মিলেনিয়ালদের হাতেই চলছে সমাজের ভাঙা-গড়া। প্রযুক্তির উল্লম্ফন থেকে শুরু করে সামাজিক সংগঠন, মূল্যবোধ, অর্থনীতির স্বরূপ ও গতিপ্রকৃতি সবই পাল্টে দিচ্ছে এ প্রজন্ম। অতি আশ্চর্য (!) এ প্রজন্মের নারী-পুরুষের বয়স এখন ২৪-৩৯ বছর। এদের হাতেই গড়ে উঠছে তথাকথিত শেয়ার্ড ইকোনমি (অংশীদারিত্বের অর্থনীতি)। প্রচলিত মালিকানা নিয়ে প্রতিষ্ঠিত সামাজিক ধ্যানধারণা তাদের কাছে আবেদন হারিয়ে ফেলছে। প্রতিশ্রুতিকে তারা ভাবছে শিকলে আবদ্ধ থাকার নামান্তর। এই মিলেনিয়ানরা টাকা দিয়ে কিনছে ‘অভিজ্ঞতা’। স্থায়ী মালিকানার কোনো অর্থ নেই তাদের কাছে। এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় হচ্ছে আসবাবপত্র থেকে শুরু করে সেলফোন ভাড়া দেয়ার বাণিজ্য।
বাংলাদেশে স্থানীয়ভাবে বিয়ের পোশাক, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠান, এয়ারকন্ডিশনার (এসি) ভাড়া দেয়ার ব্যবসা বেশ পুরনো। তবে ভারতে এখন রীতিমতো অ্যাপভিত্তিক বাণিজ্য শুরু হয়ে গেছে। ফারলেঙ্কো, রেন্টোমজো, গ্র্যাব অন রেন্টের মতো বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান জীবনযাপনের যাবতীয় জিনিসপত্র অনেক কম টাকায় ভাড়া দিয়ে থাকে। অনেক প্রতিষ্ঠান আবার বিনামূল্যে জিনিসপত্র স্থানান্তরের সুবিধাও দেয়।
সম্প্রতি এ নিয়ে বার্তা সংস্থা এএফপি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে মুম্বাইয়ের স্পন্দন শর্মা নামে ২৯ বছর বয়সী এক তরুণ জানান, তার নিজের ফ্ল্যাট, গাড়ি এমনকি একটি চেয়ারও নেই। ভারতের মিলেনিয়ালদের মধ্যে তার মতো লোকের সংখ্যা বাড়ছে। তারা প্রচলিত ধারণাকে ভেঙে চুরমার করে দিচ্ছে। কেনার চাইতে ফার্নিচার থেকে আইফোন পর্যন্ত ভাড়ায় ব্যবহার করছে।
স্পন্দন শর্মা প্রতি মাসে ৪ হাজার ২৪৭ রুপির বিনিময়ে তার ঘর সাজিয়েছেন। সেখানে আসবাবপত্র, ফ্রিজ, মাইক্রোওয়েভ ওভেন থেকে শুরু করে সব কিছুই ভাড়ায় নেয়া। স্পন্দনের বাবা একটি সরকারি ব্যাংকে চাকরি করার সময় একটি ফ্ল্যাট ও গাড়ি কেনার জন্য একটু একটু করে টাকা জমাতেন। কিন্তু শর্মা তার জীবনটাকে অন্যভাবে দেখতে শিখেছেন।
‘অভিজ্ঞতায় বিনিয়োগে’ বিশ্বাসী তিনি। মাত্র সাত বছরের মধ্যে তার দুটি দেশের পাঁচটি শহরে নিজের থাকার একটা জায়গা আছে। এটা তার বাবার ক্ষেত্রে অচিন্তনীয় ছিল। কিন্তু শর্মার জন্য এটাই এখন বাস্তবতা।
শুধু বাসা বাড়ির জন্যই নয়, মিলেনিয়ালরা অফিসের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রও ভাড়ায় নিচ্ছে। এমনটাই জানিয়েছেন উদীয়মান উদ্যোক্তা বন্দিতা মোরারকা। ২০১৭ সালে নারী অধিকার বিষয়ক অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ‘ওয়ান ফিউচার কালেক্টিভ’ প্রতিষ্ঠা করেন ২৫ বছর বয়সী বন্দিতা। তিনি তার অফিসের প্রায় সবকিছুই ভাড়ায় নিয়েছেন। সেখানে টেবিল চেয়ার থেকে শুরু করে ল্যাপটপ পর্যন্ত ভাড়া নেয়া। তিনি বলেন, এতে করে প্রচুর বিনিয়োগের টাকা বাঁচিয়ে তিনি ২৫ জন স্টাফকে ঠিকমতো বেতন দিতে পারছেন। বন্দিতা বলেন, এই সিস্টেমটি আমাকে আরও বেশি ঝুঁকি নেয়ার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। আমাদের যদি কখনো অফিস পরিবর্তন করে দূরে কোথাও যেতে হয় তাহলে নতুন করে মোটা অংকের টাকা বিনিয়োগের দরকার পড়বে না। তাছাড়া জিনিসপত্র বয়ে নিয়ে যাওয়ার ঝক্কিও থাকছে না।
ব্যবসা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এটি এখন একটি অত্যন্ত সম্ভাবনাময় বাণিজ্য হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। তরুণরা এখন কোনো কিছুই কিনতে চাচ্ছে না। আর জিনিসপত্র শেয়ার করার ক্ষেত্রে তাদের প্রাচীনপন্থীদের মতো কোনো ছুৎমার্গও নেই।
বেঙ্গালুরু ভিত্তিক রেন্টোমজোর প্রতিষ্ঠাতা গীতাংশ বামনিয়া বলেন, তিনি আশা করছেন, ৩০ মাসের মধ্যে ১০ লাখ অর্ডার পাবেন। এ প্রতিষ্ঠানটি ঘর ও অফিসের আসবাবপত্র, গৃহস্থালি জিনিসপত্র, জিমের সরঞ্জাম, আইফোন এবং স্মার্ট হোম ডিভাইস যেমন, গুগল হোম এবং অ্যামাজন ইকো এসবও ভাড়া দেয়। বামনিয়া বলেন, ভাড়ায় স্মার্টফোন পাওয়ায় তরুণদের জন্য সুবিধা হয়েছে। তারা অনেক কম খরচে বাজারে আসা সর্বশেষ প্রিমিয়াম ডিভাইসটির অভিজ্ঞতা নিতে পারছে।
২০১২ সালে ফারলেঙ্কো প্রতিষ্ঠা করেন বিনিয়োগ ব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তা অজিত করিম্পানা। কোম্পানিটির বর্তমান গ্রাহক সংখ্যা ১ লাখেরও বেশি। ২০২৩ সাল নাগাদ ফারলেঙ্কোর আয় ৩০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করছেন অজিত।
একাধিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান বলছে, যুক্তরাষ্ট্রে রেন্ট দ্য রানওয়ে এবং নুলির মতো ওয়েবসাইটগুলো ফ্যাশন সচেতন গ্রাহকদের পোশাক কেনার পরিবর্তে ভাড়া নিতে উৎসাহিত করে। চীনা গ্রাহকদের অ্যাপের মাধ্যমে ভাড়ায় বিএমডব্লিউ গাড়ি পাওয়ারও সুযোগ করে দেয়। বিদেশে এরকম প্রতিষ্ঠানে সফলতার দৃষ্টান্ত দেখে ভারতেও এ ব্যবসা ফুলে ফেঁপে উঠছে। ফার্নিচার থেকে হোম অ্যাপ্লায়েন্স এমনকি স্বর্ণালঙ্কারও এখন অ্যাপের মাধ্যমে ভাড়ায় পাওয়া যাচ্ছে।
পরামর্শক প্রতিষ্ঠান প্রাইসওয়াটারহাউসকুপার্সের (পিডব্লিউসি) হিসাবে, ২০২৫ সাল নাগাদ অ্যাপভিত্তিক জিনিসপত্র ভাড়া দেয়ার ব্যবসার বার্ষিক রাজস্ব দাঁড়াবে ৩৩ হাজার ৫০০ কোটি ডলার। আরেক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান রিসার্চ নেস্টারের হিসাবে, ২০২৫ সাল নাগাদ ভারতে শুধু আসবাবপত্র ভাড়ার বাজার হবে ১৮৯ কোটি ডলার।