ঈমান, আমল ও ইহসানের নাম দ্বিন


মহান রাব্বুল আল আমিন সৃষ্টি করেছেন কুল কায়েনাত। সৃষ্টি করেছেন মানবকুল। প্রেরণ করেছেন নবী-রাসুল। শেষ জামানার মানুষের পথপ্রদর্শক হিসেবে পাঠিয়েছেন স্বীয় প্রিয় হাবিব মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে। দান করেছেন শ্রেষ্ঠ জীবন বিধান আল কোরআন। ঘোষণা করেছেন, ‘নিঃসন্দেহে আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য দ্বিন একমাত্র ইসলাম।’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ১৯)

ঈমান, আমল ও ইহসানের নাম দ্বিন

১. ঈমান : ঈমান অর্থ—শরিয়তের যাবতীয় হুকুম-আহকাম অন্তর দিয়ে বিশ্বাস করা এবং এগুলোকে নিজের দ্বিন হিসেবে বরণ করে নেওয়া। পরিপূর্ণ মুমিন সেই ব্যক্তি, যিনি শরিয়তের বিষয়গুলোকে গভীরভাবে বিশ্বাস করেন এবং এগুলোর মৌলিক স্বীকৃতিসহ বাস্তব জীবনে পূর্ণাঙ্গভাবে আমল করে চলেন।

ঈমানের মৌলিক বিষয়গুলো কোরআন ও হাদিসের বিভিন্ন স্থানে বর্ণিত আছে। ঈমানে মুফাস্সাল শীর্ষক বাক্যে সেই বিষয়গুলোর সহজ বর্ণনা পাওয়া যায়। যথা—‘আমান্তু বিল্লাহি, ওয়া মালা-ইকাতিহি, ওয়া কুতুবিহি, ওয়া রুসুলিহি, ওয়াল ইয়াওমিল আখিরি, ওয়াল কাদরি খাইরিহি ওয়া শাররিহি মিনাল্লাহি তাআলা, ওয়াল বা‘সি বা‘দাল মাওত।’ অর্থাৎ—আমি ঈমান আনলাম মহান আল্লাহর ওপর, তাঁর ফেরেশতাদের ওপর, তাঁর কিতাবগুলোর ওপর, তাঁর রাসুলদের ওপর, আখিরাতের ওপর, তাকদিরের ভালো-মন্দ সব কিছু আল্লাহর ইচ্ছায় হয়—এর ওপর ও মৃত্যুর পর পুনরুত্থিত হওয়ার ওপর। উল্লিখিত মৌলিক বিষয়গুলোর ওপর দৃঢ় বিশ্বাস ছাড়া কস্মিনকালেও ঈমান পরিপূর্ণ হবে না। যিনি এগুলোতে আন্তরিক বিশ্বাস রাখবেন তাঁকেই মুমিন বলা হবে।

 

২. আমল : আমল বিভিন্ন প্রকার রয়েছে : যথা—ইবাদত, মুআমালাত (লেনদেন), মুআশারাত (আচার-আচরণ), সিয়াসাত (রাষ্ট্রনীতি), ইকতিসাদিয়্যাত (অর্থনীতি), দাওয়াত ও জিহাদ ইত্যাদি।

ক. ইবাদত : ইবাদত চার প্রকার—নামাজ, রোজা, জাকাত ও হজ। পৃথিবীতে লোভ-লালসার মধ্যেও মানুষ যেন সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ রাব্বুল আল আমিনকে ভুলে না যায় তাই দৈনিক পাঁচবার নামাজ আদায় করার হুকুম দেওয়া হয়েছে। নিজের মধ্যে তাকওয়া ও সংযম অভ্যাস গড়ে তোলার জন্য বছরে এক মাস রোজা রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সামর্থ্যবান ব্যক্তি প্রতিবছর নিজ অর্থ-সম্পদ থেকে ৪০ ভাগের এক ভাগ এবং উৎপন্ন শস্যের ১০ ভাগের এক ভাগ অথবা ক্ষেত্রভেদে ২০ ভাগের এক ভাগ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য প্রদান করার বিধান রয়েছে। এমনিভাবে সামর্থ্যবান হলে আল্লাহর মহব্বতে মাতোয়ারা হয়ে জীবনে একবার হজ আদায় করার হুকুম রয়েছে।

খ. মুআমালাত বা লেনদেন : মুআলামাত তথা লেনদেনের ক্ষেত্রে আমানতদারি ও সততা ইসলামের বুনিয়াদি শিক্ষাগুলোর অন্যতম। কোরআন ও হাদিসের আলোকে বোঝা যায়, যে ব্যক্তি নিজের লেনদেন ও কাজ-কারবারে সত্যবাদী ও বিশ্বস্ত, অঙ্গীকারপূর্ণ করে, মানুষকে ধোঁকা দেয় না, আমানতের খেয়ানত করে না, মানুষের হক নষ্ট করে না, ওজনে কম দেয় না, মিথ্যা সাক্ষ্য দেয় না এবং সুদ-ঘুষসহ যাবতীয় অবৈধ রোজগার থেকে নিজেকে রক্ষা করে চলে, সেই প্রকৃত মুসলিম।

গ. মুআশারাত বা আচার-আচরণ : মুআশারাত তথা সামাজিক জীবনের আচার-আচরণে যাতে শিষ্টাচারের বহিঃপ্রকাশ ঘটে এবং মানুষ পরস্পর ভাই ভাই হিসেবে বসবাস করতে পারে, সে জন্য ইসলাম এ বিষয়ের প্রতিও বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছে। পরিবারে, সমাজে ছোট-বড়, ধনী-দরিদ্র, আপন-পর, নর-নারী সবার প্রতি কিরূপ ব্যবহার করতে হবে এ ক্ষেত্রেও ইসলামের বিধি-বিধান রয়েছে। একজন মুসলমানের জন্য তাও মেনে চলা আবশ্যক।

ঘ. সিয়াসাত বা রাষ্ট্রনীতি : ইসলাম যেহেতু পূর্ণাঙ্গ দ্বিন, তাই রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রেও ইসলাম নীতিমালা ঘোষণা করেছে। ইসলামে রাষ্ট্রনীতি ধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো বিষয় নয়। রাষ্ট্রের জনগণের মধ্যে ন্যায়ের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং চুরি, ডাকাতি, ব্যভিচার ও ইসলামী বিধি-বিধান প্রত্যাখ্যানকারীর শাস্তি প্রদান করা একান্ত আবশ্যক। দেশ-জাতির নিরাপত্তা বিধানের লক্ষ্যে সামরিক শক্তি অর্জনও প্রয়োজন।

ঙ. ইকতিসাদিয়্যাত বা অর্থনীতি : অর্থ উপার্জন ও ব্যয় এবং ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদি কিভাবে পরিচালনা করতে হবে এ ক্ষেত্রে মহান আল্লাহর বিধান মেনে চলা একান্ত জরুরি। অর্থনৈতিক জীবনে যাতে ভারসাম্য ক্ষুণ্ন না হয় সে জন্য শরিয়তের সীমা লঙ্ঘন করে আপন প্রবৃত্তি ও খেয়ালখুশি মোতাবেক উপার্জন ও ব্যয় করাকে ইসলামে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। হালাল-হারামের বিধান প্রবর্তন করা হয়েছে। শ্রমিকের মজুরি নিশ্চিত করা হয়েছে। গরিব যেন অনাহারে-অর্ধাহারে মারা না যায় সে জন্য জাকাত, উশর, খারাজ ইত্যাদির বিধান চালু করা হয়েছে। কেউ যেন অবৈধ উপার্জনের মাধ্যমে টাকার পাহাড় গড়ে তুলতে না পারে সে জন্য কঠোর নির্দেশ রয়েছে। আর্থিক বৈষম্য সৃষ্টিকারী শোষণমূলক সুদ প্রথাকে রহিত করা হয়েছে। আরো রহিত করা হয়েছে জুয়া, লটারি, কালোবাজারিসহ অবৈধ অর্থ উপার্জনের যাবতীয় পন্থা-পদ্ধতি।

চ. দাওয়াত ও জিহাদ : ইসলাম শাশ্বত জীবনব্যবস্থা। এ দ্বিনকে টিকিয়ে রাখতে হলে দাওয়াতের কোনো বিকল্প নেই। দাওয়াত মানে পথহারা মানুষকে আল্লাহর দিকে; সিরাতে মুস্তাকিমের দিকে আহ্বান করা। সব নবী-রাসুল দাওয়াতের আমল করেছেন। কোরআন ও হাদিসে এর বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। যারা অসৎ কাজে বাধা দেয় না, তাদের অভিশপ্ত বলা হয়েছে।

দাওয়াতের পাশাপাশি জিহাদও ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ আমল। জীবনের সর্বক্ষেত্রে দ্বিনের নির্দেশগুলো জিন্দা করা এবং ইসলামের অনুশাসন মেনে চলা যেমন একজন মুমিনের দায়িত্ব, তেমনি দ্বিনের হেফাজতের জন্য প্রয়োজনে জান-মাল উৎসর্গ করাও একান্ত কর্তব্য।

৩. ইহসান ও আধ্যাত্মিকতা : ইহসানের মূল বক্তব্য হলো—ক্রোধ, লোভ, মোহ, হিংসা-বিদ্বেষ, গিবত, অপবাদ, মিথ্যা অহংকার ইত্যাদি মন্দ স্বভাব থেকে পাক-পবিত্র থাকা এবং ইখলাস, আমানতদারী, বিনয় ও নম্রতা, সততা ও ন্যায়পরায়ণতা ইত্যাদি উত্তম চরিত্রের দ্বারা নিজেকে সুশোভিত করা।

আত্মাই দেহ পরিচালনা করে, দেহ আত্মাকে নয়। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই মানুষের শরীরে একটি গোশতের টুকরা আছে। তা ঠিক থাকলে গোটা শরীর সুস্থ থাকে। আর তা বিনষ্ট হলে গোটা শরীরই ব্যাধিগ্রস্ত হয়ে যায়। জেনে রাখো, ওই গোশতের টুকরাটি হলো মানুষের কলব বা আত্মা।’ (বুখারি, হাদিস : ৫২)

মানুষের নৈতিকতা ও আধ্যাত্মিকতার উন্নতি সাধন এমন এক গুরুত্বপূর্ণ কাজ, যার পূর্ণতা বিধানের উদ্দেশ্যে রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে নবী হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘সচ্চরিত্রের পূর্ণতা বিধানের জন্য আমি প্রেরিত হয়েছি।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ৮৯৫২)। মহান আল্লাহ আমাদের আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

লেখক : মুহাদ্দিস, জামিয়া আম্বরশাহ আল ইসলামিয়া, কারওয়ান বাজার, ঢাকা


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *