দুর্ভিক্ষ মোকাবেলায় ইউসুফ (আ.)-এর অপূর্ব ব্যবস্থাপনা


বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে গোটা বিশ্ব অচল হয়ে আছে। চির ব্যস্ত শহরগুলো যেন নীরবে কাঁদছে। কর্মহীন হয়ে পড়েছে লাখ লাখ মানুষ। এভাবে চলতে থাকলে বিশ্বব্যাপী দুর্ভিক্ষ নেমে আসার আশঙ্কা রয়েছে। যা মোকাবেলা করার প্রস্তুতি এখন থেকেই নেওয়া উচিত। অতীতেও বিভিন্ন জাতির ওপর বড় বড় দুর্ভিক্ষ এসেছে। সেই দুর্ভিক্ষ মোকাবেলায় তারা কী ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছিল, তা পবিত্র কোরআনে উল্লেখ রয়েছে।

হজরত ইউসুফ (আ.)-এর যুগে তৎকালীন মিসরের বাদশাহ একটি স্বপ্ন দেখলেন। অতঃপর বাদশাহ তাঁর সভাসদদের ডেকে স্বপ্নের ব্যাখ্যা জিজ্ঞেস করেন। কিন্তু কেউ জবাব দিতে পারলেন না। অবশেষে তাঁরা বাদশাহকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য বললেন, এগুলো ‘কল্পনাপ্রসূত স্বপ্ন’মাত্র। এগুলোর কোনো বাস্তবতা নেই। কিন্তু বাদশাহ তাতে স্বস্তি পান না। এমন সময় কারামুক্ত এক খাদেম বাদশাহর কাছে তার কারাসঙ্গী ও বন্ধু ইউসুফ (আ.)-এর কথা বলল। তখন বাদশাহ ইউসুফ (আ.)-এর কাছে স্বপ্নের ব্যাখ্যা জানার জন্য ওই খাদেমকে কারাগারে পাঠালেন। সে স্বপ্নব্যাখ্যা শুনে এসে বাদশাহকে সব বৃত্তান্ত বলল। বিষয়টি পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ এভাবে তুলে ধরেছেন, ‘বাদশাহ বলল, আমি স্বপ্নে দেখলাম, সাতটি মোটা-তাজা গাভি এদের সাতটি শীর্ণ গাভি খেয়ে ফেলছে এবং সাতটি সবুজ শিষ ও অন্যগুলো শুষ্ক। হে সভাসদবর্গ! তোমরা আমাকে আমার স্বপ্নের ব্যাখ্যা বলে দাও, যদি তোমরা স্বপ্নব্যাখ্যায় পারদর্শী হয়ে থাকো।’ ‘তারা বলল, এটি কল্পনাপ্রসূত স্বপ্নমাত্র। এরূপ স্বপ্নের ব্যাখ্যা আমাদের জানা নেই। তখন দুজন কারাবন্দির মধ্যে যে ব্যক্তি মুক্তি পেয়েছিল, দীর্ঘকাল পরে তার (ইউসুফের কথা) স্মরণ হলো এবং বলল, আমি আপনাদের এ স্বপ্নের ব্যাখ্যা বলে দেব, আপনারা আমাকে (জেলখানায়) পাঠিয়ে দিন। অতঃপর সে জেলখানায় পৌঁছে বলল, ইউসুফ হে আমার সত্যবাদী বন্ধু! (বাদশাহ স্বপ্ন দেখেছেন যে,) সাতটি মোটা-তাজা গাভি, তাদের খেয়ে ফেলছে সাতটি শীর্ণ গাভি এবং সাতটি সবুজ শিষ ও অন্যগুলো শুষ্ক। আপনি আমাদের এ স্বপ্নের ব্যাখ্যা বলে দিন, যাতে আমি তাদের কাছে ফিরে গিয়ে তা জানাতে পারি। [জবাবে ইউসুফ (আ.) বলল] তোমরা সাত বছর উত্তমরূপে চাষাবাদ করবে। অতঃপর যখন ফসল কাটবে, তখন খোরাকি বাদে বাকি ফসল শিষসমেত রেখে দেবে। এরপর আসবে দুর্ভিক্ষের সাত বছর। তখন তোমরা খাবে এর আগে যা রেখে দিয়েছিলে, তবে কিছু  পরিমাণ বাদে যা তোমরা (বীজ বা সঞ্চয় হিসেবে) তুলে রাখবে। এর পরে আসবে এক বছর, যাতে লোকদের ওপর বৃষ্টি বর্ষিত হবে এবং তখন তারা (আঙ্গুরের) রস নিংড়াবে (অর্থাৎ উদ্বৃত্ত ফসল হবে)।’ (সুরা : ইউসুফ, আয়াত : ৪৩-৪৯)।

এরপর ওই খাদেম বাদশাহকে গিয়ে এই ব্যাখ্যা শোনালে তা বাদশাহর মনঃপূত হয়। এবং তিনি হজরত ইউসুফ (আ.)-কে মুক্তি দিয়ে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণের আবেদন করেন। অবশেষ বাদশাহ যখন বুঝতে পারলেন যে ইউসুফ (আ.)-এর ওপর আপতিত অপবাদগুলো সম্পূর্ণ মিথ্যা ছিল, তখন তিনি বাদশাহর আবেদন মঞ্জুর করলেন।

কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ফিরে এসে বাদশাহর সঙ্গে কথোপকথনের একপর্যায়ে বাদশাহ যখন দুর্ভিক্ষ মোকাবেলায় দক্ষ ও বিশ্বস্ত লোক কোথায় পাবেন বলে নিজের অসহায়ত্ব প্রকাশ করছিলেন, তখন ইউসুফ (আ.) নিজেকে এ জন্য পেশ করেন। পবিত্র কোরআনের ভাষায়, ‘ইউসুফ বললেন, আপনি আমাকে দেশের ধনভাণ্ডারের দায়িত্বে নিয়োজিত করুন। আমি বিশ্বস্ত রক্ষক ও (এ বিষয়ে) বিজ্ঞ।’ (সুরা : ইউসুফ, আয়াত : ৫৫)

উল্লেখ্য, তাঁর এই পদপ্রার্থনা ও নিজের যোগ্যতা নিজমুখে প্রকাশ করার উদ্দেশ্য নিজের শ্রেষ্ঠত্ব ও অহংকার প্রকাশের জন্য ছিল না। বরং কুফরি হুকুমতের অবিশ্বস্ত ও অনভিজ্ঞ মন্ত্রী ও আমলাদের হাত থেকে আসন্ন দুর্ভিক্ষপীড়িত সাধারণ জনগণের স্বার্থরক্ষার জন্য ও তাদের প্রতি দয়ার্দ্র চিত্ততার কারণে ছিল।

আহলে কিতাবদের বর্ণনামতে এই সময় বাদশাহ তাঁকে শুধু খাদ্য মন্ত্রণালয় নয়, বরং পুরো মিসরের শাসনক্ষমতা অর্পণ করেন এবং বলেন, ‘আমি আপনার চেয়ে বড় নই, শুধু সিংহাসন ব্যতীত।’ ইবনু ইসহাকের বর্ণনামতে এ সময় বাদশাহ তাঁর হাতে মুসলমান হন। এ কথাও বলা হয়েছে যে এই সময় ‘আজিজে মিসর’ কিিফর মারা যান। ফলে ইউসুফকে ওই পদে বসানো হয় এবং তাঁর বিধবা স্ত্রী জুলায়খাকে বাদশাহ ইউসুফের সঙ্গে বিবাহ দেন।

ইউসুফের দক্ষ শাসন ও দুর্ভিক্ষ মোকাবেলায় অপূর্ব ব্যবস্থাপনা সুদ্দী, ইবনু ইসহাক, ইবনু কাছির প্রমুখ বিদ্বান ইসরায়েলি রেওয়ায়াতগুলোর ভিত্তিতে যে বিবরণ দিয়েছেন, তার সারকথা এই যে ইউসুফ (আ.)-এর হাতে মিসরের শাসনভার অর্পিত হওয়ার পর স্বপ্নের ব্যাখ্যা অনুযায়ী প্রথম সাত বছর সমগ্র দেশে ব্যাপক ফসল উৎপন্ন হয়। ইউসুফ (আ.)-এর নির্দেশক্রমে উদ্বৃত্ত ফসলের বৃহৎ অংশ সঞ্চিত রাখা হয়।

এরপর স্বপ্নের দ্বিতীয় অংশের বাস্তবতা শুরু হয় এবং দেশে ব্যাপক দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। তিনি জানতেন যে এ দুর্ভিক্ষ সাত বছর স্থায়ী হবে এবং আশপাশের রাজ্যগুলোয় বিস্তৃত হবে। তাই সংরক্ষিত খাদ্যশস্য খুব সতর্কতার সঙ্গে ব্যয় করা শুরু করলেন। তিনি ফ্রি বিতরণ না করে স্বল্পমূল্যে খাদ্য বিতরণের সিদ্ধান্ত নেন। সেই সঙ্গে মাথাপ্রতি খাদ্য বিতরণের একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ নির্ধারণ করে দেন। তাঁর আগাম হুঁশিয়ারি মোতাবেক মিসরীয় জনগণের বেশির ভাগ বাড়িতে সঞ্চিত খাদ্যশস্য মজুদ ছিল। ফলে পার্শ্ববর্তী দুর্ভিক্ষপীড়িত রাজ্যগুলো থেকে দলে দলে লোকেরা মিসরে আসতে শুরু করে। ইউসুফ (আ.) তাদের প্রত্যেককে বছরে এক উট বোঝাই খাদ্যশস্য স্বল্পমূল্যের বিনিময়ে প্রদানের নির্দেশ দেন। অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হওয়ার কারণে খাদ্য বিতরণের তদারকি ইউসুফ (আ.) নিজেই করতেন। এতে ধরে নেওয়া যায় যে খাদ্যশস্যের সরকারি রেশনের প্রথা বিশ্বে প্রথম ইউসুফ (আ.)-এর হাতেই শুরু হয়। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া : ১/১৯৭, নবীদের কাহিনি, পৃ : ২০৮)

বর্তমান যুগেও যদি কোনো দেশের সরকার দুর্ভিক্ষ মোকাবেলায় আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা রেখে হজরত ইউসুফ (আ.)-এর গৃহীত পদক্ষেপগুলো অনুসরণ করে, তাহলে ইনশাআল্লাহ মহান আল্লাহ আমাদের যেকোনো ধরনের দুর্ভিক্ষ থেকেও মুক্ত রাখবেন। আল্লাহ সব বিপদ থেকে বিশ্ববাসীকে হেফাজত করুন। আমিন।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *