সিলেটে শ্বাসরুদ্ধকর ম্যাচে বাংলাদেশের জয়


রফিকুল ইসলাম কামালস্টেডিয়াম থেকে :: সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামের প্রেসবক্সে সাংবাদিকদের তুমুল ব্যস্ততা। ২২৫ রানে জিম্বাবুয়ে হারিয়ে ফেলেছে ৭ উইকেট। জিততে হলে ৪৯ বলে প্রয়োজন ৯৭ রান। নিচের দিকের ব্যাটসম্যান, যারা মূলত বোলার, তাঁরা ব্যাটিংয়ে। জিম্বাবুয়ে তাই ম্যাচ ‘হারছে’, এমনটা ধরে নিয়েই সম্ভাব্য ম্যাচ রিপোর্ট তৈরির কাজে লেগে গেছেন সাংবাদিকরা।

কিন্তু সাংবাদিকদের হাতকে থামিয়ে দিলেন টিনোটেন্ডা মুতুমবডজি আর ডোনাল্ড তিরিপানো। ঝড়ো ব্যাটিংয়ে বাংলাদেশের বুকে কাঁপন ধরাতে লাগলেন তাঁরা। ম্যাচের ফলাফল কী হয়, এমন দোলাচলে সাংবাদিকরাও শেষটা দেখার অপেক্ষায় মন্ত্রমুগ্ধের মতো চেয়ে রইলেন।

শেষমেশ সেই ঝড় থামলো মুতুমবডজির বিদায়ে। ইনিংসের শেষ ওভারে আল আমিনের দ্বিতীয় বলে লং অনে লিটন দাসের হাতে ক্যাচ দিয়ে শেষ হয় তাঁর ২১ বলে ৩৪ রানের ক্যামিও। মারেন ৫টি চার। তাঁর বিদায়ে ভাঙে ৪৫ বলে ৮০ রানের দুর্ধর্ষ জুটি।

কিন্তু টিনোটেন্ডা তিরিপানো যে তখনো ছিলেন! ছক্কার ঝড়ে আল আমিন, শফিউলদের বল বাউন্ডারের উপর দিয়ে বাইরে ফেলছিলেন তিরিপানো। মুতুমবডজির ফিরে যাওয়ার পরের বলেই আল আমিনকে লং অন দিয়ে মারেন ছয়। পরের বলেও আবারও লং অন দিয়ে ছক্কা! ২৬ বলে তুলে নেন ফিফটি।

শেষ ওভারে জয়ের জন্য জিম্বাবুয়ের দরকার ছিল ২০ রানের। শেষ দুই বলে সেটা নেমে আসে ৬ রানে। মাশরাফি আর মাহমুদউল্লাহ মিলে আল আমিনকে প্রায় মিনিটখানেক দিলেন পরামর্শ। পঞ্চম বলে শর্ট আর বাউন্সার। ব্যাট ছোঁয়াতে পারলেন না তিরিপানো। শেষ বলের উত্তেজনা তখন। লেন্থ বল ছিল, লং অফে ঠেলে এক রানের বেশি নিতে পারলেন না তিরিপানো।

তাঁর ২৭ বলে ৫টি ছয় আর ২টি চারে করা অপরাজিত ৫৪ রানের ইনিংসও জেতাতে পারলো না জিম্বাবুয়েকে। শ্বাসরুদ্ধকর ম্যাচ ৪ রানে জিতে নিয়ে সিরিজ নিশ্চিত করেছে মাশরাফি বিন মুর্তজার দল। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে বাংলাদেশের এটা টানা ১৫তম জয়!

একদিনের ব্যবধানে জিম্বাবুয়ে বেশ উন্নতি করেছে ব্যাটিংয়ে। রোববার, সিরিজের প্রথম ম্যাচে সফরকারীরা করেছিল ১৫২ রান। আজ মঙ্গলবার করলো ৩১৮। জিম্বাবুয়ে চাইলে এই হার থেকেও স্বান্ত্বনা খোঁজে নিতে পারে। প্রথম ম্যাচে তাঁরা যেখানে ১৬৯ রানের বড় ব্যবধানে হারে, আজ সেখানে হেরেছে মাত্র ৪ রানে। হারের ব্যবধান অনেক কমেছে, অসহায় আত্মসমর্পণ করেনি তাঁরা, লড়াই করেছে, এগুলো তাদেরকে শেষ ম্যাচে প্রেরণা যোগাবে নিশ্চিতভাবেই।

জিম্বাবুয়ের উন্নতির উদাহরণ কিন্তু আরো আছে। সিরিজের প্রথম ম্যাচে তাঁদের একজন ব্যাটসম্যানও ফিফটি পাননি। আজ ফিফটি করেছেন চারজন! আগামী শুক্রবার সিরিজের শেষ ম্যাচে নামার আগে জিম্বাবুয়ে নিশ্চয়ই এসব নিয়ে বিশ্লেষণ করবে, মরণকামড় দিতে চাইবে বাংলাদেশকে।

ম্যাচের শেষ দিকে জিম্বাবুয়ের আকস্মিক লড়াই বাদ দিলে এই দ্বিতীয় ম্যাচের রিপোর্ট কিন্তু পুরোটাই ‘তামিমময়’! কী এক ইনিংসই না খেলেছেন এই বাঁহাতি ওপেনার। তাঁর দেড়শ ছাড়ানো ইনিংসে ভর করে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ওয়ানডে ম্যাচে সর্বোচ্চ ইনিংস নতুন করে লিখলো বাংলাদেশ।

এদিন মন্থর ব্যাটিংয়ের খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এলেন তামিম ইকবাল। কার্যকর ইনিংস খেললেন মুশফিকুর রহিম, মাহমুদউল্লাহ। শেষদিকে ঝড় তুললেন মোহাম্মদ মিঠুন। তাতেই টানা দ্বিতীয় ম্যাচে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে তিনশ’ ছাড়ানো ইনিংস গড়লো বাংলাদেশ।

সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে মঙ্গলবার টসে জিতে ব্যাটিংয়ে নামে বাংলাদেশ। ৮ উইকেটে রান করে ৩২২। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ঠিক আগের ম্যাচে করা ৩২১ রান টপকে তাঁদের বিপক্ষে এটাই নতুন সর্বোচ্চ রানের ইনিংস।

প্রথম ম্যাচের মতো আজও বাংলাদেশের ব্যাটিং হয়েছে দুর্দান্ত। এ দিন সব আলো যেন কেড়ে নেন তামিম ইকবাল। গেল কিছুদিন ধরে এই বাঁহাতির মন্থর ব্যাটিং নিয়ে বেশ সমালোচনা হচ্ছিল। সব ছাপিয়ে তামিম খেললেন রেকর্ডগড়া এক ইনিংস। ১৩৬ বলে করলেন ১৫৮! ইনিংসে ছিল ২০টি চার, ৩টি ছয়। স্ট্রাইক রেট ১১৬.১৭! অথচ তাঁর এর আগের ১২ ইনিংসে স্ট্রাইক রেট ছিল মাত্র ৬৭.৬৯! জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে তো বটেই, যেকোনো দলের বিপক্ষে এটাই বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত ওয়ানডে ইনিংস। এর আগে ২০০৯ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে তামিমেরই করা ১৫৪ রান ছিল সর্বোচ্চ।

আজকের ইনিংসের ৮৪ রান নেওয়ার পথে তামিম বাংলাদেশের প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে ৭ হাজার রানের মাইলফলকে পৌঁছেন।

আজ শুরুতেই দুর্ভাগ্যজনক রানআউটে ফিরে যান আগের ম্যাচের সেঞ্চুরিয়ান লিটন দাস। ইনিংসের সপ্তম ওভারে কার্ল মুম্বার ৩য় বলে ড্রাইভ করেছিলেন তামিম। সেটি হাত দিয়ে ফেরানোর চেষ্টা করেন মুম্বা। কিন্তু ঠিকমতো তাঁর হাতে জমেনি বল। তাঁর হাতে লেগে বল ভেঙে দেয় নন-স্ট্রাইকিং প্রান্তের স্টাম্প। খানিকটা বাইরে থাকা লিটন (৯ রান) হন রানআউট।

লিটনের পর নাজমুল হোসেন শান্তও রানআউট হয়ে ফিরেন। ইনিংসের একাদশতম ওভারে ওয়েসলি মাধেভেরের দ্বিতীয় বলে শর্ট ফাইন লেগে ঠেলে দেন শান্ত। রান নেওয়ার ইচ্ছা ছিল না তাঁর। কিন্তু ছুটে আসেন তামিম। খানিক বাইরে থাকা শান্ত (৬) ওপ্রান্তে গিয়ে পৌঁছানোর আগেই বল ধরে উইকেট ভাঙেন মাধেভেরে।

৬৫ রানে দুই উইকেট হারানো বাংলাদেশ তৃতীয় উইকেট হারায় ১৫২ রানে। ফিরে যান মুশফিকুর রহিম। ওয়েসলি মাধেভেরের বলে সীমানায় মুতুমবডজির হাতে ধরা পড়ার আগে দারুণ ইনিংস খেলে যান এই উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান।

করেন ৫০ বলে ৬টি চারে ৫৫ রান। মুশফিকের বিদায়ে তামিমের সাথে তাঁর ৯২ বলে ৮৭ রানের জুটি ভাঙে।

তামিমের সাথে যোগ দিয়ে মাহমুদউল্লাহ ইনিংস বড় করছিলেন। তবে দলীয় ২৫৮ রানে বিদায় নেন মাহমুদউল্লাহ, অভিষিক্ত চার্লটন টিশুমার বলে ডিপ স্কয়ার লেগে মাধেভেরের দারুণ এক ক্যাচ হয়ে। ফেরার আগে তাঁর ব্যাট থেকে আসে ৫৭ বলে ৪১ রান। তামিমের সাথে ১০২ বলে ১০৬ রানের জুটি ভাঙে মাহমুদউল্লাহর বিদায়ে।

তামিম ইকবাল বিদায় নেন ইনিংসের ৪৬ ওভারের চতুর্থ বলে। কার্ল মুম্বার বলে লং-অফে মুতুমবডজির হাতে ধরা পড়ে শেষ হয় তাঁর দুর্দান্ত ইনিংসের।

মেহেদী হাসান মিরাজ (৫) ফিরে যান মুম্বার বলে বোল্ড হয়ে। সীমানায় তিরিপানোর বলে ক্যাচ দেন মাশরাফি (১)। তিরিপানো ফেরান তাইজুলকেও (০)। তবে মাহমুদউল্লাহর বিদায়ের পর ক্রিজে আসা মোহাম্মদ মিঠুন খেলেন ঝড়ো ইনিংস। তাঁর ১৮ বলে অপরাজিত ৩২ রানের ইনিংসে ছিল ৩টি চার আর একটি ছয়। শফিউল অপরাজিত থাকেন ৫ রানে।

বাংলাদেশ করে ৮ উইকেটে ৩২২। জিম্বাবুয়ের কার্ল মুম্বা ১০ ওভারে ৬৪ রানে ২টি, ডোনাল্ড তিরিপানো ৮ ওভারে ৫৫ রানে ২টি, মাধেভেরে ৭ ওভারে ৩৮ রানে ১টি ও চার্লটন টিশুমা ৫ ওভারে ৩৫ রানে ১টি উইকেট নেন।

