দিল্লিতে নববর্ষের মধ্যরাতে হাজারও নারীর ব্যতিক্রমী প্রতিবাদ


নববর্ষের মধ্যরাতে শত শত নারী পুরুষ ভারতের রাজধানী দিল্লির দক্ষিণের শাহীন বাগে জমায়েত হয়েছেন। ১১৮ বছরের ইতিহাসে এই মুহূর্তে দিল্লিতে দ্বিতীয় সর্বনিম্ন শীতলতম সময় চলছে। কিন্তু তীব্র শীত উপেক্ষা করে গায়ে কম্বল কিংবা মোটা কাপড় জড়িয়ে শত শত মানুষ; যাদের বেশিরভাগই নারী একত্রিত হয়েছেন শাহীন বাগে। দেশটির বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইনের প্রতিবাদ জানাতে তারা সেখানে একত্রিত হয়েছেন। টানা দুই সপ্তাহ ধরে দক্ষিণ দিল্লির এই অংশে নারীরা বিক্ষোভ করে আসছেন। নববর্ষের মধ্যরাতে তারা সমবেত কণ্ঠে ভারতের জাতীয় সংগীত জন গণ মন গেয়ে প্রতিবাদ জানালেন নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের।

ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি বলছে, নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে জেগে থাকা শাহীন বাগে নিজের শিশু-সন্তানদেরও নিয়ে এসেছেন কিছু নারী। সেখানে তারা কম্বলের স্তুপের নিচে তাঁবু টানিয়ে শীত নিবারণ করছেন।

শাহীন বাগের ৩৩ বছর বয়সী সায়মা নামের এক নারী তার শিশু সন্তানকে এক গ্লাস দুধ পান করাতে করাতে বললেন, আমি দেখতে পাচ্ছি, আমার শিশুদের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। মা হিসাবে তাদের ভবিষ্যৎ বাঁচাতে আমি এখানে প্রতিবাদ জানাতে এসেছি। আমাদের অধিকার আমাদের দেয়া উচিত। এবং এটি শুধুমাত্র আমার লড়াই নয়। এটি সংবিধান রক্ষারও লড়াই। দলিলের অভাবে দেশজুড়ে অসংখ্য ভারতীয় সমস্যার মুখোমুখি হবেন।

তিনি বলেন, শাহীন বাগে যাওয়ার জন্য তিনি বাঁচ্চাদের ঘুম পাড়িয়ে তারপর সেখানে গিয়ে প্রতিবাদে অংশ নেন। জীবনে প্রথমবারের মতো তিনি এ ধরনের কোনো প্রতিবাদে অংশ নিচ্ছেন বলে জানান। আবার যে নারীরা তাদের বাচ্চাদের বাড়িতে রেখে আসতে পারেননি; তারা সন্তান-সহ বিক্ষোভে অংশ নিয়েছেন।

এক বছর বয়সী মেয়েকে নিয়ে বিক্ষোভে অংশ নিয়েছেন ২৪ বছর বয়সী সাজিদা খান। তিনি বলেন, আমি ২০১৪ সালে জামিয়া মিলিয়া থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক সম্পন্ন করেছি। জামিয়ায় ধর্মের ভিত্তিতে কোনো ধরনের বৈষম্য নেই…প্রথমবারের মতো সেখানে এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটছে এবং আমি এটির ঘোরবিরোধী।

নারীদের নেতৃত্বে দিল্লির শাহীন বাগের এই বিক্ষোভে অংশগ্রহণকারীদের খাবার কিংবা শীতের কাপড় সরবরাহ করছেন স্থানীয়রা। বিক্ষোভে অংশগ্রহণকারীদের শীত নিবারণের জন্য কম্বল কিংবা অন্যান্য প্রয়োজনীয় সব সামগ্রী টুইটারে সংগ্রহ করছেন অনেকেই।

৯০ বছর বয়সী আসমা খাতুন প্রত্যেকদিন বিকেল ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত শাহীন বাগের এই বিক্ষোভে অংশ নেন। তিনি বলেন, আমরা আমাদের সব ভাই-বোন এবং সংবিধানের জন্য লড়াই করছি। যারা আমার কাছে প্রমাণ চান, আমি তাদের বলতে চাই, আপনার পূর্বপুরুষদের নাম কী ছিল, সেটা আমাতে দেখাতে পারবেন? আমি আপনাকে আমার সর্বশেষ সাত প্রজন্মের নাম দেখাতে পারি যারা এখানে বাস করতেন।

মঙ্গলবার মধ্যরাতে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে যখন জমকালো আয়োজনে নববর্ষ বরণের আয়োজন করা হয়; তখন নয়াদিল্লির এই অংশ নারীদের নেতৃত্বে জেগে ছিল প্রতিবাদ বিক্ষোভে। নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে তাদের আয়োজিত এই বিক্ষোভে অনেকের হাতে ভারতীয় পতাকা দেখা যায়। অন্যদের হাতে ছিল নাগরিকত্ব আইনের বিরোধিতায় লেখা প্ল্যাকার্ড।

ঘড়ির কাঁটা যখন বারোটার ঘরে পৌঁছায়, তখন শাহীন বাগের শত শত নারী পুরুষের সমবেত কণ্ঠে ভেসে উঠে দেশটির জাতীয় সংগীত।

ভারতের ক্ষমতাসীন হিন্দুত্ববাদী সরকার গত ১১ ডিসেম্বর পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় বিতর্কিত নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন পাসের পর দেশটিতে ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয়। ২০১৪ সালে দেশটিতে ক্ষমতায় আসার পর এমন তীব্র বিক্ষোভ এবং বিরোধিতার মুখে প্রথমবারের মতো পড়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।

আইনে বলা হয়েছে, ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের আগে প্রতিবেশী বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং আফগানিস্তান থেকে ভারতে যাওয়া হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, পার্সি এবং জৈন সম্প্রদায়ের সদস্যরা সে দেশের নাগরিকত্ব পাবেন। তবে এ আইনে মুসলিম শরণার্থীদের ব্যাপারে একই ধরনের বিধান রাখা হয়নি।

সমালোচকরা বলেছেন, ক্ষমতাসীন হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকার ধর্মনিরপেক্ষ প্রজাতন্ত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ভারতে বিভাজন তৈরি করতে এ নতুন নাগরিকত্ব আইন তৈরি করেছে; যা ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিকে দুর্বল করে দিয়েছে।

বিতর্কিত এ আইনে মুসলিম শরণার্থীদের নাগরিকত্বের ব্যাপারে কিছু না বলায় ভারতজুড়ে তীব্র প্রতিবাদ-বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। তবে বিক্ষোভের দাবানল বেশি ছড়িয়ে পড়েছে দেশটির সরকারি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে। বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে এখন পর্যন্ত অন্তত ২৫ জনের প্রাণহানি ঘটেছে।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *