‘প্রেম করায় সিঙ্গেল কমিটি থেকে বহিষ্কার’ শিরোনামের বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবর গত কয়েকদিন ফেসবুকে শেয়ার হতে দেখলাম। দেশের প্রথম সারির কয়েকটি সংবাদ প্রতিষ্ঠানও এর মধ্যে রয়েছে। রীতিমতো আমি স্তম্ভিত হয়েছি আমাদের গণমাধ্যমগুলোর অবস্থা ও অবস্থান দেখে। এটা নিয়ে কথা বলার রুচিবোধ ছিল না বলে এড়িয়ে গেছি।
কিন্তু আরও হতবাক হলাম ‘১৪ ফেব্রুয়ারি-ভালোবাসা দিবসে’ সিঙ্গেল পরিষদ ব্যানারে নামা শিক্ষার্থীদের অশালীন স্লোগানে মুখরিত মিছিলের খবর বিভিন্ন মিডিয়াকে ফলাও করে প্রচার করতে দেখে। যেখানে ‘১৪ ফেব্রুয়ারি‘র একটি গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস রয়েছে আমাদের। দেশের প্রথম সারির কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী দ্বারা এমন নোংরামির ঘটনা ঘটেছে, যেটা প্রচার করতে স্বনামধন্য অনেক মিডিয়া ছুটে গেছে ক্যাম্পাসগুলাতে।
এই দিনে ‘স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস’ পালন করতে ক্যাম্পাসে মিছিল সমাবেশ করেছেন প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীরা। কিন্তু সেটা বাদ দিয়ে নিউজের শিরোনাম হয়েছে ‘সিঙ্গেল পরিষদের’ অশালীন স্লোগানের মিছিল। যদি নিউজের লক্ষ্য থাকত-বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব শিক্ষার্থীরা উন্নত, রুচিশীল চিন্তার অধিকারী হওয়ার কথা, সমাজ ও রাষ্ট্রের সমস্যা-সঙ্কট ও উত্তরণের পথ নিয়ে ভাববার কথা; সেইসব শিক্ষার্থীরা কেন চিন্তাশক্তিতে এতটা স্থূলদর্শী হয়ে উঠলো! এতটা বোধশক্তিহীন হয়ে উঠলো, এর সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রভাব কি সেটা- তাহলে কোন কথা ছিল না; বরং তা প্রশংসারই দাবিদার ছিল।
কিন্তু আমাদের মিডিয়াগুলোর ক্ষেত্রে তা ঘটেনি। বরং নিউজ পড়ে বা দেখে মনে হলো তারা শিক্ষার্থীদের কুরুচিপূর্ণ, অশালীন স্লোগানে মুখরিত এমন নোংরামিকে প্রমোট করেছেন, তাদের উৎসাহ দিয়েছেন।
এখন ‘যা ঘটে তাই নিউজ’ এমন সংজ্ঞায়নের ভিত্তিতে যদি কেউ বলেন, শিক্ষার্থীরা মিছিলে নেমেছে, এটা একধরনের আন্দোলন। আমরা কাভার করেছি মাত্র। তাহলে এটাও আপনাদের জেনে নিতে হবে-কথিত সিঙ্গেলদের এই আন্দোলন কাদের বিরুদ্ধে, তাদের দাবি বা আবেদন কার কাছে, এবং এই দাবির প্রেক্ষিতে কর্তৃপক্ষের মন্তব্য কি।
‘কেউ খাবে কেউ খাবে না, তা হবে না তা হবে না’, ‘টাকা দিয়ে গাভী কেন কিনব, ‘কাপল ধর, সিঙ্গেল কর’”-এসব আন্দোলনকারীদের স্লোগান! কি নোংরা! ভাবতেই অবাক লাগে!
মিছিলে নামা শিক্ষার্থীদের এসব স্লোগানের মানে কি, এসব দাবি কার কাছে-নিউজ কাভার করা সাংবাদিকরা কি তা জানতে পেরেছেন বা চেয়েছেন? সিঙ্গেল পরিষদের এমন মিছিলকে আমরা হাসির ছলে উড়িয়ে দিয়েছি প্রতিবছরই, কিন্তু এটা শঙ্কার বিষয় হয়ে উঠে তখন, যখন দেশের মিডিয়া এমন হাস্যকর বিষয় নিয়ে খবর প্রচার করে।
সংবাদপত্র হচ্ছে সমাজের দর্পণ। মানুষকে সেই দর্পণের মুখোমুখি দাঁড় করান সাংবাদিকরা। সেই মহান কাজ সাংবাদিকদের কীভাবে করতে হয়? প্রকাশিত প্রতিটি সংবাদের একটি উদ্দেশ্য থাকতে হয়, যে সংবাদ পড়ে তথ্যের বাইরে সামজের মানুষ তার করণীয় সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। এর জন্য সাংবাদিকতায় বিশেষজ্ঞ হওয়ার দরকার নাই, বুদ্ধদেব বসুর ‘সাহিত্য ও শিল্প’ বিষয়ক প্রবন্ধগুলো পড়লেই সহজে বোঝা যায়। কিন্তু কর্পোরেটের আদলে গড়ে ওঠা আমাদের মিডিয়াগুলো নিজেদের টিআরপি, প্রচার সংখ্যা বাড়াতে বেশি ব্যস্ত; যেখানে সংবাদের চেয়ে বিজ্ঞাপনের গুরুত্ব বেশি।
আমি জানিনা সাংবাদিকরা এমন খবর নিজ থেকে উৎসাহ নিয়ে করেছেন নাকি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের চাপে পড়ে করেছেন। কিন্তু যেভাবেই হোক না কেন এর দায় সাংবাদিকদেরই। সংবাদ প্রতিষ্ঠান ও সাংবাদিকদের ভূমিকার বাইরে ভালোবাসা দিবসে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীদের মনোজগতের যে দৈন্যদশা প্রতীয়মান হচ্ছে তার কারণ কি?
যেসব শিক্ষার্থীরা মিছিল করেছে, নোংরা স্লোগান দিয়েছে, হয়তো তারা এটা চিন্তা করে করেনি, নিছক মজা করে করেছে। কিন্তু এর মাধ্যমে যে একটা অসুস্থ সংস্কৃতিকে গড়ে তোলা হচ্ছে তা তারা কখনও ভাবেনি। ভাবেনি এমন স্লোগানে তাদেরই সহপাঠীদের সম্পর্কে নোংরা মনোভাবের পরিচয় প্রকাশ পাচ্ছে।
ব্রিটিশ শাসনাধীন সময়ে মেকলে তার প্রণীত শিক্ষানীতি সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘ভারতীয়দের এমনভাবে তৈরি করা হবে, যাতে তারা রক্তমাংসে হবে ভারতীয়, চিন্তাশক্তিতে হবে ব্রিটিশদের মতো।’ মূলত মেকলে তার প্রণীত শিক্ষানীতিতে ভারতীয়দের চিন্তাশক্তিতে শূন্য করে তোলার পরিকল্পনা নিয়েছিলেন।
কিন্তু আমাদের অবস্থা হয়েছে মেকলের পরিকল্পনার থেকে আরও বেশি খারাপ। ভালোবাসা দিবসে আমরা যে নোংরামি করি, নিজেদের ইতিহাস-ঐতিহ্যকে অপমান করি, ইউরোপে তার কোন কিছুই হয় না।
২৬৯ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারি রোম নগরীর সেন্ট ভ্যালেন্টাইন নামক ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ডের পর তার স্মরণে পোপ সেন্ট জেলাসিউও ৪৯৬ সালে এ দিনটিকে ভ্যালেন্টাইন’ দিবস ঘোষণা করেন। এ দিনটিকে উদযাপন করতে আমাদের তরুণ প্রজন্মের দৃষ্টির আড়াল হয়েছে নিজেদের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস।
আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি হয়েছে,হচ্ছে ঠিক; কিন্তু উপনিবেশিক চিন্তা থেকে এখনও আমরা বের হয়ে আসতে পারিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বোধশক্তি লোপ, অনুভূতি ভোঁতা হওয়ার কারণ এটাই। এ কারণেই তারা নিজেদের ইতিহাস-ঐহিত্যকে ভুলতে বসেছে।
১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি এরশাদ সরকারের শাসনামলে তৎকালীন মজিদ খান শিক্ষা কমিশনের শিক্ষা সংকোচন ও বাণিজ্যিকিকরণের নীতির বিরুদ্ধে ছাত্রদের ডাকা ধর্মঘটে পুলিশ গুলি চালালে প্রাণ হারান আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের অনেকেই।
তখন থেকে এই দিনটি ‘স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে পালন হয়ে আসছে। আজ এ দিনটিকে সবচেয়ে বেশি স্মরণ করার কথা ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের, কিন্তু সে ইতিহাস ভুলে আজ তারা ক্যাম্পাসে করছে লুঙ্গি মিছিল, তাদের মুখের স্লোগান হয়েছে সহপাঠীদের কটাক্ষ করে অশালীন, কুরুচিপূর্ণ শব্দাবলী।
আমাদের ছাত্র সমাজের এমন দৈন্যদশার কারণ কি? তাদের এমন অন্তঃসারশূন্য অবস্থার জন্য দায়ী কে? সে প্রশ্নের উত্তর আমাদের খুঁজতে হবে। এর থেকে উত্তরণের পথ বের করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী’ হয়ে উঠতে হবে। সাংবাদিকদের হয়ে উঠতে হবে ‘সাংবাদিক’। গণমাধ্যমগুলোকে হয়ে উঠতে হবে সমাজের দর্পণ, রুগ্ন সমাজ নির্দেশিত পথে না চলে হতে হবে সমাজের পথপ্রদর্শক।
ভালোবাসা দিবসকে কেন্দ্র করে যে অসুস্থ সংস্কৃতি গড়ে উঠছে আমাদের দেশে, তার অপসারণে গণমাধ্যমকেই ভূমিকা রাখতে হবে। তা না হলে সমাজের রুগ্নতা, মানসিক অসুস্থতা বেড়েই চলবে।