রাজনীতির কথা বলতে গেলে ঘুরেফিরে আসে মুক্তিযোদ্ধা, ঢাকা সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র, সাবেক মন্ত্রী ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকার নাম। তিনি ছিলেন পুরান ঢাকায় বিএনপির রাজনীতির অভিভাবক। অভিভাবকহীন বিএনপি এখন যেন অনেকটা প্রাণহীন হয়ে পড়েছে বলে মনে করছেন তৃণমূল নেতারা। তারা বলছেন, পুরান ঢাকায় বিএনপির দুর্গ গড়ে তুলে দলকে ঐক্যবদ্ধ করেছেন খোকা। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত চিকিৎসা নিতে প্রবাসে থেকেও খোকা নিয়মিত নেতাকর্মীদের খোঁজখবর নিয়েছেন। কোনো নেতার পারিবারিক ও আর্থিক সমস্যার কথা জানামাত্রই সমাধানের ব্যবস্থা করছেন।
যেভাবে উত্থান: বামপন্থি রাজনীতি ছেড়ে আশির দশকে বিএনপির রাজনীতি শুরু করেন খোকা। ওই সময় নয়াবাজার নবাব ইউসুফ মার্কেটে বিএনপির কার্যালয় থেকে এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সূচনা করে সাতদলীয় জোটের নেতৃত্ব দেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। ওই অন্দোলনে ঢাকা মহানগর সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়কের দায়িত্ব খোকাকে দেওয়া হয়েছিল। ১৯৯০ সালে বাবরি মসজিদ ভাঙাকে কেন্দ্র করে পুরান ঢাকায় হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলার চেষ্টা হলেও তা প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন তিনি। এতে খোকা পুরান ঢাকাবাসীর আস্থা অর্জন করেন। ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনে ঢাকা-৭ আসন (সূত্রাপুর-কোতোয়ালি) থেকে শেখ হাসিনাকে পরাজিত করে প্রথমবারের মতো এমপি নির্বাচিত হয়ে আলোচনায় আসেন। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে ঢাকার আটটি আসনের মধ্যে সাতটিতে বিএনপি প্রার্থী পরাজিত হলেও একমাত্র খোকা নির্বাচিত হন।

পরে আওয়ামী লীগ সরকারবিরোধী আন্দোলনে প্রায় পাঁচ বছর একক নেতৃত্ব দিয়ে তিনি বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ নেতায় পরিণত হন। ২০০১ সালের নির্বাচনেও সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে মৎস্য ও পশুসম্পদমন্ত্রী হন। ওই সময় পুরান ঢাকায় বিএনপির রাজনীতিতে নিজস্ব বলয় তৈরির পাশাপাশি প্রতিটি থানা ও ওয়ার্ডে দলকে শক্তিশালী করার পেছনে তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। এর আগে ১৯৯৪ সালে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ হানিফের কাছে পরাজিত হন মির্জা আব্বাস। বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য বিরোধী দল কঠোর আন্দোলন শুরু করলে ঢাকায় বিএনপি কোণঠাসা হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় খোকাকে ১৯৯৬ সালে মহানগর বিএনপির আহ্বায়কের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ২০০২ সালের ২৫ এপ্রিল অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে তিনি মেয়র নির্বাচিত হন। পাশাপাশি খোকাকে সভাপতি ও আবদুস সালামকে সাধারণ সম্পাদক করে ঢাকা মহানগর বিএনপির কমিটি গঠন করা হয়। নতুন করে কমিটি গঠনের জন্য আবার ২০১১ সালে সাদেক হোসেন খোকাকে আহ্বায়ক ও আবদুস সালামকে সদস্য সচিব করে আহ্বায়ক কমিটি করা হয়। এই কমিটির বিরুদ্ধেও খোকার প্রতিদ্বন্দ্বী মির্জা আব্বাসের অনুসারীরা নানা অভিযোগ তোলেন।

ওয়ান-ইলেভেনে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর তৎকালীন বিএনপি মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়ার নেতৃত্বে দলে যে সংস্কারের দাবি উঠেছিল, তার প্রতি সাদেক হোসেন খোকার সমর্থন ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর মির্জা আব্বাসকে আহ্বায়ক ও হাবিব-উন-নবী খান সোহেলকে সদস্য সচিব করে মহানগর কমিটি গঠন করা হয়।

জনবান্ধব নেতা: খোকা পুরান ঢাকার গোপীবাগে তার পৈতৃক বাড়িতে থেকেই রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। তিনি জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দলের সভাপতি ও কেন্দ্রীয় বিএনপির ত্রাণবিষয়ক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি শুধু রাজনীতিতে নন, মুক্তিযুদ্ধ থেকে ফিরেই ১৯৭২ সালে ব্রাদার্স ইউনিয়নের দায়িত্ব নিয়ে ক্লাবকে তিন বছরের মধ্যে তৃতীয় থেকে প্রথম বিভাগে উন্নীত করেন। মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্রের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা খোকা ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ও ফরাশগঞ্জ ক্লাবের গভর্নিংবডির চেয়ারম্যান ছিলেন। পুরান ঢাকার বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ জানান, খোকাকে তারা সুখে-দুঃখে, বিপদে-আপদে, দল-মত, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে পাশে পেতেন। যখনই ডাক পড়েছে, তখনই তিনি ছুটে গেছেন পুরান ঢাকাবাসীর কাছে।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *