মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে সুরা বাকারার ২১৬ নম্বর আয়াতে বলেছেন, ‘…তোমরা কোনো বিষয় অপছন্দ করছ অথচ তা তোমাদের জন্য কল্যাণকর। আর এ-ও হতে পারে যে কোনো বিষয় তোমরা পছন্দ করছ অথচ তা তোমাদের জন্য অকল্যাণকর। আর আল্লাহ জানেন এবং তোমরা জানো না।’
জীবন মানেই পরীক্ষা। হতে পারে এই পরীক্ষা খারাপ অথবা ভালো সময়ে। আল্লাহ কাউকে পরীক্ষা করেন সুসময় দিয়ে। আবার দুর্ভোগ দিয়েও পরীক্ষা করেন। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী মানবজাতি যে কঠিন সময় পার করছে তা হলো, করোনাভাইরাসজনিত (কভিড-১৯) বিশ্ব মহামারি। অদেখা এই ভাইরাস অজান্তে মুহূর্তের মধ্যে একজন থেকে বহুজনে ছড়িয়ে পড়ছে। লাখো প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। একজন বুঝে ওঠার আগেই সেটি তার দেহে বাসা বাঁধছে এবং দ্রুত তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। করোনাভাইরাসের এই তাণ্ডবকে আমরা নিঃসন্দেহে মহান আল্লাহর একটি পরীক্ষা হিসেবে বিশ্বাস করতে পারি। সর্বশক্তিমান আল্লাহ এটিকে বহুগুণে বাড়িয়ে দিতে পারেন এবং একটি ভয়ংকর রূপ নিতে সক্ষম। এই ভয়ংকর ভাইরাস এখন জীবনহানিসহ দুনিয়ার তাবৎ সম্পদভাণ্ডার তছনছ করে দিচ্ছে। বিশ্ববাজারকে ধসিয়ে ও আর্থিক ব্যবস্থা স্থবির করে বিশ্ব যোগাযোগের সব কিছু বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে বিশ্বের দেশে দেশে শিল্প-কলকারখানা, ব্যবসা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, প্রার্থনাগৃহ বাধ্যতামূলকভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। এর পরও থামছে না এর ভয়াল থাবা। আগেও বিশ্ব বহুবার প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যুদ্ধ-বিগ্রহ এবং মহামারির মুখোমুখি হয়েছে। তবে সেগুলো কোনো না কোনো স্থান বা বিশেষ দেশে বা এলাকায় সীমাবদ্ধ ছিল। তবে বর্তমান করোনা মহামারি স্থান-কাল-পাত্র, জাতি-ধর্ম-বর্ণ, রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিচয়ভেদে—নির্বিশেষে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। এখন আকাশে মহাদুর্যোগ, ভয় ও অনিশ্চয়তার ঘনঘটা। মানুষ হতাশা, শঙ্কা ও ভয়-ভীতির অক্টোপাসে যেন জড়িয়ে গেছে এবং বেশির ভাগ মানুষের চেহারায় তার বিরূপ ছাপ লক্ষ করা যাচ্ছে।
তবে ঈমানদাররা এই অপ্রত্যাশিত অনিশ্চয়তা, ভয় ও ক্ষতির মধ্যেও আল্লাহর সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক আরো বৃদ্ধি করবেন। কেননা প্রতিটি বিপদ-আপদ-দুর্ভোগে আল্লাহ স্বাচ্ছন্দ্য বা প্রশান্তির ওয়াদা করেছেন। ঈমানদারদের অটল বিশ্বাস যে এই বিপদ অবশ্যই কেটে যাবে। তবে এই পরীক্ষার মধ্য দিয়ে আমাদের অবশ্যই পরিশুদ্ধি এবং আত্মার পুষ্টি সাধনের উপায় খুঁজতে হবে। একজন ঈমানদার প্রতি মুহূর্তে আল্লাহর করুণা ও পুরস্কার পাওয়ার আশা করে। ঈমানদাররা সব সময় আল্লাহর রহমতের আশা করে, যিনি দয়াময় (রাহমান), অমুখাপেক্ষী (সামাদ) এবং যিনি আমাদের অধঃপতন চান না, তিনি চান আমরা যেন অন্ধকার থেকে আলোর পথে ফিরতে পারি। আল্লাহ আমাদের কষ্ট দিয়ে পরীক্ষা করেন, আবার তিনি কষ্ট থেকে উত্তরণেরও উপায় বাতলে দেন। আল্লাহ দেখতে চান, দুর্ভোগ ও দুর্দশায় আমরা যে উদ্বেগ ও অশান্তিতে পড়ি, তার প্রতিক্রিয়া আমরা কিভাবে প্রদর্শন করি। যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই, তা থেকে আমরা কিভাবে মুক্তির উপায় খুঁজি—সেটাই আল্লাহ দেখতে চান। অবশ্যই সব আপদ-বিপদ, মুসিবত ও অনিশ্চয়তা থেকে মুক্তির উপায় হলো দৃঢ় ঈমান, আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা, অবিচল ধৈর্য এবং তাঁর ওপর তাওয়াক্কুল। ঈমানদারদের জন্য তাওয়াক্কুল বড় একটি ইবাদত। সুরা মায়েদার ২৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘…আর আল্লাহর ওপরই তাওয়াক্কুল করো, যদি তোমরা মুমিন হও।’
সুরা শুরার ৩৬ নম্বর আয়াতে আল্লাহ আরো বলেন, ‘…আর আল্লাহর কাছে যা আছে তা উত্কৃষ্ট ও স্থায়ী তাদের জন্য, যারা ঈমান আনে এবং তাদের রবের ওপর তাওয়াক্কুল করে।’
তাই ঈমানদাররা প্রতিটি কাজে তাঁর প্রতি বিশ্বাস রাখে। আর এই বিশ্বাসের বলেই সে প্রতিটি ভয় ও অনিশ্চয়তার সময় আশাবাদী ও প্রশান্ত হয়। সে ভেঙে পড়ে না। হতাশা তাকে টলাতে পারে না। কেননা ঈমানদারদের বিশ্বাস, আল্লাহ যেকোনোভাবে তাকে সাহায্য করতে পারেন, তাকে ভয়-ভীতি ও অনিশ্চয়তা থেকে উদ্ধার করতে সক্ষম। আল্লাহ সুরা তালাকের ৩ নম্বর আয়াতে বলেন, ‘এবং তিনি তাকে এমন উৎস থেকে রিজিক দেবেন, যা সে কল্পনাও করতে পারবে না। আর যে আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করে আল্লাহ তার জন্য যথেষ্ট।’
তাওয়াক্কুল কী
মানুষের অন্তঃকরণে তাওয়াক্কুলের বাস। এটি মুমিনের প্রকৃত আধ্যাত্মিকতার পরিচয় এবং ব্যাবহারিক আচরণ। তাওয়াক্কুল এমন একটি লেন্স, যার মধ্যে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণ প্রতিফলিত হয়। সুরা আলে ইমরানের ১৫৯ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘…আর কাজ-কর্মে তাদের সঙ্গে পরামর্শ করো। অতঃপর যখন সংকল্প করবে তখন আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ তাওয়াক্কুলকারীদের ভালোবাসেন।’
মানুষ মাত্রই লড়াই করে বাঁচতে হয়, প্রচেষ্টা চালাতে হয়, আপদ-বিপদ ও পেরেশানিতে পড়তে হয়, অনিশ্চয়তার করালগ্রাসে আপতিত হতে হয়। এগুলো মানবজীবনের চরম বাস্তবতা। আর তাওয়াক্কুল হলো একটি উপায়, যার সাহায্যে মুমিনরা সেসব পরিস্থিতি মোকাবেলা করে সমাধান ও প্রশান্তির ভিত রচনা করে।
তাওয়াক্কুলের উপকারিতা অশেষ। এর মাধ্যমে আমরা আমাদের মানসিক বোঝা আল্লাহর ওপর সোপর্দ করার সুযোগ পাই। আমরা অনুভব করতে পারি, আমরা ভেঙে পড়ার মতো নই, আমরা একা নই এবং আমরা আশাহত নই, আর আল্লাহই আমার সুরক্ষার ব্যবস্থা করবেন। এভাবে ঈমানদাররা আত্মবিশ্বাসের ভিত্তিকে মজবুত করে। সুরা হুদের ৮৮ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘…আল্লাহর সহায়তা ছাড়া আমার কোনো কার্যসাধন নেই। আমি তাঁরই ওপর তাওয়াক্কুল করেছি এবং তাঁরই কাছে ফিরে যাই।’
ইসলামে আল্লাহর ওপর ভরসার ধারণা, কোরআন ও হাদিসে বারবার উচ্চারিত হয়েছে। আমরা প্রতিনিয়ত এসব কথা অত্যন্ত আকুলভাবে উচ্চারণ করি। অথচ তাওয়াক্কুলের মহিমা আমরা অনুধাবন করতে পারি না। কেননা আমাদের অন্তঃকরণের সঙ্গে আল্লাহর ক্ষমতার বাণীগুলোর বাস্তব সংযোগ ঘটে না। তাই প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে কিভাবে এই সংযোগ সৃষ্টি হবে? আমরা তাহলে প্রাত্যহিক জীবনে কিভাবে তাওয়াক্কুলের উপকারিতা অর্জন করতে পারব? তাওয়াক্কুল হলো, সব কিছুর ঊর্ধ্বে উঠে এককভাবে আল্লাহর ওপর আস্থা রাখার নাম। ইবনে রজব (রহ.) বর্ণনা করেন, ‘দাসত্বের মনোভাব নিয়ে সর্বান্তকরণে আল্লাহর ওপর সত্যিকার আস্থার নাম তাওয়াক্কুল। আল্লাহ সব ধরনের আপদ-বিপদ ও ক্ষয়ক্ষতি থেকে দুনিয়া ও আখিরাতে বান্দার সব স্বার্থ ও নিরাপত্তা বিধান করবেন।’ (সূত্র : দ্য পিউরিফিকেশন অব সোল)
তবে অনেক সময় শয়তান মানুষকে তাওয়াক্কুলের ব্যাপারে ধৈর্যচ্যুত করে ফেলে এবং বিভ্রান্তিতে ফেলে দেয়। এ অবস্থায় ঈমানদারদের আল্লাহ সম্পর্কে গভীর আস্থা থাকতে হবে এবং তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক মজবুত করতে হবে।
আল্লাহকে চিনতে হলে
আল্লাহকে জানতে তাঁর নামগুলো এবং তাঁর গুণাবলি সম্পর্কে জানতে হবে এবং সেগুলো মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতে হবে। আল্লাহর নাম সব সময় পাঠ করতে হবে এবং তা অন্তঃকরণে প্রতিফলিত করতে হবে। এতে আল্লাহর সঙ্গে বান্দার প্রকৃত যোগাযোগ তৈরি হবে এবং তার অন্তরে তাওয়াক্কুলের গুণ বদ্ধমূল হবে। যেমন আল্লাহ সম্পর্কে বলা হয়, তিনি হায়্যুন (জীবিত), কায়্যুম (অস্তিত্বশীল), আলিম (মহাজ্ঞানী), কাদির (সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী), গনি (অভাবমুক্ত), রাজ্জাক (জীবিকাদাতা), কারিম (সম্মানিত)। আল্লাহ আমাদের অভিভাবক (আল-ওয়াকিল)। পবিত্র কোরআনে সুরা নিসার ১৭১ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘…আসমানে যা আছে এবং যা আছে জমিনে, তা আল্লাহরই। আর কর্মবিধায়ক হিসেবে আল্লাহই যথেষ্ট।’
মহান আল্লাহ সব সময় তাঁর সৃষ্টিকে নিয়ন্ত্রণ করেন। তাই আমরা আল্লাহর এই গুণাবলি এবং মহত্ত্ব ও বড়ত্ব সম্পর্কে যত বেশি জানতে পারব, তাঁর ওপর আমাদের ভরসা ও নির্ভরতাও ততই বাড়বে। বৃদ্ধি পাবে আল্লাহর প্রতি আমাদের ভালোবাসা, আর মজবুত হবে তাওয়াক্কুল।
তাওয়াক্কুলের উপকারিতা
তাওয়াক্কুলের বাঞ্ছিত উপকারিতা লাভ করার একটি উপায় হলো দোয়া। মহান আল্লাহ তাদের ডাকে সাড়া দেন, যারা তাঁর ওপর আস্থা স্থাপন করে। তাওয়াক্কুল আল্লাহর একক সত্তা ও তাওহিদের প্রতি দৃঢ় আস্থার প্রতিফলন। সুরা তাওবার ১২৯ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘অতঃপর যদি তারা বিমুখ হয়, তবে বলো, আমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট, তিনি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই। আমি তাঁর ওপরই তাওয়াক্কুল করেছি। আর তিনিই মহা আরশের রব।’
এভাবে সর্বান্তকরণে আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করলে এবং তাঁকে সব কিছুর তত্ত্বাবধায়ক মনে করলে, একজন মুমিন আল্লাহর ভালোবাসা লাভ করতে সক্ষম হয়। সুরা আলে ইমরানের ১৫৯ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘…নিশ্চয়ই আল্লাহ তাওয়াক্কুলকারীদের ভালোবাসেন।’
সুতরাং তাওয়াক্কুল মনের প্রশান্তি আনয়ন করে। দুনিয়ার সংকট বা দুর্ভোগ মনের এই প্রশান্তির বিঘ্ন ঘটাতে পারে না। তাওয়াক্কুল শান্তি, সান্ত্বনা ও সুরক্ষার উৎস, যা মহান আল্লাহ বিশ্বাসীদের ভয়-ভীতি এবং অনিশ্চয়তা থেকে মুক্তির জন্য উপহার দিয়েছেন। আর এটা আল্লাহর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়া এবং বিশ্বাস (ঈমান) ও নির্ভরতা (ইয়াকিন) বৃদ্ধির অনন্য উপায়। সুরা তাগাবুনের ১১ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কোনো বিপদই আপতিত হয় না। যে আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে, আল্লাহ তার অন্তরকে সৎপথে পরিচালিত করেন। আল্লাহ প্রত্যেক বিষয়ে সর্বজ্ঞ।’
অতএব, কেউ যদি দুর্ভোগের পরীক্ষায় পড়ে এবং কায়মনোবাক্যে কোনো নির্দিষ্ট দোয়া করার পরও তাত্ক্ষণিক ফল দেখতে পায় না, তাকে আশাবাদী হতে হবে যে আল্লাহর মহিমার কোনো শেষ নেই এবং তিনি অবশ্যই ওই দুর্ভোগ-দুর্গতি মিটিয়ে দেবেন এবং এর ক্ষতি অন্য যেকোনো উত্তম কিছু দিয়ে পূরণ করবেন।
নবীরা কিভাবে তাওয়াক্কুল করেছেন
তাওয়াক্কুলের শিক্ষা নবী-রাসুল ও মনীষীরা কিভাবে গ্রহণ করেছেন এবং তাঁদের জীবনে তার বাস্তবায়ন করেছেন, তার কয়েকটি উদাহরণ এখানে তুলে ধরা হলো—
ইবরাহিম (আ.) আল্লাহর ওপর দৃঢ়বিশ্বাস রাখার কারণে আগুনের কুণ্ডলীর মধ্যে থেকেও আগুনকে শীতল এবং আরামদায়ক অনুভব করেন। আল্লাহর রাসুল (সা.) উহুদের ময়দানে শত্রুর বিশাল বাহিনীর উপস্থিতি জানার পর সাধ্যমতো উপায় অবলম্বন, কৌশলগত পরিকল্পনা, অস্ত্রশস্ত্র এবং দোয়ার মাধ্যমে নিরাপত্তার জন্য আল্লাহর সাহায্য কামনা করেন। মদিনায় হিজরতকালীন ভয়াবহ বিপদের মুখে রাসুল (সা.) তাঁর নিরাপত্তার নির্দেশনার জন্য আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা স্থাপন করেন। তারপর তিনি নিরাপত্তার যাবতীয় কৌশল অবলম্বন করেন। আবুবকর (রা.)-কে সঙ্গে নিয়ে তিনি মক্কা থেকে বের হন, পথনির্দেশক (গাইড) সঙ্গে নেন এবং নিরাপদে যাওয়ার জন্য বিকল্প পথ বেছে নেন। প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা গ্রহণের পর তিনি নিরাপদে মদিনায় রওনা হওয়ার আগ পর্যন্ত সওর গুহায় অবস্থান করেন। সওর নামক গুহায় নিরাপত্তার ব্যাপারে আশঙ্কা তৈরি হলে আবুবকর (রা.) উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন, তখন মহানবী (সা.) তাঁকে আল্লাহর ওপর গভীর আস্থা রাখার কথা মনে করিয়ে দেন। এ কথাই সুরা তাওবার ৪০ নম্বর আয়াতে আল্লাহ উল্লেখ করেন, ‘যদি তোমরা তাকে সাহায্য না করো, তবে আল্লাহ তাঁকে সাহায্য করেছেন, যখন কাফিররা তাকে বের করে দিল, সে ছিল দুজনের দ্বিতীয়জন। যখন তারা উভয়ে পাহাড়ের একটি গুহায় অবস্থান করছিল, সে তার সঙ্গীকে বলল, তুমি পেরেশান হয়ো না, নিশ্চয়ই আল্লাহ আমাদের সঙ্গে আছেন। অতঃপর আল্লাহ তার ওপর তাঁর পক্ষ থেকে প্রশান্তি নাজিল করলেন এবং তাকে এমন এক সৈন্যবাহিনী দ্বারা সাহায্য করেন, যাদের তোমরা দেখোনি এবং তিনি কাফিরদের বাণী অতি নিচু করে দিলেন। আর আল্লাহর বাণীই সুউচ্চ। আর আল্লাহ মহাপরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাবান।’
ফেরাউন যখন মুসা (আ.)-কে তাড়া করল, তখন তিনি আল্লাহর হুকুমে তাঁর লাঠি দিয়ে সাগরের পানিতে আঘাত করলে পানির মধ্যেই তাঁর নিরাপত্তার জন্য রাস্তা তৈরি হয়ে গেল। এ সময় মুসা (আ.)-কে আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও তাওয়াক্কুল করেন। তিনি বলেন, ‘কখনো নয়, আমার সঙ্গে আমার রব আছেন। নিশ্চয়ই অচিরেই তিনি আমাকে পথনির্দেশ দেবেন।’ (সুরা : শুআরা, আয়াত : ৬২)
আল্লাহর কী শান, মুসা (আ.)-এর মা শিশু মুসাকে আল্লাহর ইশারায় অনুপ্রাণিত হয়ে নদীতে ভাসিয়ে দেন। আল্লাহর মহিমায় তিনি শত্রু ফেরাউনের ঘরে মায়ের যত্নেই পালিত হন এবং নিরাপদে তাঁকে মিসর ত্যাগ করতে মহান আল্লাহ সাহায্য করেন। এসব ঘটনার মাধ্যমে আমরা যেকোনো বিপদ-মুসিবত ও সংকটের সময় আল্লাহর তাওয়াক্কুলের মাধ্যমে তা থেকে উতরিয়ে ওঠার শিক্ষা লাভ করি। আমাদের মধ্যে যারা কোনো বিপদ, যেমন—ঝড়-তুফান, অন্যায়-অবিচার, জীবনের হুমকি অথবা মহামারির মতো অবস্থায় পতিত হই, তা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আল্লাহর ওপর গভীর আস্থা ও তাওয়াক্কুল করতে হবে এই আশা ও বিশ্বাস নিয়ে যে আল্লাহ এসব সমস্যা দূর করবেন এবং মহান আল্লাহ সব সময় আমাদের সঙ্গেই আছেন।
মহানবী (সা.) কিভাবে তাওয়াক্কুল করেছেন
মহানবী (সা.)-এর হাদিস থেকে তাওয়াক্কুলের মহিমা সম্পর্কে আরো অনেক উদাহরণ জানা যায়। রাসুল (সা.) বলেন, ‘তুমি যদি আল্লাহর ওপর প্রকৃত আস্থা রাখো, তাহলে তিনি নিশ্চিতভাবে রসদ সরবরাহ করবেন, যা তিনি পাখিদের দেন, যারা সকালবেলা ক্ষুধার্ত অবস্থায় বের হয় এবং পূর্ণ পেট খেয়ে বিকেলে ফিরে আসে।’ (রিয়াদুস সালেহিন)
এই হাদিসের মূল কথা হলো, তাওয়াক্কুল অন্তরে তৈরি হয়, এটি হলো আল্লাহর ওপর নির্ভরতা। তাওয়াক্কুলের শক্তিতে বলীয়ান ঈমানদাররা তার পথ নির্ধারণ করে, কিভাবে সে তার গন্তব্যে পৌঁছবে, তার নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা ইত্যাদি অর্জন করবে। কেউ জানে না, তার পথ কোথায় গিয়ে শেষ হবে, না তার জ্ঞান তাকে জানাতে পারে, কখন সে তার গন্তব্যে গিয়ে পৌঁছবে।
তাওয়াক্কুল আধ্যাত্মিক ও বৈষয়িক উপায় অবলম্বনের একটি সমন্বয়। এর মানে আল্লাহর ওপর ভরসা সৃষ্টি হয় অন্তকরণে এবং এটির পরস্ফুিটন ঘটে বাস্তব কাজের মাধ্যমে। আর এই কাজ হলো সেসব উপায়, যা আল্লাহর অনুমোদিত আওতার মধ্যে রয়েছে। এর শুরু ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্য কামনা করা এবং সাধ্যানুযায়ী বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করা। এই পদক্ষেপ হতে পারে বিশ্বস্ত লোক, পরিবারের সদস্য, বন্ধুবান্ধব এবং প্রযোজ্য ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ, যেমন ডাক্তার বা চলমান সংকট সম্পর্কে দক্ষ ব্যক্তির পরামর্শ গ্রহণ করা। আল্লাহর ওপর ভরসা এবং সংগতি অনুযায়ী এসব পদক্ষেপের সমন্বয়ে সংকট উত্তরণের প্রয়াস চালাতে হবে। এ কথাই পবিত্র কোরআনে সুরা মায়েদার ২ নম্বর আয়াতে আল্লাহ উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, ‘…সৎকর্ম ও তাকওয়ায় তোমরা পরস্পরের সহযোগিতা করো। মন্দ কর্ম ও সীমা লঙ্ঘনে পরস্পরের সহযোগিতা কোরো না। আর আল্লাহকে ভয় করো।’
তাই সৎকর্ম করে যেতে হবে এবং একই সঙ্গে আল্লাহর ওপর দৃঢ় আস্থা রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে, এর প্রতিদান অবশ্যই নিশ্চিত, তবে এর জন্য চাই প্রচেষ্টা জারি রাখা। গভীর আস্থার সঙ্গে সম্পাদিত প্রতিটি কাজই আল্লাহর পথে বলে বিবেচিত হয় এবং তার জন্য আল্লাহর পুরস্কারও অবশ্যম্ভাবী।
অতএব, তাওয়াক্কুল ঈমানদারদের আস্থা, সাহস, শক্তি, প্রণোদনা এবং কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করে, যাতে আল্লাহর ওপর ভরসা রাখার কারণে তারা লক্ষ্য অর্জন করতে পারে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, ‘অতঃপর যখন সালাত সমাপ্ত হবে, তখন তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ো আর আল্লাহর অনুগ্রহ থেকে অনুসন্ধান করো এবং আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করো, যাতে তোমরা সফল হতে পারো।’ (সুরা : জুমুআ, আয়াত : ১০)
পরিশেষে
বর্তমানে ধর্ম-বর্ণ, জাতি-সম্প্রদায়-নির্বিশেষে গোটা বিশ্বের মানুষ করোনাভাইরাসের মতো মহামারির করাল গ্রাসে বিপর্যস্ত। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ এই ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছে। প্রাণ হারাচ্ছে অসংখ্য মানুষ। বিশ্বের তাবৎ শক্তিধর দেশও এই ভাইরাসের তাণ্ডবে অসহায় হয়ে পড়েছে। প্রয়োজনীয় ওষুধ বা টিকার ব্যবস্থাও নেই, যা দিয়ে ন্যূনতম চিকিৎসাসেবা মানুষকে দেওয়া যেতে পারে। তাই ভয় আর আতঙ্কে দুনিয়ার সর্বত্র চলছে লকডাইন, মানে বাধ্যতামূলক অবরোধ। মানবজীবন এখন ঘরের দেয়ালে আবদ্ধ। এই মহামারির ছোবল এবং আতঙ্কে মানুষের স্বাভাবিক জীবন অনির্দিষ্টকালের জন্য থেমে গেছে। থেমে গেছে দুনিয়ার সব সামাজিক ও অর্থনৈতিক কার্যক্রম। একটি ভয়াল অন্ধকার গহ্বরে প্রবেশ করেছে মানবসভ্যতা। কোথায় এর শেষ, কখনই বা সমাপ্তি—তার কিছুই আঁচ করতে পারছেন না বিশ্বনেতারা। এই অভাবনীয় সংকটকালে ঈমানদারদের ভয় পাওয়ার কিছুই নেই। আল্লাহর ওপর গভীর আস্থা (তাওয়াক্কুল করা) এবং তাঁর সাহায্যের জন্য প্রতিনিয়ত দোয়া করার মাধ্যমে ঈমানদাররা আশার আলোর জন্য অপেক্ষা করতে পারে। এ সময় আমরা আল্লাহর গুণাবলি সর্বান্তকরণে স্মরণ করব এবং তাঁর প্রিয় বান্দা হওয়ার চেষ্টা করব। নিশ্চয়ই তিনি আমাদের সঙ্গে আছেন, তিনি আমাদের আকুল আবেদন শোনেন এবং তিনিই আমাদের উদ্ধারের পথ বাতলে দেবেন। সুরা শুআরার ৬২ নম্বরের সেই আয়াতটি আবার স্মরণ করি এবং বলি : ‘কখনো নয়, আমার সঙ্গে আমার রব আছেন। নিশ্চয়ই অচিরেই তিনি আমাকে পথনির্দেশ দেবেন।’
মহান আল্লাহ আমাদের সফল মুমিন হিসেবে কবুল করুন। মহান আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও ভরসার শক্তিতে ভর করে সব প্রতিকূল পরিস্থিতিতে অবিচল থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন।
সফলতা লাভের উপায়
এখানে কতগুলো উপায় আলোচনা করা হলো, যা দৈনন্দিন জীবনে পরিপালন করে আমরা তাওয়াক্কুলের গুণ আত্মস্থ করতে পারি
এক. দোয়া : দোয়া ইবাদতের সর্বোত্কৃষ্ট একটি উপায় এবং তাওয়াক্কুলের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। সুরা হুদের ১২৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘…সুতরাং তুমি তাঁর ইবাদত করো এবং তাঁর ওপর তাওয়াক্কুল করো। আর তোমরা যা কিছু করো, সে ব্যাপারে তোমার রব গাফিল (উদাসীন) নন।’
সুরা মুমিনুনের ৬০ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘…তোমরা আমাকে ডাকো, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দেব…।’
তাই ঈমানদারদের উচিত, কোরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী দোয়াগুলো জেনে-বুঝে এর মাধ্যমে নিষ্ঠার সঙ্গে ও কায়মনোবাক্যে আল্লাহকে ডাকা এবং তাঁর সঙ্গে গভীর সম্পর্ক স্থাপন করা।
আমরা যদি উদ্বেগ ও ভয়-ভীতির সময় বেশি বেশি দোয়া করি, আল্লাহর ওপর ভরসা রাখি, তাহলে আল্লাহ আমাদের মিনতি শুনবেন এবং উদ্বেগ ও ভয়-ভীতি লাঘব করবেন।
দুই. সংকল্পে দৃঢ় থাকা : আমরা আল্লাহর ওপর ভরসা রাখব এবং এতে দৃঢ় সংকল্প থাকব। সুরা আলে ইমরানের ১৫৯ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘…অতঃপর যখন সংকল্প করবে তখন আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ তাওয়াক্কুলকারীদের ভালোবাসেন।’
আনাস (রা.) বর্ণনা করেন, একজন বলল, ‘হে রাসুল (সা.)! আমি কি আমার উটকে বাঁধব এবং আল্লাহর ওপর ভরসা করব, নাকি আমি উটকে ছেড়ে দেব এবং আল্লাহর ওপর ভরসা করব? রাসুল (সা.) বলেন, ‘এটিকে বাঁধো এবং আল্লাহর ওপর ভরসা করো।’ (তিরমিজি)
তিন. পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ : আল্লাহ আমাদের সুযোগ দিয়েছেন যে আমরা তাঁর সঙ্গে কথা বলি এবং আমাদের অন্তর ও মনকে দিনে অন্তত পাঁচবার ভারমুক্ত করি। এই সুযোগ হলো সালাত। সালাতে আমরা আল্লাহর প্রশংসা করি, তাঁর মাহাত্ম্য বর্ণনা করি, তাঁর কিতাবের আয়াত তিলাওয়াত করি এবং দোয়ার মাধ্যমে তাঁর অনুগ্রহ প্রার্থনা করি। আর এভাবে আমাদের তাওয়াক্কুল মজবুত হয়। সুরা ফাতিহার ৪ নম্বর আয়াতের বর্ণনা মতে আমরা বলি, ‘আমরা আপনারই ইবাদত করি এবং আপনারই কাছে সাহায্য চাই।’ অতএব, সালাতের মাধ্যমে ঈমানদাররা আল্লাহর ওপর ভরসা করা এবং তাঁর কাছে সাহায্য চাওয়ার শিক্ষা লাভ করে।
চার. গায়েবে বিশ্বাস : আমরা কিছু না দেখেই আল্লাহ, তাঁর কিতাব, ফেরেশতা, নবী-রাসুলসহ সব কিছু বিশ্বাস করি। সুরা বাকারার ২ ও ৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘এটি আল্লাহর কিতাব, এতে কোনো সন্দেহ নেই, মুত্তাকিদের জন্য হেদায়েত। যারা গায়েবের প্রতি ঈমান আনে, সালাত কায়েম করে এবং আমি তাদের যে রিজিক দিয়েছি তা থেকে ব্যয় করে।’
আমাদের এই নিঃশর্ত বিশ্বাস আমাদের আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুলের ভিত্তি মজবুত করে।
পাঁচ. ধৈর্য ধারণ : আমরা প্রতিদিন ধৈর্যের পরীক্ষা দিই। হোক তা সফলতার সময় বা দুঃখ-দুর্দশার সময়। একজন তাওয়াক্কুলসম্পন্ন ব্যক্তি সব অবস্থায় ধৈর্য ধারণ করে, দৃঢ়তা অবলম্বন করে এবং কাজে নিবিষ্ট থাকে। আর এই গুণের কারণে একজন আত্মনিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়।
ছয়. কৃতজ্ঞতা থাকা : একজন কৃতজ্ঞ মানুষ আল্লাহর ওপর বিশ্বাস রাখে। সে আল্লাহকে কল্যাণদাতা, রিজিকদাতা এবং নিরাময়দাতা মনে করে। একজন ঈমানদার ভালো-মন্দ যা-ই ঘটুক না কেন, আল্লাহর রহমত থেকে হতাশ হয় না।
সাত. প্রতিদিনের জিকির : আল্লাহর রাসুল (সা.) মুমিনদের বহু দোয়া শিক্ষা দিয়েছেন। প্রতিদিন দোয়া পাঠ করলে আল্লাহর স্মরণের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর প্রতি আস্থা ও আশার পরিধি বৃদ্ধি পায়। এতে আল্লাহর ওপর ভরসার গুণ মজবুত হয়। আর এটাকে ঈমানদারদের একটি বৈশিষ্ট্য বলে উল্লেখ করে সুরা রাদের ২৮ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘যারা ঈমান আনে এবং আল্লাহর স্মরণে যাদের অন্তর প্রশান্ত হয়, জেনে রাখো, আল্লাহর স্মরণ দ্বারাই অন্তরসমূহ প্রশান্ত হয়।’