রানের পাহাড় টপকানোর লক্ষ্যে জিম্বাবুয়ে হোঁচট খায় শুরুতেই। রেজিস চাকাভাকে (২) লিটনের হাতে ক্যাচ বানান একাদশে ফেরা শফিউল ইসলাম। বাংলাদেশের বিপক্ষে জিম্বাবুয়ের সফলতম ব্যাটসম্যান ব্রেন্ডন টেলরকে (১১) দুর্দান্ত এক রানআউটে থামান মিরাজ। চামু চিবাবার ইনজুরিতে অধিনায়কত্ব পাওয়া, একইসাথে একাদশে ফেরা শন উইলিয়ামস টিকলেন না বেশিক্ষণ। তাঁকে (১৪) এলবিডব্লিউর ফাঁদে ফেলেন মিরাজ।

এক প্রান্তে উইকেট পড়লেও অন্য প্রান্তে প্রতিরোধ গড়েছিলেন টিনাশে কামুনহুকামওয়ে। তাইজুলকে সুইপ করতে গিয়ে বোল্ড হয়ে ফিরে যান তিনিও (৭০ বলে ৫১)। ১০২ রানে জিম্বাবুয়ের ৪ উইকেট পড়ার পর বাংলাদেশকে কিছুটা অপেক্ষা করতে হয় পরের শিকারের জন্য। ওয়েসলি মাধেভেরে আর সিকান্দার রাজা গড়েন ৮১ রানে জুটি। সে জুটি ভাঙে তাইজুলের বলে এলবিডব্লিউ হয়ে মাধেভেরের (৫৭ বলে ৫২) বিদায়ে।

এর আগে অবশ্য দু’বার আউট হতে হতে বেঁচে যান মাধেভেরে। ২০১৫ সালের পর ওয়ানডে খেলতে নামা আল আমিন হোসেনের বলে স্লিপে মাধেভেরের ক্যাচ ছাড়েন নাজমুল হোসেন শান্ত। তখন ৯ রানে ব্যাট করছিলেন তিনি। পরে আল আমিনের বলেই আবার ৪৮ রানে জীবন পান মাধেভেরে। সুইপার কাভারে ডাইভ দিয়েও বল হাতে ছোঁয়ালে ক্যাচ নিতে পারেননি শফিউল।

খানিকটা আগ্রাসী হয়ে খেলতে থাকা রিচমন্ড মুতুম্বামিকে (১৭ বলে ১৯) এলবিডব্লিউর ফাঁদে পেলেন তাইজুল। দুর্দান্ত খেলতে থাকা সিকান্দার রাজাকে আশার বসতি গড়েছিল জিম্বাবুয়ে। ৪৮ বলে ফিফটি তুলে নেন এই অফ স্পিনিং অলরাউন্ডার। মাশরাফির এক ওভারে তিন বলের মধ্যে দুটি চার মারেন। ওভারের পঞ্চম বলে ছক্কায় উড়াতে গিয়ে থার্ডম্যানে মাহমুদউল্লাহর হাতে ক্যাচ দিয়ে বিদায় নেন রাজা (৫৭ বলে ৫টি চার আর ২টি ছয়ে ৬৬)।

এরপর টিনোটেন্ডা মুতুমবডজি আর ডোনাল্ড তিরিপানোর লড়াকু ব্যাটিংয়ের কথা শুরুতেই বলা হলো। তাঁদের বীরত্বের পরও জিম্বাবুয়ে থামলো ৮ উইকেটে ৩১৮ রানে। ৪ রানের হার। তিন ম্যাচের সিরিজে বাংলাদেশ এগিয়ে গেল ২-০ তে।

১০ ওভারে ৫২ রানে ৩ উইকেট নিয়ে ম্যাচে বাংলাদেশের সেরা বোলার তাইজুল ইসলাম। মাশরাফি ১০ ওভারে ৫২ রানে ১টি, মিরাজ ৭ ওভারে ২৫ রানে ১টি উইকেট নেন। ১টি করে উইকেট পেলেও শফিউল ১০ ওভারে ৭৬ রান আর আল আমিন ১০ ওভারে দেন ৮৫ রান।

দারুণ সেঞ্চুরিতে ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরস্কার ওঠে তামিম ইকবালের হাতে।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *