সিলেটে ফের আলোচনায় ‘জঙ্গি’


 নতুন করে ‘জঙ্গি আতঙ্ক’ দেখা দিয়েছে সিলেটে। অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিট নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন ‘আল্লাহর দল’র ৯ জঙ্গিকে গ্রেফতারের পর বিষয়টি নিয়ে নতুন করে ভাবছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও। জঙ্গিবাদ ঠেকাতে নজরদারি বাড়ানোর চিন্তাও করছে তারা।

জানা গেছে, গত বুধবার (২৯ জানুয়ারি) দিবাগত রাত সাড়ে ১০টার দিকে নগরীর শাহপরান থানাধীন আরামবাগের ১নং রোডের ১৭নং বাসার নিচ তলার একটি ফ্ল্যাটে অভিযান চালায় অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিট। অভিযানে গ্রেফতার করা হয় ৯ জনকে। বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলন করে পুলিশ জানায়, গ্রেফতারকৃতরা নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন ‘আল্লাহর দলের’ সদস্য।

গ্রেফতারকৃতরা হলেন- বগুড়া জেলার বড়কুমিড়া গ্রামের মৃত আব্দুল মান্নান আকন্দের ছেলে মানিক আকন্দ ওরফে মেহেদী হাসান (৩২), নোয়াখালী জেলার কৃষ্ণপুর গ্রামের আবুল কালামের ছেলে জহির উদ্দিন বাবর (২০), সিলেটের জকিগঞ্জ জেলার মাননিক পুর গ্রামের মৃত মোকাদ্দেস আলীর ছেলে রাসেল আহমেদ (২৪), কুমিল্লা জেলার রাজমঙ্গলপুর গ্রামের আব্দুল আলীর ছেলে আবুল কালাম অঅজাদ ওরফে কালাম (২০), সিলেটের জকিগঞ্জ জেলার খাফনা ঈদগাহ বাজার গ্রামের মুক্তাদির মিয়ার ছেলে কামাল আহমদ (২৫), সুনামগঞ্জ জেলার শাহপুর গ্রামের আব্দুল আজিজের ছেলে তমি উদ্দিন সুমন (৩০), রাজশাহী জেলার চেওখালী গ্রামের কায়েম উদ্দিনের ছেলে আশরাফুল ইসলাম (২৯), সিলেটের জালালাবাদ থানাধীন হায়দরপুর গ্রামের আব্দুস সালামের ছেলে জুয়েল আহমদ (২৪) এবং সিলেটের গোলাপগঞ্জের নলুয়া গ্রামের আলাউদ্দিনের ছেলে স্বপন আহমেদ (২১)।

পুলিশ জানায়, মেহেদী হাসান ‘আল্লাহর দলের’ সিলেট বিভাগীয় প্রধান, জহির উদ্দিন বাবার সংগঠনের ‘দাওয়া’ বিভাগের প্রধান এবং রাসেল আহমদ সিলেট জেলার প্রধান। বাকিরা বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করছিলেন। পুলিশ তাদেরকে আদালতের মাধ্যমে ৫ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে।

জানা গেছে, এই ৯ জঙ্গি গ্রেফতারের পর সিলেটে জঙ্গিবাদের বিষয়টি নিয়ে নতুন করে ভাবছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। নগরীর বাসা-বাড়ির দিকে দেওয়া হচ্ছে নজর। বাড়ানো হচ্ছে সতর্কতা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার জেদান আল মুসা সিলেটভিউকে বলেন, ‘জঙ্গিবাদ ঠেকাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সতর্ক রয়েছে। আমাদের নজরদারির ফলে ৯ জঙ্গি গ্রেফতার হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘নগরীর কোনো বাসা-বাড়িতে যাতে জঙ্গিরা বসবাস করতে না পারে, সেদিকে আমাদের নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। বাসা-বাড়িতে কারা আসছেন, কারা যাচ্ছেন তথা ভাড়াটিয়াদের তালিকা পুলিশ নিয়মিত সংগ্রহ করছে, হালনাগাদ করা হচ্ছে।’

জানা গেছে, সিলেটে ‘জঙ্গি’ বিষয়টি সর্বপ্রথম ব্যাপকভাবে আলোচিত হয় ২০০৬ সালে। অবশ্য এর আগের বছর, ২০০৫ সালের ১৭ই আগস্ট সিলেটসহ সারাদেশে একযোগে বোমা হামলা চালিয়ে জঙ্গিরা নিজেদের শক্ত অবস্থানের জানান দিয়েছিল। ওই হামলার পরই নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জামা’আতুল মুজাহিদিনের প্রধান শায়েখ আবদুর রহমান আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ তালিকায় চলে আসেন। আত্মগোপনে থাকা আবদুর রহমান গোপন ঘাঁটি গাড়েন সিলেট নগরীর পূর্ব শাপলবাগারে ‘সূর্যদীঘল’ বাড়িতে। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তার অবস্থান শনাক্ত করতে সক্ষম হয়।

জানা গেছে, ২০০৬ সালের ১ মার্চ দিবাগত রাতে সূর্যদীঘল বাড়ি ঘিরে ফেলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ওইদিন সকালে বাড়ি থেকে আবদুর রহমানের স্ত্রী-সন্তানরা বেরিয়ে এলে তাদেরকে গ্রেফতার করা হয়। ২ মার্চ ভোরে বাড়ির ভেতর চূড়ান্ত অভিযান শুরু হয়। রক্তপাতহীন ওই অভিযানে গ্রেফতার করা হয় আবদুর রহমান, তার সহযোগী মাজেদুল ইসলাম হৃদয় ও আবদুল আজিজকে। পরে সূর্যদীঘল বাড়ি থেকে ছোট আকারের একটি বোমা ও দুই কেজি অ্যালুমিনিয়াম উদ্ধার করা হয়।

‘অপারেশন সূর্যদীঘল বাড়ি’র পর দীর্ঘদিন সিলেটে জঙ্গি নিয়ে আতঙ্ক ছিল না। সেই আতঙ্ক বহুগুণে বেড়ে গিয়ে সামনে আসে ২০১৭ সালে। ওই বছরের ২৩ মার্চ রাতে সিলেটের দক্ষিণ সুরমার শিববাড়িস্থ ‘আতিয়া মহল’ নামের বাসাটি ঘিরে ফেলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পরদিন সকাল হতেই সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে, সিলেটে খোঁজ মিলেছে জঙ্গি আস্তানার। পুলিশ, র‌্যাব, পিবিআই, সিটি এসবি, ডিবিসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ঘেরাওয়ের মধ্যে পড়ে আতিয়া মহল। একপর্যায়ে পুলিশের স্পেশাল উইপন্স এন্ড ট্যাকটিক্স (সোয়াট) টিমও আসে ঘটনাস্থলে। ২৪ মার্চ রাতে ঘটনাস্থল পর্যবেক্ষণ করে সেনাবাহিনীর কমান্ডো দল। ২৫ মার্চ সকাল থেকে শুরু হয় সেনাকমান্ডোদের ‘অপারেশন টোয়াইলাইট’ নামক দুঃসাহসিক অভিযান। ২৭ মার্চ সেনাবাহিনী অভিযান সমাপ্ত ঘোষণা দিয়ে জানায়, ‘অভিযানে চার জঙ্গি নিহত হয়েছে। তন্মধ্যে তিন জন পুরুষ, একজন মহিলা।’

এদিকে, আতিয়া মহলে জঙ্গিবিরোধী অভিযান চলাকালে বাইরে বোমা বিস্ফোরণে পুলিশ কর্মকর্তাসহ ৭ জন নিহত হন।

আতিয়া মহলের অভিযানের পর সিলেটে জঙ্গিবিরোধী নজরদারি জোরদার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তাদের তৎপরতায় শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জঙ্গিবাদে জড়িত থাকার অভিযোগে একাধিক শিক্ষার্থীকে গ্রেফতার করা হয়।